মেট্রোরেল।
যে বছর জুরাসিক পার্ক এসেছিল, জ্ঞানত সে বছরই প্রথম মেট্রো রেলে চড়েছিলাম। স্রেফ একটু আনন্দ করতে, মেলায় টয়ট্রেন চাপার মতো। তখন না পড়ত এত গরম, না হত কামরাগুলোয় এমন ভিড়। সেই শ্যামবাজার হতে যে ট্রেনটায় উঠলাম, তাতে বোধ করি এসপ্ল্যানেড বা পার্ক স্ট্রিট পর্যন্ত যাওয়া যেত।
আহা, কত অন্য রকম ছিল তখনকার রেকগুলো। দূরপাল্লার বাসের কায়দায় দু’পাশে আড়াআড়ি করে হেলান দেওয়া ডাবল সিট! কাচের ধারে তাতেই বসে শোঁ-শোঁ করে আপডাউন শেষে, এক লাফে বাড়ি। সত্যিই এক লাফে! মেট্রো স্টেশন থেকে গুনে গুনে দশ পা গেলেই আমার পুরনো বাড়ির নকশিকাটা দরোয়াজা। এমন লোভাতুর লোকেশন যে কবে থেকে সকলের হুসহাস, ‘এ যে দেখি বাসগুলো তোদের ড্রয়িংরুমেই দাঁড়ায়।’ ‘মাই গড! মেট্রো আগের স্টেশন ছাড়লে তবে তুই বাড়ি থেকে বেরোস বুঝি!’ শুনে হৃদয় আহ্লাদে ময়ূর নাচত। মনের মধ্যে আগেকার দূরদর্শনের গানের রিপ্লে চলত। সেই যেখানে সুচিত্রা মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, অরুণলালরা সংযত নাগরিক পদক্ষেপে ধীর সারণিতে মেট্রো থেকে বেরোচ্ছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘তোমার সুর মোদের সুর সৃষ্টি করুক ঐক্যসুর’ বাজছে; কলকাতার পোস্টার-রূপে মেট্রো রেলওয়ের সাংস্কৃতিক, শিষ্ট ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশকে তুলে ধরা হচ্ছে। কল্পনায় সেই কালজয়ীদের পিছু পিছু আমিও মেট্রো থেকে বার হচ্ছি। বার বার। লাগাতার। আর বাজছে, সৃষ্টি হো-ও-ক ঐকতান…
প্রাইমারি টু ইউনিভার্সিটি এই সুরসায়রেই ভেসেছিলাম। ক্লাস টেনে ডানা গজাল, তার পালে হাওয়া জোগাল এই ঘরের পাশে মেট্রো রেল। তার কল্যাণেই বাড়িতে বলতাম, জাস্ট হাতিবাগান যাচ্ছি। বলে, বন্ধুরা মিলে দশ মিনিটে ধাঁই করে এসপ্লানেড গিয়ে শপিং করতাম। গোটা বিষয়টা এত দ্রুততা ও মসৃণতার সঙ্গে সমাধা হত যে এক কিলোমিটারের মধ্যে আছি বলে যে ছয় কিলোমিটার দূরে নেচে এলাম, কেউ সন্দেহতক করত না!
তার পরে ইউনিভার্সিটি-জীবনে মেট্রো তো আমার মস্তকে আদর্শ ছাত্রীর উষ্ণীষ বেঁধে দিল। সকাল দশটার ক্লাস। বাকিরা কোনওক্রমে হাই তুলতে তুলতে, নিজেদের টেনেহিঁচড়ে হাজির হয়ে দেখত— প্রথম বেঞ্চ আলো করে বসে আছি আমি! প্রফেসররা আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলতেন, ‘এই যে, একে দেখে শেখো। ও যদি সেই বাগবাজার থেকে রোজ সময়ের আগে যাদবপুর আসতে পারে তোমরা পারবে না কেন?’ ‘আকাশভাঙা বৃষ্টিতেও যদি অদ্দূর থেকে ঠিক এসে যায়, তোমরা অ্যাবসেন্ট হবে কেন?’ এক দিন এক সহপাঠী আমার বাড়ি এল, তার পর এই মারে তো সেই মারে। ‘এই জন্য এত হিরোপন্তি! বাড়ি থেকে পা বাড়ালেই মেট্রো!’ আমি হাজার ওয়াটের নির্লিপ্ততায় হেসেছিলাম। বিশ্বনাগরিকত্বের স্বাদ যে পেয়েছে তার কাছে এ তো তুশ্চু! যে বাহনগুণে তিলোত্তমা আজ লন্ডন, প্যারিস, টোকিয়োর মতো সম্পদে-স্বাচ্ছন্দ্যে প্রথম সারির ইন্দ্রপুরীর সঙ্গে সমানে-সমানে, সেই মেট্রো রেলের যত্নেই আমার এতাদৃশ এলেম! ধন্য আমি। ধন্য মেট্রো। অহো ভাগ্য।
সেই সময়ই বিধাতাপুরুষ অথবা মেট্রোদেবী কেউ না কেউ অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। তাই এমন ঘটনার দিনকয়েকের মধ্যেই কলকাতাবাসী মেট্রোকে মাথায় তুলল। পাতাল রেলের খুব বাড় বাড়ল। মেট্রো সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে শহরের উপর দিয়েও যেতে লাগল। তার দিকে দিকে সম্প্রসারণ হল এই আর কী! তত দিনে অবশ্য আমার সঙ্গে মেট্রোর জন্মগত সম্পর্কের ইতি হয়ে কর্মগত সম্পর্কের সূচনা হয়েছে। অর্থাৎ, জীবিকার প্রয়োজনে অফিসে ও অফিশিয়াল কারণে হেথা-হোথা যেতে মেট্রোই ভরসা। অতএব খুলল পাতালের দরজা। এবং দাঁত কিড়মিড়িয়ে দেখা দিল কর্মফল।
তারই দোষে বুঝি সাধের মেট্রো এমনধারা শুকিয়ে গেল, বুড়িয়ে গেল, পিছিয়ে গেল, ফুরিয়ে গেল। ক’বছর অন্তরই এ দিক-ও দিক দশটা করে স্টেশন গজায়, যাত্রিসংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্ল্যাটফর্ম উপচে পড়ে, তবু ট্রেনের সংখ্যা যে-কে-সেই। আমি জুলজুলিয়ে দেখি, এক কালে যে মেট্রো ঘড়ি ধরে টগবগে নব্যযুবকের ন্যায় ঝড়বেগে স্টেশনে ঢুকত, আজ বছর পঁয়ত্রিশেই তার হালে কাকচিল কাঁদে! এখন সে আসে বিরাট সংসার-ভারাক্রান্ত রুগ্ণ বৃদ্ধের মতো। ধুঁকতে ধুঁকতে। এই রাবণের গুষ্টি সে আর টানতে পারছে না, গত তিন দশকে তার রোজগার এক বিন্দুও বাড়েনি (পড়ুন ভাড়া), অথচ তার বোঝা ভাগে নতুন কেউ এগিয়েও আসছে না!
তার সমযাতনায় ঝাপসা চোখ মুছতেই প্রবল ঝটকা লাগে। ওরে বাবা, চার পাশে কারা? এ যে কাতারে কাতারে হাল্লার সেনা চলেছে সমরে। কাউকে দেখে লাগে ভয়। চুল সুমো পালোয়ানের মতো টঙে, পিঠে অস্ত্রভাণ্ডারের থেকেও ঢাউস একটি ব্যাগ, হাতে তরোয়ালের চাইতেও উঁচিয়ে আছে খুঁচিয়ে দিতে সদা-উন্মুখ একটি ছাতা। এই সমরসজ্জায় সমাগত জনতাকে কচুকাটা করে তিনি সেঁধিয়ে যাচ্ছেন মেট্রোদানবের গহ্বরে। কেউ ‘আমাকে টাচ করবেন না’ উক্তিটিকে মোক্ষ মেনেছেন। তাঁদের উচ্চভুরু, তুচ্ছচাহনিতে স্পষ্ট তিনি গণপরিবহণটিকে একান্ত ব্যক্তিগত চারচাকা গণ্য করেন। কয়েক জন ধাক্কা সিং। তাঁরা ঠেলতে ঠেলতে এক দিন চাঁদে পৌঁছে যাওয়ার ট্যালেন্ট ধরেন। ভিড় বাড়লেই তার মধ্যে ড্যাবাচোখো কুমিরের মতো ভুস করে ভেসে ওঠেন এক দল লড়াইখ্যাপা। কানে তার গোঁজা ক’জনা টিকটিকির মতো দরজার ধারে সেঁটে থাকেন। স্টেশনে উঠতে নামতে তাঁদের ঘাড়ে-কোমরে আছাড় খেয়ে মানুষজন শাপশাপান্ত করেই চলেন। সে সব আশ্চর্য নিস্পৃহতায় উড়িয়ে তাঁরা দ্বাররক্ষার কর্তব্যে অটল, অচল! তাঁদের থেকেই নির্বিকারত্বের সারকথা আত্মস্থ করে, আমিও এক সুদিনে বসতে জায়গা পেয়েই চোখ বুজে ঘুমোবার ভান করছিলাম। কেমন যেন আঁচ হতে আধখানা চোখ কুঁচকে দেখি, সামনে এক সত্তরের বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন। আর সঙ্গীকে বলছেন, ‘হ্যাঁ রে, ওঠার স্টেশনেও কি এসকালেটর খারাপ?’ সেই দিনই, সেই যে মাথাটা এক কালে মেট্রোকৃপায় উঁচু আরও উঁচুতে উঠেছিল, সেটি মেট্রোমায়াতেই লজ্জায় একেবারে নিচু হয়ে গেল। যাত্রিসুরক্ষায় বসানো উত্তল আরশিতে নিজেকে দেখে আঁতকে উঠলাম। আমিও যে সেই হাল্লার সেনার এক জন হয়ে গিয়েছি। মেট্রোকে এত দিন সুইসাইড করার জায়গা বলে চিনতাম। কিন্তু, সেখানে কি মানবিক বৃত্তিগুলোও প্রতি মুহূর্তে গরম ইঞ্জিনের সামনে মরণঝাঁপ দেয়?
এ দিকে অনেক পরে দৌড় শুরু করেও কলকাতার থেকে সহস্র যোজন এগিয়ে যায় দিল্লি, হায়দরাবাদ, লখনউ এমনকি সে দিনের কোচি মেট্রোও। লোকে বলেছে, সেখানে নাকি রেকের সংখ্যা এখানকার থেকে পনেরো গুণ বেশি। এক মেট্রো যেতে না যেতেই পরেরটা এসে ওয়েট করে। আর এখানে দিনে ক’টা মেট্রো পর পর সময় মেনে আসে, কবে যে রেকে-দরজায় বিভ্রাট হয় না— গোনা যায়। অতএব, তুলনা বৃথা। আমি বলি, তথ্য-যুক্তি জানিনে মা, জাতিতে যাত্রিণী। এই শয়তানের শহর, নারী-নির্যাতনের কালভূমে নিজের মান বাঁচিয়ে মেট্রো চড়াও কি কম যন্ত্রণা! তখনই বিজ্ঞজনে বিধান দেন, যেখানে প্রাণ বাঁচানোই দায়, সেখানে আত্মসম্মান বাঁচানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তাঁদের কথা সত্যি করে মেট্রো প্রথমে আগুন ওগড়ায়, সুড়ঙ্গে হঠাৎ থেমে এক-ট্রেন মানুষের দম চেপে ধরে। তার পর, অসহায়ের আর্ত মুঠি থেকে তার প্রাণটি ছেনে নিথর দেহখানি ছুড়ে দেয় বিদ্যুজ্জিহ্বায়। মেট্রোবনে শুরু হয় নতুন অধ্যায়।
আজ এই মনে আর কোনও গান বাজে না, হৃদয়ে ময়ূর নাচে না। মেট্রোর নামেই অদৃষ্টে বাঘ-সিংহ গজরায়। কী জানি কী হয়! মৃত্যুদণ্ড, না কি কারাবাস! ওই তো, কর্তৃপক্ষের হুকুম, মেট্রোর দরজা ঘাড়ে পড়লে তা যাত্রীর দোষ। এতে তিনি যদি না মরেন, জরিমানা করা হবে। জেলেও পোরা হতে পারে। শুনে কোনও প্রশ্ন তুলি না। কারণ, এত সয়েও যে নিরুপায় আমি ও আমরা, লক্ষ-লক্ষ সজল কাঞ্জিলাল আবার থিকথিক করি মেট্রো-গুহার গেটে। বিকল্প যান নেই। নিজের চাকা ঘোরাবার পকেটীয় রেস্ত নেই। আছে যানজটে ভরা কুম্ভীপাক রাস্তা এবং সময় নামক এক অসীম মহার্ঘকে রক্ষণের অনন্ত প্রয়োজন। পালাবার পথ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy