দমন: বিক্ষোভরত কৃষকদের ঠেকাতে বিজেপি-শাসিত হরিয়ানার সীমান্তে জলকামান ব্যবহার করছে পুলিশ। অম্বালা, ২৬ নভেম্বর। পিটিআই
মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে’— কথাটা শুনতে শুনতে কত লোকে বালক থেকে প্রৌঢ় হয়ে গেল, কিন্তু মানুষ কেন বিভ্রান্ত হয়, তার অনুসন্ধান নিয়ে এ রাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা যে খুব উদ্বিগ্ন, এমনটা বলা কঠিন। এই মানুষই তো এক দিন পরম আস্থায় বামপন্থীদের সঙ্গে আত্মস্থ হয়েছিল, এক দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছিল। কী কারণে সে বাম থেকে সরে তৃণমূলের ঘরে গেল, আর কেনই বা সে আজ তৃণমূলের উপর অনাস্থা দেখাচ্ছে?
সাধারণ মানুষের সঙ্গত প্রশ্ন: “বিজেপি যদি খুব অত্যাচারী দলই হয়, তা হলে লোকে এই দলটাকে ভোট দিচ্ছে কেন?” নেতারা বলবেন, জনগণ মোহগ্রস্ত। তা, মোহ কাটানোর দায় কি শুধু জনগণের? নেতাদের কি কোনও দায় নেই? বাস্তবিক, বাম বা তৃণমূল, অথবা কংগ্রেস— কোনও নেতার কাছ থেকেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। তাঁরা গত পাঁচ বছর ধরে বিজেপির হুঙ্কার শুনে আসছেন, অথচ, তাকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করার জন্য কোনও বাস্তব পদক্ষেপ করেছেন, এমন মনে করতে পারা কঠিন। মানুষ কেন বিজেপির দিকে ঝুঁকছে, বাংলার নেতারা যদি সেটাই জানবার ইচ্ছা করেন, তা হলেও খানিক কাজের কাজ হয়।
বাংলার নানা সমস্যা আছে, কিন্তু তার উজ্জ্বল ইতিহাসও আছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে মন্থন ঘটেছে, তাও তো একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। আর, নীতিভিত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে অহঙ্কারী শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায়, তা তো দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল শাহিনবাগে, বিহার নির্বাচনে, এবং দিল্লিতে কৃষকদের আন্দোলনের মধ্যে। এটা ঠিক যে, ভেদনীতিই বিজেপির মূলধন। তার সঙ্গে আছে দান। মাঝে মাঝে লাঠি ঘুরিয়ে দণ্ডের হুঙ্কার। আছে মোহবিস্তারী প্রচার। কোনটা কখন কী ভাবে প্রয়োগ করতে হয়, সে বিদ্যা বিজেপির অধিগত। সে কারণেই নিষ্ঠুরতার নিজের গড়া রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েও দলটা নিজেকে বিস্ফারিত করে চলেছে। কেন্দ্রের সরকারই হোক বা বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকার, সামান্য খবর রাখা লোকেই জানে, লোক-স্বার্থ নষ্ট করতে তারা কতখানি তৎপর ও পারঙ্গম। একটু সাদা চোখে দেখলেই এই দলের আসল বৈশিষ্ট্যটা স্পষ্ট উঠে আসে। সেটা হল, ক্ষমতাকে এমন ভাবে ব্যবহার করা, যাতে মানুষগুলো আর মানুষ না থেকে সর্ব ক্ষণ ক্ষমতার কাছে নতজানু হয়ে থাকে। কারও অজানা নয়, নোটবন্দিতে সাধারণ দেশবাসীর এক পয়সা লাভ তো হয়নিই, উপরন্তু দেশের অর্থব্যবস্থা কাহিল হয়েছে। কিন্তু, তাতে কী? কেন্দ্র সরকার বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে যে সে সর্বেসর্বা, যা খুশি তা-ই করার অধিকার তার আছে।
বিশ্বে এমন সরকারের নিদর্শন কমই পাওয়া যাবে, যে সরকার মানুষের দুর্ভোগে এত আনন্দ পায়। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী মজুরকে এক লহমায় দুর্গতির সীমায় পৌঁছে দিয়েও ফুর্তি পুরো হয়নি, রেললাইনে এলিয়ে পড়া দেহগুলো ট্রেনে কাটা পড়ার পরও, মানুষগুলোর গায়ে কীটনাশক ছিটিয়েও, দেশবাসীকে থালা বাজানোর হুকুম দিয়েও কৌতুক মেটেনি। এসেছে শ্রম আইনের তথাকথিত সংস্কার, প্রথমে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে, তার পিছু ধরে কেন্দ্রে। শ্রমিকের অধিকার বলে কিছু থাকবে না— মালিকপক্ষ যখন খুশি তাড়িয়ে দেবে। এমন আইন আনা হয়েছে যে, কৃষক আতঙ্কে অস্থির। প্রতিবাদ করলে নভেম্বরের উত্তর ভারতের শীতে পুলিশ গায়ে ঢেলে দিচ্ছে শীতল জল। রুজু হচ্ছে মামলা। প্রতিবাদ করা যাবে না, বিরুদ্ধ কণ্ঠক্ষেপ মানেই জেল। সংবিধান লঙ্ঘন করে কাশ্মীরের মর্যাদা হরণ করা হল, যাঁরা প্রতিবাদ করলেন তাঁদের জেলে পোরা হল। দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু মানুষের হয়ে কণ্ঠক্ষেপের অপরাধে জেলে পুরে দেওয়া হল ভারাভারা রাও, স্ট্যান স্বামীদের। প্রতিবাদ শাসকের অপছন্দ, তাতে নিষ্ঠুরতার মৌতাত কেটে যায়।
গণতন্ত্রের একান্ত ভোট-নির্ভরতার কারণে কোনও দলের ক্ষমতায় আসার জয়োল্লাসে ঢাকা পড়ে যায় গণতন্ত্রের বহু মৌলিক প্রশ্ন। ভোটে জেতা সরকার যে যা-খুশি তা-ই করতে পারে না, তাকে যে দেশের নাগরিকদের সন্তোষ-অসন্তোষ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়, তাঁদের সঙ্গে বার্তালাপ করতে হয়— এই প্রাথমিক মূল্যবোধটাকেই মাটিচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবাদের বিকৃতি, মিথ্যা সংবাদ উৎপাদন, নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়া, বিধায়ক-সাংসদ কিনে নেওয়া, ভয় দেখিয়ে হাড় হিম করে দেওয়া থেকে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস পর্যন্ত নানা অগণতান্ত্রিক উপায়কেও নিছক ভোটে জেতার জোরে বৈধ করে তোলা হয়েছে। আইনের দুষ্প্রয়োগ করে প্রতিবাদী, এমনকি সাধারণ লোকেদেরও গ্রেফতার আর প্রচারের নিনাদে সেগুলোকে দেশদ্রোহের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে সমর্থন আদায়ের কৌশলটা শাসকদের জন্য অব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু, বর্তমান বিজেপি সরকারকে এ সবের চেয়েও বেশি রসদ জুগিয়ে চলেছে ভারতীয় রাজনীতিতে মূল্যমানের অবনমন। রাজনীতির সঙ্গে নীতির বিচ্ছেদ তাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছে আবাদি জমি। কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন অ-বিজেপি দল ক্ষুদ্র স্বার্থের টানে নিজেদের মধ্যে— এমনকি নিজেদের দলের মধ্যেও— বিবাদে লিপ্ত। আবার অনেকেরই যেন মেরুদণ্ড ঝুঁকে পড়ছে, হয় নিজেদের অনীতি-কুনীতির ভারে, অথবা ভয়ে, অথবা দুটোরই কারণে। আরও দুর্ভাগ্য, ঘর যখন জ্বলছে, কেউ কেউ তখন আগুন নেবানোর চেষ্টায় না নেমে, কে আগুন লাগাল তা নিয়ে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছে।
এ রাজ্য তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রাজ্যের ভূতপূর্ব ও বর্তমান শাসকরা আস্ফালন করে এসেছেন, ‘বাংলার মাটি, দুর্জয় ঘাঁটি’, এখানে সাম্প্রদায়িক শক্তির স্থান নেই। কিন্তু, তাঁরা— এবং কলকাতাকেন্দ্রিক বিদ্বৎসমাজ— একটা কথা মনে রাখেননি। তাঁরা যাকে নবজাগরণের, রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথের বাংলা বলে গর্ব করে এসেছেন, সেই বাংলা নগরের সুসংস্কৃত প্রেক্ষাগৃহের ভিতরেই আটক থেকেছে। বাকি বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাত, নারী-বিদ্বেষ ইত্যাদি পশ্চাদ্মুখী জীবাণু নিজের মতো করে টিকে থেকেছে। গত এক-দেড় দশকে রাজ্যে এবং সর্বভারতীয় স্তরে রাজনীতি সেই জীবাণুগুলোকে অনুকূল পরিবেশ গড়ে দিয়েছে। গোমূত্র থেকে রোগমুক্তির মতো নানা অপ-সংস্কারের প্রচারকদের কাছে এটাই তো ‘নতুন বাংলা গড়ার ডাক’ দেওয়ার সময়।
অথচ, একটু কান পাতলেই এ রাজ্যের নেতারা শুনতে পেতেন, “কোথায় গুজরাতে কী হচ্ছে তা দিয়ে আমার কী?”, বা “ওরা গরু খায়, ওদের রক্ত খুব গরম!”, অথবা “শেষ পর্যন্ত ইস্কুলে আমাদের ছেলেমেয়েদের ছোট জাতের হাতের রান্না খেতে হবে!” একটু চোখ মেললেই দেখতে পেতেন, কী ভাবে এ রাজ্যের মর্যাদার রাজনীতিকে গ্রাস করল দাক্ষিণ্যের রাজনীতি। একদা লোকাল কমিটির দাক্ষিণ্য, অধুনা ব্যক্তিবিশেষের। দাক্ষিণ্যই যেখানে উন্নয়নের ভিত্তি, সেখানে উন্নয়নের উপর মানুষের ভরসা থাকে কী করে? দাক্ষিণ্য মানে সাময়িক পরিত্রাণ, তা দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দূর হয় না। অথচ, যে ক্ষেত্রগুলোতে সুযোগের সমতার সম্ভাবনা ছিল, যত সীমিতই হোক, সেটুকুও সততার সঙ্গে করা হয়ে থাকলে, অন্তত মানুষের দৈনন্দিন দাবিগুলো নিয়ে সাধুতার সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো গড়ে তুলতে পারলেও মানুষ নিজের গণ্ডিটাকে প্রসারিত করতে পারত। দুর্ভাগ্য, রাজনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এমন সামাজিক পরিসর গড়ে দিল, যেখানে লোকস্বার্থ-বিরোধিতায় রেকর্ড গড়া একটা দলও মানুষের মনে মোহবিস্তার করতে পারছে।
তা হলে বাংলা কি কিছুই শিখবে না? নিজের কাছ থেকে, দেশের কাছ থেকে? কী ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস ও বাম-কংগ্রেস সমন্বয়ের মেলবন্ধন সম্ভব? নির্বাচনী জোট হয়তো বা অসম্ভব। কিন্তু, নেতারা যদি মানেন যে আগুন লেগেছে, তা হলে স্থানীয় স্তরে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রেখেও আগুন নেবানোর ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারেন। আগুন যে লেগেছে, সেটা বুঝতে তো অসুবিধে নেই। কে লাগাল বা কার দোষে লাগল, সেই তর্ক পরেও চলতে পারে, কিন্তু এ মুহূর্তে আগুন নেবানোটাই কাজ। একমাত্র কাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy