এ পোড়া দেশে এ বড় লক্ষ্মীছাড়া সময়! ‘অচ্ছে দিন’ এসে গিয়েছে, কিন্তু হতদ্ররিদ্র মানুষের এতটুকু কৃতজ্ঞতা নেই, আলটপকা মরেই চলছে। ‘দ্য রাইট টু ফুড ক্যাম্পেন’-এর হিসেবে, গত চার বছরে অনাহারে দেশে ৫৬ জন মারা গিয়েছেন, তার মধ্যে ৪২ জন ২০১৭ ও ২০১৮ সালে।
কেন্দ্র ও প্রান্তের সামঞ্জস্যহীন বণ্টন, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, কাজের সুযোগের অভাব, সরকারি সুযোগ-সুবিধার ভারসাম্যহীনতা ইত্যাকার নানা কাঁটায় জনতা নাজেহাল। কিন্তু শুধু তো এই আমলে নয়। যুগে-যুগেই যে গরিবির গুঁতোয় উলুখাগড়ার প্রাণ অতিষ্ঠ হয়েছে, আবার তার মধ্যে থেকে খুঁজে নিয়েছে জীবনরসও, তার সাক্ষ্য ছড়িয়ে গ্রামবাংলার ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, কথা-উপাখ্যানে।
ছোটবেলায় নদিয়ার উত্তর প্রান্তে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসের সূত্রে দেখেছি, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন অল্পবয়স্ক ছেলের দল রাতে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ছড়া কেটে মুড়ি-মুড়কি-নাড়ু সংগ্রহ করত। এ এক ধরনের ‘মাগন’। যদিও ‘মাগন’ কথার মানে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ফল ও নানা খাদ্যদ্রব্য এবং পুজোর উপকরণ সংগ্রহ করা। লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, মুসলমান বালকদের মধ্যেও এই প্রথার প্রচলন রয়েছে। মুর্শিদাবাদে প্রচলিত মাগনের ছড়ার দৃষ্টান্ত এ রকম— “কাল তুলসি কাল তুলসি চিরল চিরল পাত।/ ধান দাও ধান দাও মা লক্ষ্মীর হাত।।/ ধান দিতে সিকে নড়ে।/ ঝুর জুরিয়ে টাকা পড়ে।।/ একটা টাকা পাইরে।/ বেনে বাড়ী যাইরে।।’’ তিনি লিখছেন, “লক্ষ্মীর নামে মাগন সংগ্রহ করিতে গিয়া পল্লীর মুসলমান বালকেরা এই ছড়া আবৃত্তি করে।” ও পার বাংলার ময়মনসিংহ অঞ্চলে মাগনের ছড়া আবার এ রকম— “আইলামরে অরণে।/ লক্ষ্মী দেবীর চরণে।।/ লক্ষ্মী আইনা দিলাইন বর।/ চাউল কারানি বাইর কর।।/ চাউল দিবে না দিবে কড়ি।/ তারে লইয়া লড়িদড়ি।।”
আর্যাবর্তের দেবী লক্ষ্মী কখন যে বঙ্গে এসে ঘরের মেয়েটি হয়ে গেলেন তার এক কল্পবর্ণনা আছে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ প্রবন্ধে। তিনি লিখছেন— “বাঙলা নামে দেশ, তার উত্তরে হিমাচল, দক্ষিণে সাগর। মা গঙ্গা মর্ত্ত্যে নেমে নিজের মাটিতে সেই দেশ গড়লেন।... বাঙলার লক্ষ্মী বাঙলাদেশ জুড়ে বসলেন। মাঠে মাঠে ধানের ক্ষেতে লক্ষ্মী বিরাজ করতে লাগলেন। ফলে-ফুলে দেশ আলো হ’ল। সরোবরে শতদল ফুটে উঠল। তাতে রাজহংস খেলা করতে লাগল। লোকের গোলা-ভরা ধান, গোয়াল-ভরা গরু, গাল-ভরা হাসি হ’ল। লোকে পরম সুখে বাস করতে লাগল।” এই সুখকল্পনার ছোঁয়াচ পেতে ছাপোষা নিম্নবিত্ত ঘরণীর সম্বল হল ‘লক্ষ্মীব্রত’। নতুন শস্যের উদ্যাপন। অনেক অঞ্চলে ‘খন্দ পূজা’ও বলা হয়। ‘বাংলার ব্রত’ প্রবন্ধে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন— “আশ্বিনপূর্ণিমায় যখন হৈমন্তিক শস্য আসবে, তখনকার ব্রত এটি। সন্ধ্যার সময় লক্ষ্মীপূজা। সকাল থেকে মেয়েরা ঘরগুলি আলপনায় বিচিত্র পদ্ম, লতাপাতা এঁকে সাজিয়ে তোলে। লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, লক্ষ্মীপেঁচা এবং ধানছড়া হল আলপনার প্রধান অঙ্গ।” ঘরের দরজা থেকে শুরু করে লক্ষ্মীর আসন এবং ধান-চালের গোলা পর্যন্ত ছোট-ছোট পদচিহ্ন এই আলপনার অন্যতম অনুষঙ্গ। কোথাও মূর্তিতে পুজো, কোথাও বা পটে। লোকশিল্পের সম্ভারে এই ‘লক্ষ্মীসরা’ বা ‘সরাপট’ও অনন্য শিল্পসুষমা সংযোজন করেছে।
‘কোজাগর’ মানে ‘কে জাগে?’ ভক্তের বিশ্বাস, পূর্ণিমায় রাতে দেবী ঘরে-ঘরে গিয়ে ডাক দিয়ে দেখেন, কে জেগে আছে। যে জাগ্রতক থাকে, তাকে তিনি শস্যে-সম্পদের ভরিয়ে দেন। বছরভর তার আর কোনও অন্নকষ্ট থাকে না। পুজোর পরে বাড়ির মেয়ে-বৌরা রাত জেগে লক্ষ্মী পাঁচালি পাঠ করে, ছড়া কেটে, গুণগান করে দেবীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন।
মুর্শিদাবাদের বহু জায়গায় পুজোর উপাচার হিসাবে ‘পঞ্চ অঙ্কুরীয়’ অর্থাৎ অঙ্কুরিত ছোলা, মুগ, মটর, মসুর ও কলাই দেওয়া হয়। সে সঙ্গে আবশ্যিক উপাচার তালের ‘আঁকুড়’ বা পাকা তালের আঁটির মধ্যের অংশবিশেষ। আর থাকে নারকেল, তিল, ঝুরি, ছোলা ও ক্ষীরের নাড়ু। এ ছাড়া প্রায় সব অঞ্চলে খই, মুড়ি-মুড়কিও থাকে। কোথাও-কোথাও শুধু গুড়ের মুড়কি, নাড়ু ও বাতাসা দেওয়া হয়, চিনি দিয়ে তৈরি কিছু চলে না। আঁখ আর আতা দেওয়ার রীতিও প্রচলিত। আর চাই পদ্ম ও লাল শালুক। এ ছাড়া ধানের ছড়া, কোথাও ছড়া-সহ পুরো ধানগাছ। পুরাণ অনুসারে, লক্ষ্মীর বিপ্রতীপে আছেন অলক্ষ্মী। দেবী লক্ষ্মী উর্বতার প্রতীক, মঙ্গলজনক ও শুভলক্ষণযুক্ত। অলক্ষ্মী তার বিপরীত। লক্ষ্মী পূর্ণিমা, অলক্ষ্মী ক্ষীয়মান চাঁদ। লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর এই সম্পর্ক নিয়ে একটি জনশ্রুতি রয়েছে। সংক্ষেপে গল্পটি এ রকম— এক সময়ে এক বণিককে দুই বোন লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী। বুদ্ধিমান বণিক ভেবে দেখলেন, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বিপজ্জনক। এক জনকে বেশি সুন্দরী বললে অন্য জন ক্ষুদ্ধ হবেন। বণিক সাত-পাঁচ ভেবে বললেন, লক্ষ্মী সুন্দর যখন সে গৃহে প্রবেশ করে আর অলক্ষ্মী সুন্দর যখন গৃহ ত্যাগ করে যায়। এর পরেই ‘সৌভাগ্য’ বণিকের গৃহে প্রবেশ করে, আর ‘দুর্ভাগ্য’ গৃহত্যাগ করে।
জনসমাজে অলক্ষ্মীর প্রভাব বৃদ্ধি মানেই দারিদ্র, দুর্ভাগ্য, কষ্ট, বিবাদ, হাহাকার— এমনটাই ভক্তকুলের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের কারণেই এক বিশেষ রীতির প্রচলন হয়েছে, যার নাম ‘অলক্ষ্মী বিদায়’। ‘রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর’ শীর্ষক গ্রন্থে অমলেন্দু মিত্র বর্ণনা করেছেন—“কালীপূজার রাত্রে অলক্ষ্মী বিতাড়নের ব্যবস্থা ব্যাপক ভাবে প্রচলিত আছে। ভাঁড়ার ঝাঁট দিয়ে জঞ্জাল জড়ো করা হয়। একজন ভাঙা টোকার মধ্যে সেই জঞ্জালের কিয়দংশ নিয়ে একটি কাঠি দিয়ে টোকাটিকে পিটতে নিকটস্থ ধান মাঠের দিকে যায়। মুখে বলতে থাকে, ‘অলক্ষ্মী যাও ছারে খারে’।”
মধ্যযুগের সাহিত্যেও রয়েছে এই অলক্ষ্মী বিদায়ের প্রসঙ্গ। রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্রের রচনা— “অলক্ষ্মীর বিদায় করিয়া রামাগণ। / আসিয়া গঙ্গার ঘাটে দিল দরশন।।” আবার ‘লৌকিক শব্দকোষ’ গ্রন্থে কামিনীকুমার রায় জানিয়েছেন— “দীপাবলীর রাত্রিতে (সন্ধায়) বাংলার বহু স্থানে, বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গে, যশোহর, খুলনা জেলায় গোবর জল দিয়া অলক্ষ্মীর এবং পিটুলি দিয়া লক্ষ্মী, কুবের ও নারায়ণের মূর্ত্তি গড়া হয়। অলক্ষ্মীর মূর্ত্তিটি ঘরের বাহিরে কলার খোলে বসাইয়া, প্রথমে তাঁহার পূজা ও ধ্যান করা হয়। ধ্যানে অলক্ষ্মী কৃষ্ণবর্ণা, ক্রোধী, এলোকেশী; তাঁহার একহাতে কুলা, অন্যহাতে ঝাঁটা। পূজান্তে ছেলে মেয়েরা কূলা পিটাইতে পিটাইতে তাঁহার মূর্ত্তিটিকে মাথায় লইয়া যায় এবং ফেলিয়া দিয়া বলে, ‘লক্ষ্মী ঘরে আয়, অলক্ষ্মী দূর হ’।”
আবহমানের এই ছড়া বোধহয় ফের আওড়ানোর সময় হয়েছে। পূর্ণ চাঁদের মায়া ছেড়ে, ঘোর অমানিশায়!
(উদ্ধৃতির মধ্যে বানান অপরিবর্তিত)
সহযোগী অধ্যাপক, লোকসংস্কৃতি বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy