সকাল সকাল কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। ফ্ল্যাটের বারান্দায় যেন বেশ একটা সাজো-সাজো রব উঠেছে দু’টো পাখির মধ্যে। চোখ কচলিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি, উপরের কংক্রিটের সেলফের উপর দু’টো চড়ুই ছোট ছোট গাছের সরু সরু ডাল আর ঘাস নিয়ে এসে বাসা বানাচ্ছে। এক দৃষ্টে কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকা গেল। মনটা বেশ প্রফুল্ল হল! অনেক দিন পরে আবার চড়ুইরা বাসা বাঁধল ওখানে। প্রায় ছ’সাত বছর পর। এর পর গত দু’মাস ধরে একের পর এক চড়ুই দম্পতি ওই জায়গায় এসে বাসা বানায়, ডিম পাড়ে। ডিম ফোটা ছানাকে বড় করে। তারপর চলে যায়। এই ভাবে তাদের বংশবৃদ্ধি হতে থাকে।
চড়ুই ছটফটে পাখি। সব সময় ব্যস্ত। সাধারণত এরা মানুষের আশেপাশে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। ইতিহাস বলে, চড়ুই মানবসভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের সান্নিধ্যেই ঘোরাফেরা করত। বিশ্বের যে কোনও লোকালয়ের আশপাশেই এদের দেখা যায়। এরা মানুষের বাড়ির আশপাশে বেশি থাকতে পছন্দ করে বলেই এদের ‘হাউস স্প্যারো’ বা গৃহস্থালির চড়ুই বলা হয়। মোটামুটি ভাবে শুকনো ঘাসপাতা, খড়কুটো দিয়ে চড়ুই বাসা বাঁধে। শস্যদানা ছোট ছোট পোকা মাকড় ইত্যাদি এদের খাদ্য। সাধারণত বাড়ির কড়িকাঠে বা কার্নিশে এরা বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ার জন্য। পৃথিবীতে মোট ৪৮ প্রজাতির চড়ুই দেখতে পাওয়া যায়। জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন, এদের আদি নিবাস ইউরেশিয়া অঞ্চল এবং আফ্রিকা মহাদেশে ছিল। তারপর এরা ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলায় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে চড়ুই দেখতে পাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। যেহেতু এই পাখি মানুষের সঙ্গে থাকতে অভ্যস্ত, তাই যে কোনও গৃহস্থ পরিবারের বাড়িতে ঘুলঘুলির ফাঁকে এদের দেখতে পাওয়া যায়। পুরুষ চড়ুই দেখতে উজ্জ্বল কালো, বাদামি ও ধূসর চেহারার আর স্ত্রী চড়ুই হালকা বাদামি ও ধূসর রঙে মেশানো।
কিন্তু সেই আটের দশকের শেষ থেকেই বিশ্ব জুড়ে যখন প্রযুক্তির উন্নতি দ্রুত গতিতে শুরু হল, তখন থেকেই চড়ুই পাখিরও সংখ্যা ক্রমাগত কমতে শুরু করল। বর্তমানে সারা ভারতেই চড়ুই পাখির সংখ্যা কমে এসেছে। এবার আসা যাক উত্তরবঙ্গে। এখানে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটলেও বছর দশেক আগে যে সংখ্যায় চড়ুই দেখা যেত, বর্তমানে তা আর দেখা যাচ্ছে না। ক্রমশ কমে যাচ্ছে ওদের সংখ্যা। গত ১০-১৫ বছর ধরে যে ভাবে বহুতল বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তরবঙ্গের মফস্সল এবং প্রান্তিক অঞ্চলে, তাতে পুরনো বাড়ির সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। সেই কারণে সেই সব বাড়ির ঘুলঘুলি আর দেখতে পাওয়া যায় না। তার জায়গা দখল করেছে ফ্ল্যাট বাড়ি। সেখানে চড়ুইয়ের পক্ষে বাসা বানানো খুবই কষ্টকর কাজ। তাই চড়ুইয়ের বংশ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। যেটা খুবই দুর্ভাগ্যের।
চার দশক আগে যে ভাবেম চড়ুই পাখি দেখা যেত বিভিন্ন জায়গায়, তেমন আর দেখা যায় না বর্তমানে। এর কারণ, আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার প্রবল বিস্তার ঘটেছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়। একদিকে বহুতলের দাপট, অন্যদিকে উন্নয়নের নামে বৃক্ষনিধন। আর তার সঙ্গে গত দু’দশক ধরে মোবাইল ফোনের বিস্তারের জন্যে যত্রতত্র মোবাইল টাওয়ার তৈরি করা। শহর বা গ্রামীণ এলাকা, সর্বত্র এই একই ছবি। মোবাইল টাওয়ারের তীব্র চৌম্বক বিকিরণ শুধু চড়ুইয়েরই নয়, আরও বিভিন্ন পাখিকে বিপন্ন করে তুলেছে। যা আশঙ্কাজনক ভাবে উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে অনেকাংশেই নষ্ট করছে। উত্তরের সকাল এখন আর সেই ভাবে চড়ুইপাখির কিচিরমিচিরে জেগে ওঠে না। কৃষিক্ষেত্রে জমিতে যে পরিমাণ কীটনাশক এখন দেওয়া হয়, তাতে চড়ুইয়ের মতো ছোট পাখিদের খাদ্যে রীতিমতো বিষ ঢুকে যাচ্ছে। যার ফলে তাদের মৃত্যু ঘটছে, বংশবৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই প্রতিকূল যান্ত্রিক পরিবেশে চড়ুই পাখিদের বেঁচে থাকাটাই সমস্যা হয়ে উঠেছে।
বাংলা সাহিত্যে চড়ুই পাখি নিয়ে কবিকুল অনেক ছড়া-কবিতা লিখেছেন। রবীন্দ্র-নজরুল থেকে তারাপদ রায় এবং আরও অনেকে। কিন্তু আদতে সেই চড়ুইপাখি আজ চূড়ান্ত ভাবে বিপন্ন। এখন থেকেই সতর্ক না হয়ে উঠলে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধাপে ধাপে হারিয়ে যাবে বিভিন্ন বন্যপ্রাণ, পাখি। ইতিহাসের পাতায় যে ভাবে বিলুপ্ত ডোডো পাখির কথা শোনা যায়, হয়তো কোনও একদিন ইতিহাসে সে ভাবেই লেখা থাকবে চড়ুইপাখির কথাও! এ কখনই কাম্য নয়। তাতে উত্তরবঙ্গের চিরপরিচিত প্রাকৃতিক মাধুর্যই শুধু বিনষ্ট হবে না, একই সঙ্গে ভেঙে পড়বে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও।
এ পৃথিবী শুধু যে মানুষের নয়, চড়ুইয়েরও, বন্যপ্রাণেরও, তা মানুষ বুঝে উঠবে কবে!
(লেখক বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy