‘Wherever I am, Santiniketan is always in my heart.’
— Mahatma Gandhi
সালটা ১৯২৫। মে মাস। চরকার প্রচারে মহাত্মা গাঁধী বেরিয়েছেন দেশভ্রমণে। মাস খানেক হল তিনি এসে রয়েছেন বাংলায়। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত-পার্থক্য সুবিদিত। কবি চরকায় আস্থা রাখতে পারেননি। কথাটা তাঁর অজানা নয়। তাই সরাসরি এক বার তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার। যদি তাঁকে পক্ষে আনা যায়! দেখা করার ইচ্ছে জানিয়ে সে জন্য নিজেই চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে।
মত-বিরোধের আশঙ্কা ছিলই। তবুও যখন শুনলেন, মহাত্মা স্বয়ং তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান, সে সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে কবিও তাঁকে একখানা পত্র পাঠালেন। অনুরোধ, তিনি যেন একবারটি শান্তিনিকেতনে আসেন। নেপালচন্দ্র রায়ের উপর দায়িত্ব পড়ল চিঠি পাঠানোর।
২৯ মে রাতে গাঁধী পৌঁছলেন বোলপুর। সঙ্গে সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, হেমপ্রভা দেবী, মহাদেব দেশাই আর প্যারেলাল নায়ার। স্টেশনে তাঁদের নিতে এলেন এন্ড্রুজ। সেখান থেকে মোটরে করে শান্তিনিকেতনে। এর আগে গাঁধীজি শেষ বার বোলপুর এসেছিলেন ১৯২০ সালে। দীর্ঘ দিন পরে আবার কবির ডেরায় মহাত্মা। তাই আয়োজনের কোনও ত্রুটি রাখা হয়নি। পত্র-পুষ্পে সাজানো হয়েছে শান্তিনিকেতনের মূল বাড়ির দোতলায় মহাত্মার থাকার ঘরখানি।
ফুলে ফুলে ঢাকা তা যেন ঠিক বাসর ঘর। ঘরে ঢুকেই বিহ্বল গাঁধী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাকে নববধূর ঘরে কেন আনলেন?’ স্মিত হেসে কবি সপ্রতিভ উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমাদের হৃদয়ের চিরন্তন রাণী শান্তিনিকেতন আপনাকে অভিবাদন জানায়।’ প্রত্যুত্তরে গাঁধী বললেন, ‘আমার মতো দন্তহীন নিঃস্ব লোকেদের দিকে দ্বিতীয় বার ফিরে দেখতে সে মোটেই ভ্রুক্ষেপ করবে না।’ ‘শান্তিনিকেতন রাণী সত্যকে ভালোবেসেছে এবং দীর্ঘ সময় ধরে তাঁকে অকপটে পূজা করেছে।’—স্পষ্ট জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
সুতির নকশা কাটা পাতলা কার্পেট বিছানো মেঝে। তার এক প্রান্তে রাখা গদি। গাঁধী সেখানে গিয়ে বসলেন। উল্টো দিকে কবি। উভয়ের মধ্যে হালকা কথা-বার্তা হল। তার পরে যে যাঁর মতো চলে গেলেন। সে দিনের মতো এটুকুই।
পরের দিন ছিল শনিবার। সকালে উঠেই গাঁধীজি ছুটলেন দ্বিজেন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। কবির বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ— শান্তিনিকেতনে মহাত্মার সর্বোত্তম সমর্থক। প্রাচীন এই দার্শনিক ও গাঁধীজির মধ্যে সে দিন যে আলাপ চলেছিল, তা অতি মর্মস্পর্শী। গাঁধীজিকে দেখে ‘বড়দাদা’-র স্নেহ যেন বাঁধনহারা হয়ে উঠল। দ্বিজেন্দ্রনাথের সেই অন্তহীন স্নেহ মহাত্মাকেও আপ্লুত করেছিল। বোলপুর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে পরবর্তীকালে তার উল্লেখ করতে ভোলেননি তিনি।
বস্তুত দ্বিজেন্দ্রনাথের হৃদয়ে গাঁধীজির প্রতি ছিল পুত্রস্নেহের আবেশ। আর সেই আবেশেই গাঁধীজির যাবতীয় দোষ-ত্রুটিকে ঠেলে দিয়েছিলেন তিনি দৃষ্টি পরিসরের বাইরে। তাঁর চোখে মহাত্মা হয়ে উঠেছিলেন অভ্রান্ত আর তাঁর যাবতীয় কর্মকাণ্ড ত্রুটিহীন, নির্ভুল। অসহযোগ কর্মসূচি, চরকা, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ— সবই দ্বিজেন্দ্রনাথের মন জয় করে নিয়েছিল। স্বরাজের আদর্শকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। গাঁধীজি লিখেছেন, ‘পুত্র-স্নেহে অন্ধ পিতা যেমন ছেলের কোনও দোষ-ত্রুটি দেখতে পান না, তেমনি তিনিও আমার কোনও ত্রুটি দেখতে চান না। তাঁর বিমুগ্ধ ভাব ও ভালোবাসাই আমার দৃষ্টিতে ধরা দেয়, যা হওয়ার চেষ্টা করি কেবল। তাঁর বয়স আশি ছাড়িয়েছে। তবু তিনি জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় সম্পর্কে অবহিত। ভারতে কোথায় কী চলছে তার খবরও তাঁর নখদর্পনে।’
হাতে ফুলের মালা নিয়ে বড় এক চেয়ারে বসেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। কাছে গিয়ে গাঁধীজি তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই তা পরিয়ে দিলেন তাঁর গলায়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে মহাত্মার সঙ্গে আবার যে তাঁর দেখা হবে বোধহয় তিনি তা ভাবতেও পারেননি। কিন্তু সত্যিই সেই গাঁধীজি আজ সশরীরে তাঁর সামনে। কোনও কথা নয়। কেবল অবাক হয়ে চেয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। নীরবতা ভাঙলেন গাঁধীজিই, ‘আমি এখানে মাঝে মধ্যেই আসতে চাই। কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারি না। আপনি এ বার থেকে যখনই বলবেন, তখনই আসব।’
আনন্দে বিহ্বল বড়দাদার মুখ থেকে কথা সরছিল না। কোনও মতে বললেন, ‘আমি যে মহাত্মার আশীর্বাদ পেলাম, তা-ই যথেষ্ট। আমার হৃদয় আজ পূর্ণ। আমি বাকরুদ্ধ।’ কথার মাঝেই তাঁকে থামিয়ে দিলেন গাঁধীজি, ‘আমি জানি আপনি কী বলতে চান।’
এর পরে দু’জনেই চুপচাপ। ধীরে ধীরে মুখ খুললেন কবির অগ্রজ, ‘আমি জানি, তুমি জয়ী হবে। তুমি কী দিয়ে যে গড়া তা-ও আমার জানা। শক্তিশালী তুমি। আমি দুর্বল!’
‘সে শুধু শরীরে। মনের দিক থেকে নয়। এমনকি শরীরেও নয়।’ জবাব দিলেন গাঁধীজি। দ্বিজেন্দ্রনাথের মুখে তখন হাসি, ‘মনে হচ্ছে, আজ যেন আমার পুনর্জন্ম হল।’
এতক্ষণ গাঁধীজি চেয়ারে বসেছিলেন। এ বার বড়দাদার পায়ের কাছে এসে বসলেন। ঠিক যেমন পঁয়ত্রিশ বছর আগে দাদাভাই নৌরজির পায়ের কাছে গিয়ে বসেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের আশীর্বাদ এ বার সত্যিই যেন ঝরনা হয়ে ঝরে পড়তে লাগল তাঁর উপর। হৃদয়ের সেই ঢেউ যেন কিছুতেই বাঁধ মানে না। ‘হিন্দু-মুসলমানের জন্য তুমি যা করছ, তা সত্যিই মহৎ।’ অতঃপর শুদ্র ও ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধেও কিছু বললেন। যার সবটা ঠিক বোঝা গেল না। তবে গাঁধীজির পদমূলে উপবেশন তাঁকে যেন স্বস্তি দিচ্ছিল না। বললেন—‘তুমি চেয়ারে বসছ না কেন? চেয়ারে উঠে বোসো।’
—‘না আমি ঠিকই আছি। অন্যের চোখে আমি যাই হই না কেন, এখানে আমার সমস্ত মহত্ব দূরে ঠেলে আপনার সামনে নত থাকব।’
এ বার ইয়ং ইন্ডিয়ার প্রসঙ্গ উঠল।
—‘লোকজন তোমাকে উদ্ভট সব প্রশ্ন করে। কেউ বা তোমাকে খোঁচায়। তুমিও সে সবের উত্তর দাও। সন্ন্যাসীর মতো তুমি। কী ভাবে এ সব সামলাও। এ সবই ইংরেজি শিক্ষার ফল। তোমার ধৈর্য বটে!’
গাঁধীজি যোগ করলেন— ‘এমনকি নির্বোধ প্রশ্নেরও ভাল উত্তর দিয়ে থাকি। কখনও তো আবার সুযোগ পেলে এমন কিছু লিখি যা ইতিপূর্বে কখনও লেখা হয়ে ওঠেনি। কখনও ওই সব সুচিন্তিত বা নির্বোধ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু আমি অভিযোগ করতে পারি না।...’
শিক্ষক, মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy