সৌন্দর্য’ই আসলে ‘সত্য’। কবি কিটস-এর এই পরিচিত এবং অনবদ্য উক্তি নিয়েও হয়তো এ বার বিতর্ক হবে। কারণ ‘সৌন্দর্য’ শব্দটিকে আমরা কোন অর্থে গ্রহণ করব, তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আসলে কোনও প্রচলিত কথা অথবা কবি, লেখক, শিল্পীর অসাধারণ রচনা অনেক সময়ই যুগান্তকারী ও সার্বিক রূপ পায়। তখন তা একটি নির্দিষ্ট অর্থে আর সীমাবদ্ধ থাকে না। ‘ওড অন আ গ্রেসিয়ান আর্ন’-এ ‘সৌন্দর্য’ বলতে কিটস কী বুঝিয়েছিলেন, তাকে ছাপিয়ে গিয়ে এখন কেউ সংশয় প্রকাশ করে বলতেই পারেন, “এ কোন সৌন্দর্য? কোনও ব্যক্তির চেহারা না কি জগতে যা কিছু সুকৃতি?” এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও এক বার ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ বিতর্ককে দেখা যেতে পারে।
‘ফেয়ার’ অর্থ কী? যে কোনও সাধারণ অভিধান খুললেই দেখা যাবে এই শব্দের বিভিন্ন অর্থ হতে পারে। যথা ন্যায্য, পরিষ্কার, চলনসই, সুন্দর, অবাধ, ভদ্র, যুক্তিগ্রাহ্য, উজ্জ্বল, বাজার (বিশেষ্য রূপে) ইত্যাদি। অথচ আমরা সেখান থেকে ‘ফর্সা’-র ধারণাটিকে সেঁচে নিচ্ছি। আর এইখানেই সম্ভবত জটিলতার শুরু এবং শেষ। যদি ‘সুন্দর’, ‘পরিষ্কার’, ‘উজ্জ্বল’ অর্থগুলিকে বেছে নিই, সমস্যা থেকেই যাবে। কারণ কে সুন্দর, কী পরিষ্কার, কাকে উজ্জ্বল বলা হবে, তার ব্যাখ্যা ব্যক্তি বিশেষে বহুবিধ। নইলে ‘ফেয়ার’ শব্দ নিয়ে মুক্ত মনে ভাবতে বসলে বর্ণবিদ্বেষী ধারণা মাথায় আসত না।
কর্মসূত্রেই শেক্সপিয়রের 'সনেট-১৮' পড়াতে হয় ছাত্রীদের। পৃথিবীর সেরা সনেটিয়ার এক মহিলাকে নিয়ে কবিতা লিখছেন। অথচ তাঁর গায়ের রং সাদা নয়। পড়াতে পড়াতে শেক্সপিয়রের মানসকন্যা ক্লিয়োপেট্রার কথাও বলি। ভুবনখ্যাত রানিও আজকের অর্থে ‘ফেয়ার’ ছিলেন না। কৈশোর আর তারুণ্যের মাঝখানে ভাসতে থাকা ঝোড়ো সমুদ্রের নৌকাগুলিকে বোঝানোর চেষ্টা করি, যা সময় এবং ক্ষয়ের থাবায় ধরা দেয় না, তাই সৌন্দর্য। যা কোনও শব্দ, প্রথা, সাময়িক প্রবৃত্তির দাস নয়, তাই সৌন্দর্য। বিস্ফারিত তরুণ চোখগুলি কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা কৌতুক, কিছুটা সংশয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তার পর ধীরে ধীরে সেই দৃষ্টিরা স্বাভাবিক হয়। ওরা বোঝে, বুঝতে পারে। এবং, যে মেয়ের গায়ের রং ‘ফেয়ার’ নয়, সে বুঝি একটু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস পায়।
কিন্তু ক্লাসরুমের বাইরেও একটি বৃহত্তর জগৎ রয়েছে। সেখানে ‘ফেয়ার’ আর ‘ফাউল’ সারা ক্ষণ লড়াই করে চলে। সেখানে পা রাখা মাত্র, একটু আগের আত্মবিশ্বাসী মেয়েটি ফর্সা হওয়ার ক্রিম কিনতে চলে যায়। বুঝতে পারি, ওরা বোঝালে বোঝে। কিন্তু আজন্মের ভুল ধারণা সরিয়ে নতুন কিছু আত্মস্থ করতে গিয়ে ওদের মনের মধ্যে সব এলোমেলো হয়ে যায়। এ এক দিনের ব্যাপার নয়। এক দিনে এর সমাধানও হবে না। এর মূলে যেমন বিদ্বেষ রয়েছে, তেমনই ‘বাজার’ও আছে। সেই বাজারের চাহিদা ভেবেই হঠাৎ ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ নাম বদলে দেওয়াটা নিশ্চয়ই প্রতীকী পদক্ষেপ। কিন্তু দীর্ঘ অভ্যাসের দ্বারা মনের গভীরে শিকড় ঢুকিয়ে দেওয়া ধারণাগুলিকে উপড়ে ফেলা অত সহজ নয়। এই ভাবে বললে কি কেউ বুঝত যে, ‘ফেয়ার’ মানে তথাকথিত ফর্সা নয়?
শব্দ আমাদের সৃষ্টি করেনি। শব্দকে আমরা সৃষ্টি করেছি। সকারণে, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই করেছি। তবু এখন তারা সেই প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো, যাকে ছাড়া গ্রাম এবং গ্রামের মানুষকে ভাবাই যায় না। আমরা তাদের উপড়ে ফেলার চেষ্টা না করে যদি মুক্ত মনের প্রতিফলন ঘটিয়ে ইতিবাচক ভাবে ব্যাখ্যা করি, কেমন হয়? ‘ফেয়ার’-এর মতো শব্দ তো বর্ণমালার রন্ধ্রে রন্ধ্রে পঙ্গপালের মতো ছেয়ে আছে। কত জনকে নাম বদলে নিকেশ করা যাবে?
সমস্যার শুরুটা অনেক আগেই হয়েছে। কাজেই সমাধানের শুরুটাও শুরু থেকেই করতে হবে। অর্থাৎ একেবারে শিশুকাল থেকে। কাদামাটি বয়স বাড়লে শক্ত আর জেদি হয়ে যায়। তা দিয়ে নতুন মূর্তি গড়া যায় না। সহজ পাঠ স্তরেই ছোটদের বোঝানো শুরু করা উচিত— শব্দের কিন্তু বহু অর্থ হয়। সেগুলি গ্রহণ করতে হবে ইতিবাচক অর্থে। নেতিবাচক অর্থও আছে। সে সব গ্রাহ্য হবে না। সমাজের অনেক নেতিবাচক বিষয়ই তো আমরা বর্জন করি!
শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক স্তরে মনের ক্যানভাস সব অর্থেই ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’। সেখানে আজও ‘ফেয়ার’ মানে ‘বাজার’ নয়। ওইখানে খনন কার্য চালালে সোনা ফলবেই। জীবন অনেকটা প্রবাহিত হয়ে গেলে পুরনো প্রাচীরগুলি ভাঙা খুব কঠিন; সে বদলের ঘা যত জোরদারই হোক না কেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy