বড় উৎসব শেষ হল। মহালয়ার দিন উৎসব শুরুর ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। রেড রোডে ‘পুজোর কার্নিভাল’-এর পরে লক্ষ্মীপুজো সেরে সেই উৎসবের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি হল, বলা যেতে পারে। কারণ, সরকারি অফিস-কাছারি খুলবে আজ, শুক্রবার থেকে। তবে সপ্তাহান্তের অফিসে ছুটির মেজাজ কাটবে কি না, বলা শক্ত। কাজে ফিরতে ফিরতে হয়তো তাই আগামী সপ্তাহ গড়াবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসব-প্রীতি সুবিদিত। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সব ধর্মের উৎসবকেই গুরুত্ব দিয়ে ক্রমশ এক অন্য রকম আবহ তৈরি করে দিয়েছেন। এখন বড়দিন এবং বর্ষশেষের কলকাতাকেও অনেক বেশি ঝলমলে লাগে। মানুষ অনেক বেশি আনন্দের উপাদান খুঁজে পান। পুজোর ঢাক যেমন মহালয়া থেকেই বাজিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী, তেমনই বড়দিন আসার আগেই পার্ক স্ট্রিটে ক্রিসমাস কার্নিভালের সূচনাও করে দেন তিনি।
তাঁর এই ধরনের বিবিধ উদ্যোগ নিয়ে কেউ সমালোচনা করতেই পারেন। বলতেই পারেন, তিনি মানুষকে উৎসবে মজিয়ে রাখার ‘রাজনীতি’ করছেন। কিন্তু ঘটনা হল, যাঁরা এ সব বলে হাততালি কুড়োতে চান, তাঁদেরও প্রায় সকলেই দিনের শেষে কোনও না কোনও ভাবে এই সব আনন্দে শরিক হয়ে ওঠেন। কারণ উৎসবের ব্যাপ্তি তাঁদের অনেককে টেনে আনে। আর সেখানেই অভিযোগের তিরও ভোঁতা হয়ে যায়।
দুর্গোৎসব এর অন্যতম উদাহরণ। বাঙালির সব চেয়ে বড় এই ধর্মীয় তথা সামাজিক উৎসব চির দিনের। তা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু ইদানীং পুজো থেকে বিসর্জন পর্যন্ত দুর্গোৎসবের সমারোহ যে মাত্রা পেয়েছে, তাতে মমতার ভূমিকা অস্বীকার করার নয়। আর লোকে তা উপভোগও করেন। রাজনীতিকের পক্ষে এটি অবশ্যই বাঞ্ছনীয় অবস্থান। মমতা তা ভালই বোঝেন। তাই ঝাঁপিয়ে পড়েন।
তবে হ্যাঁ, নিছক আনন্দ উপভোগের বাইরে এই রকম আয়োজনের পিছনে আরও কিছু ভাবনা কাজ করে। যেমন, সরকার মনে করে, পর্যটন শিল্পের প্রসারে এই সমারোহ প্রদর্শন কার্যকর হতে পারে। দেশ-বিদেশে এই সব জাঁকজমকের প্রচার হতে থাকলে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে। অন্য অনেক কিছুর মতো পর্যটন শিল্পেও এই রাজ্যের পিছিয়ে থাকা অনিবার্য ভবিতব্য হয়ে উঠেছিল। ইদানীং সেই খরা কাটছে। পুজোর ও শীতের কলকাতায় পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে, যার একটি বড় অংশ বিদেশি। এই প্রবণতা যাতে আরও বাড়ে, সে জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা হলে তা অন্যায় বলে মনে করি না।
কিন্তু শুধু পুজোর বা উৎসবের জৌলুস বাড়ালেই তো হবে না। এ সবের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে সামাজিক সচেতনতার প্রশ্ন। উৎসব যত বাড়ে, যত বেশি লোক এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত হন, ততই বাড়তে থাকে সামাজিক দায়বদ্ধতা। সেই দায় অবশ্যই একা সরকারের বা পুলিশ-প্রশাসনের নয়, তার একটি বড় ভার নিতে হয় পুজোর উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে উৎসবে অংশগ্রহণকারীদেরও।
দুর্ভাগ্য, নানা ক্ষেত্রে সেই সচেতনতা এখনও গড়ে তোলা গেল না। বরং ফাঁক নিয়ত প্রকট হয়। আর সেখানে প্রশাসনিক দায়িত্বশীলদের কাজকর্ম নিয়েও প্রশ্ন থাকে। উৎসবের আনন্দ, সরকারের বদান্যতা, পুরস্কার, বা কার্নিভালের ঝলকে ওই অন্ধকার চাপা দেওয়া কঠিন হয়ে যায়।
এ বারেই মহালয়ার দিন উত্তর কলকাতায় বাগবাজারের পথে যেতে যেতে মমতা দেখেন, পুজোর জন্য সাজিয়ে তোলা ফুটপাতকে আক্ষরিক অর্থেই শৌচাগার বানিয়ে এক শিশুকে বসিয়ে দিয়েছেন তার মা। দৃশ্যতই বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ পুলিশকে সতর্ক করেন, পুরসভার কাছে জানতে চান, ওখানে প্রয়োজনীয় শৌচাগার আছে কি না এবং নির্দেশ দেন, লোক যাতে তা ব্যবহার করতে বাধ্য হন সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
এটি এক বিচ্ছিন্ন উদাহরণমাত্র। মূল প্রশ্ন অন্যত্র। তা হল, মুখ্যমন্ত্রীকে এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় কেন? এ সব কি তাঁর কাজ? একেবারেই নয়। বরং এর থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়, যাঁর বা যাঁদের এগুলি দেখার কথা, তাঁরা নিজেদের সেই সব দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করেন না। সচেতনতা তৈরি হয় না মানুষের মধ্যেও। নইলে যে দৃশ্য মমতাকে ভাবায়, তা অন্যদেরও চোখে পড়ত।
বিভিন্ন পুজো মণ্ডপে অগ্নি-সুরক্ষা ও ভিড় মোকাবিলার উপযুক্ত বন্দোবস্ত যে থাকে না, এ বার কয়েকটি জায়গায় সেটিও চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাসবিহারী মোড়ের কাছে একটি নামী পুজোর প্যান্ডেলে তো রীতিমতো পা মেপে মেপে তিনি পুলিশকে দেখিয়ে দিয়েছেন, কী করা উচিত ছিল এবং করা হয়নি। এ বারেও বহু মণ্ডপে হুইলচেয়ারে বসে প্রতিমা দেখার সুবিধা পাওয়া যায়নি। এ সবই সচেতনতার নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ।
হরিদেবপুরে একটি পুজো উদ্বোধনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরিবেশ দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে করতেই মেয়রকে লক্ষ্য করে মমতা বলেছেন, গঙ্গাদূষণ রোধের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। পুজোর ভিড়ে প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার আটকাতে উদ্যোক্তা ক্লাবগুলিকে সতর্ক নজর রাখার কথাও বলতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। বলা নিষ্প্রয়োজন, সেই কথায় বিশেষ কাজ হয়নি। কারণ গুরুত্বটি হয়তো কেউই সে ভাবে বোঝেননি বা বুঝতে চাননি।
আশার কথা, বিসর্জনের গঙ্গায় এ বার দূষণ তুলনায় কম। পরিবেশ আদালতও এ নিয়ে খুশি। মুখ্যমন্ত্রীর ধমকেই হোক বা মেয়রের সচেতনতায়, যা হয়েছে তা অবশ্যই সাধুবাদের যোগ্য।
কিন্তু যা একেবারেই হয়নি, সেটি হল বিসর্জনের মিছিলে পরিত্রাহি শব্দ-তাণ্ডব নিয়ন্ত্রণ। প্রশাসন, পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ এতে একশোর মধ্যে কার্যত শূন্য পেয়েছে। বিসর্জনের শোভাযাত্রায় ডিজে বাজানো নিয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। অথচ যাবতীয় বিধি-নিষেধ হেলায় উড়িয়ে পুলিশের নাকের ডগায় একের পর এক বিসর্জনের মিছিল এ বারেও চলেছে সাউন্ড বক্সের কান ফাটানো উৎপাত ছড়িয়ে। সেই সঙ্গেই বেপরোয়া শব্দবাজি। এবং যথারীতি আইনরক্ষকেরা বধির!
শিশু-বৃদ্ধ-রোগীরা আঁতকে উঠলে কার কী আসে যায়! হাসপাতালের সামনে শব্দহীন এলাকায় কর্ণবিদারী আওয়াজ হলেই বা কী এমন অপরাধ! আপত্তি জানাতে গেলে উল্টো ‘বিপদ’-এর আশঙ্কা। অতএব নীরবতাই ‘আত্মরক্ষার’ শ্রেষ্ঠ উপায়।
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সরকার এ বার সব পুজো কমিটিকে দশ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিশ্চয় সেই টাকা যথানিয়মে ক্লাবগুলির হাতে পৌঁছেছে বা পৌঁছে যাবে। কিন্তু যে সব পুজো-উদ্যোক্তা অকুতোভয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা ও দায়বদ্ধতাকে পায়ে মাড়িয়ে যাওয়ার ঔদ্ধত্য দেখায়, সরকার তাদের প্রতি অযাচিত ‘দাক্ষিণ্য’ দেখালে সেটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে। বস্তুত, এর বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও স্তরে তেমন কোনও হেলদোলই চোখে পড়েনি! হয়তো কেউ ভাবেনই না! সব দেখে শুনে মনে হয়, কড়া হাতে এই রকম অপরাধের মোকাবিলা করার কোনও সদিচ্ছা প্রশাসকদের নেই অথবা তাঁরা নখদন্তহীন। এ জন্য কে কতটা দায়ী, তার বিচার কর্তারা করবেন। সামগ্রিক ভাবে এই দায় কিন্তু প্রশাসনের। যেটা পালন করতে তাঁরা শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ।
অনেক পাওয়ার মধ্যেও কিছু জরুরি বিষয়ে না-পাওয়াকে তাই ভুলে থাকা যায় না। অপেক্ষা, কবে মুখ্যমন্ত্রীর কানে ওই আওয়াজ ‘ধাক্কা’ দেয়। তিনি না জাগালে এই প্রশাসন বোধ হয় জাগে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy