প্রতীকী ছবি
পরীক্ষার মরসুম চলিতেছে। ইদানীং নম্বরও মিলিতেছে ঝুলি ভরিয়া। এমনকি যে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিষয়ে কিছুকাল পূর্বে ষাট শতাংশ নম্বর শিক্ষার্থীর নিকট স্বপ্নসম ছিল, তাহাতেও এখন নম্বরের ছড়াছড়ি। আশি, পঁচাশি, এমনকি নব্বই শতাংশও ভ্রুকুঞ্চনের কারণ হয় না। কিন্তু নম্বর তো মিলিল, শিক্ষা মিলিল কি? শিক্ষার্থীর মনোজগৎ বিকাশের সুযোগ পাইল কি? “রবীন্দ্রনাথ জালালাবাদে বহু মানুষকে হত্যা করিয়াছিলেন। তাই তাঁহার ‘নাইট’ উপাধি কাড়িয়া লওয়া হইয়াছিল।” এক ছাত্রীর খাতায় এই তথ্য আবিষ্কার করিয়া দিদিমণি বাক্রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। রবি ঠাকুরকে ‘গণহত্যাকারী’ প্রতিপন্ন করিয়া তাঁহার ‘নাইট’ উপাধি কাড়িয়া লইয়া ছাত্রী তাঁহাকে এমন আঘাত দিয়াছিল যে তিনি সামলাইতে পারেন নাই। ছাত্রজীবনের শেষপ্রান্তে আসিয়া এক ছাত্র ইতিহাসে সম্রাট কণিষ্কের অবদান প্রসঙ্গে লিখিতে গিয়া উপসংহার টানিয়াছিল, ‘‘মাথা না থাকিতেই কণিষ্ক এত কাজ করিয়াছেন। মাথা থাকিলে না জানি আর কী কী করিতেন।” ‘কবন্ধ’ সম্রাট অতীতেই বিলীন হইয়াছেন, তাঁহাকে লইয়া চিন্তা নাই। কিন্তু মস্তিষ্কবান ছাত্রের যুক্তিবোধ লইয়া এই জাতি কী করিবে, তাহা চিন্তার বিষয় বটে।
পরীক্ষার উত্তরপত্রে এ জাতীয় অদ্ভুত তথ্যাদি নিরীক্ষণ করিয়া পরীক্ষকগণ হয়তো হতবাক হন, ক্রুদ্ধ হন বা পরিহাস করেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীর চিন্তাচেতনার জগতে এমন ভয়ানক অসামঞ্জস্য কেবল এই রূপ হাস্যকরতায় আটকাইয়া নাই। শ্রেণিকক্ষে ‘বলাই’ গল্প পাঠ করিতে গিয়া গাছের সহিত বালকের সখ্য আজকের শিক্ষার্থীকে এমন বিস্মিত করে যে তাহা যন্ত্রণাদায়ক। যন্ত্রণাময় এই সত্য যে, কল্পনাশক্তি পোক্ত না হইলে সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান কিছুরই চর্চা সম্পূর্ণ হয় না। কাজেই পরিহাস নহে, প্রয়োজন সতর্ক হওয়া। সংক্ষিপ্ত, অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের তাড়নায় বর্ণনাত্মক বা বিশ্লেষণাত্মক প্রশ্ন ক্রমশ পিছু হটিতেছে। পড়িবার ধরন পাল্টাইতেছে। অর্থ না বুঝিয়া মুখস্থ করার চল এই দেশে বরাবরই। এখন অর্থ বুঝার কাজটিই বোকামি প্রতিপন্ন হইয়াছে, বরং অর্থবোধ-বিরহিত মুখস্থবিদ্যাই অধিক নম্বরে পৌঁছাইবার প্রকৃত সূত্র। সুতরাং, আজিকার শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে না। প্রথম প্রজন্মে শিক্ষার্থীদের কথা আলাদা করিয়া বলিবার। তাহাদের গৃহে সংবাদপত্র, গল্পের বই পাঠের সুযোগ ঘটে না। অন্য দিকে সম্পন্ন গৃহস্থের সন্তান কেরিয়ারের চাপে পাঠ্যপুস্তকের বাহিরে যায় না। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যালয় এবং শিক্ষকসমাজের দায়িত্ব বাড়িবার কথা। পাঠ্যপুস্তকের পঙ্ক্তির বাহিরে যে সুবিপুল এবং বিচিত্র বিশ্ব পড়িয়া রহিল, শিক্ষার্থী যাহাতে সেই দিকে ধাবিত হয়, শিক্ষক অরফিউসের মতো তাহার পথ না দেখাইলে পথটি অধরাই থাকিয়া যাইবে।
সন্দেহ হয়, শিক্ষককুলও সেই কাজে প্রস্তুত নহেন। তাঁহারা হয়তো শিক্ষাদানের উপযোগী পরিবেশও যথার্থ ভাবে পাইতেছেন না। কিন্তু যুক্তি যেমনই হউক, সঙ্কট সামলাইবার উপায় কী? শিক্ষা মন্ত্রক, বিদ্যালয়, অভিভাবক সকলেই কি একটু ভাবিবেন? কিছু করিবেন? শিক্ষার্থীর মনোজগতের সত্যকারের বিকাশের পথটি কী রকম, তাহা ভাবিবেন? ভবিষ্যতের নাগরিকগণ কেবল ‘সফল’ হইবার লক্ষ্যে ছুটিলে কিন্তু সমাজ বা জাতি কোনওটিই বাঁচিবে না। তাহাদের সফল করিবার সঙ্গে তাহাদের ‘মানুষ’ও করা যায় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy