—ফাইল চিত্র
বিজয় দিবস আসিতেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তো বটেই, সব বাঙালির জন্যই এই বারের ১৬ ডিসেম্বর বিশেষ তাৎপর্যবহ। স্বাধীন জাতি হিসাবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশের দিনটির অর্ধশতক-উদ্যাপনের সূচনা— এবং সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন যাঁহাকে ঘিরিয়া আবর্তিত হইয়াছিল, সেই শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ— এই বৎসর। বিশ্ব বহু নেতা দেখিয়াছে, কিন্তু কাহারও নামে ও আহ্বানে অগণিত মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত, এইরূপ নেতা বেশি দেখে নাই। সাধারণ্যে মিশিয়া যাওয়া, মানুষের জাতি ও ভাষাগত মূল্যবোধের শিকড়ে যাইয়া তাঁহাদের স্বাধীনতার বোধে প্রবুদ্ধ করার শক্তি সকল নেতার আয়ত্ত নহে। বঙ্গবন্ধুর সেই অমিত শক্তি ছিল, নচেৎ স্বাধীনতার ঘোষণালগ্নেই গ্রেফতার-হওয়া, স্বদেশ হইতে বহু দূরে কারারুদ্ধ এক জননেতার স্বপ্ন সার্থক করিতে দেশবাসীর নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রণোদনা আসিত না। ইন্দিরা গাঁধীর সর্বৈব সহায়তা ও সমর্থন, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদিগকে ভারতীয় সেনার প্রশিক্ষণ দান ও কার্যকালে সম্মুখসমর, এই সকলই স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পথে মাইলফলক। একটি জাতির মর্মমূলে স্বাধীনতাস্পৃহা বিদ্ধ করিয়া তাহাকে স্বাধীন ও বিজয়ী করিবার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সাধনাকে তাবৎ বাঙালি নিয়ত স্মরণ করিতেছে।
যুদ্ধ করিয়া স্বাধীনতা অর্জন কঠিন, তবে মুক্ত দেশে স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধরিয়া রাখাও কিছু কম কঠিন নহে। মনে রাখিতে হইবে, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি স্তম্ভস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু বলিতেন, স্বাধীন বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি সকলের, প্রত্যেককে রক্ষা করাই প্রত্যেকের ধর্ম হইবে। তাঁহার স্বপ্ন ছিল, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় আন্দোলন পূর্ব হইতেই যে জাতির মজ্জায়, তাহার স্বাধীন সত্তা প্রোথিত হইবে ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। সদ্য-স্বাধীন দেশের জাতীয়তাবাদ-বিহ্বল থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু যাহা গুরুত্বপূর্ণ— দেশের সংবিধানে ‘বাঙালি’ শব্দটি হইয়া উঠিয়াছিল ধর্মোর্ধ্ব জাতীয়তাবাদের প্রতিশব্দ। সমাজে সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের অভ্যাস ও আচরণ থাকিবে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থাকিবে না, দেশকে একসূত্রে বাঁধিবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি-আশ্রয়ী উদার বাঙালিত্ব। উদ্বেগের বিষয়, এই অসাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশে গত অর্ধশতকে কম লঙ্ঘিত হয় নাই। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু-হত্যা তাহারই প্রমাণ, সেনা-শাসনে সংবিধান হইতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি মুছিয়াও গিয়াছিল। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনে তাহা ফিরিয়া আসিয়াছে। কিন্তু দেশে সাম্প্রদায়িকতার ছড়িটি ঘুরাইবার চেষ্টা এখনও অব্যাহত। মৌলবাদ যে সমাজ ও রাজনীতির পরিসরে রীতিমতো সক্রিয়, তাহার প্রমাণ সাম্প্রতিক কালে একটি কট্টর গোষ্ঠীর দেশ জুড়িয়া সমস্ত মূর্তি ও ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী বলিয়া ভাঙিয়া ফেলিবার নিদান এবং কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মীয়মাণ মূর্তির ক্ষতিসাধন। এইরূপ ঘটনা নূতন নহে। তিন বৎসর পূর্বে ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ‘লেডি জাস্টিস’-এর মূর্তি সরাইতে কট্টরপন্থীদের আন্দোলন হইয়াছিল, সেই মূর্তি সরানোও হইয়াছিল। ২০০৮ সালে ঢাকা বিমানবন্দর প্রাঙ্গণ হইতে লালন শাহের মূর্তিও তৎকালীন সরকার সরাইয়া লয়। ‘মুজিব বর্ষে’ খোদ দেশের স্বাধীনতার রূপকারের মূর্তি ভাঙা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্নভঙ্গ কি না, তাহা লইয়া চর্চা হইতেছে।
অথচ বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিবিধ সাফল্যের অধিকারী। সাম্প্রতিক কালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা হইতে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ, মাথাপিছু জাতীয় আয়ে ভারতকেও টপকাইয়া যাইবার সম্ভাবনা— বাংলাদেশের মুকুটে গৌরবপালক কম নাই। বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙিবার স্পর্ধিত দুষ্কৃতির আবহেই নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতুর ইস্পাত-নির্মিত সব স্প্যান বসাইবার কাজ শেষ হইয়াছে, সেতুর সম্পূর্ণ মূল কাঠামো দৃশ্যমান হইয়াছে। এই প্রকল্পের বাস্তবায়নেও বিস্তর বাধা আসিয়াছিল, এমনকি বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও আর্থিক দুর্নীতির দিকে ইঙ্গিত করিয়া বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক ও অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বিরূপ হইয়াছিল। শেখ হাসিনার সরকার ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ গড়িতেছে নিজ সামর্থ্যে। বাঙালির আত্মসম্পদ ও বিশ্বাসের এই সদ্ব্যবহার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, বলিলে ভুল হইবে না। কিন্তু সংবিধান-স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা যাহাতে নিঃশর্ত রক্ষিত ও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্যক উদ্যাপিত হয়, সুবর্ণজয়ন্তীর সূচনালগ্নে দণ্ডায়মান দেশটির তাহাই চ্যালেঞ্জ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy