ছবি: সংগৃহীত
চমকে দিয়েছে এক বিদ্যালয়ের মেয়েদের গানের ভিডিয়ো। অপসংস্কৃতির অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীরে অপশব্দ লেখার জন্য অভিযুক্ত চার কন্যা। বৃহত্তর সমাজের মত, এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুখ ‘কালো’ করেছে মেয়েরা। বিরাট হইচই ফেলেছে তাদের এই ‘গর্হিত’ কাজ। একটি প্যারোডি গানের ছন্দ ও শব্দ ধার করেছে এই মেয়েরা। কেন তারা এমন করল, তা নিয়ে যখন সমাজ তোলপাড়, তখনই বিদ্যালয়ের এক মেয়ে শেষ সুযোগ চেয়ে ভিডিয়োটি মুছে ফেলার আকুতি জানিয়েছে। অন্য দিকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে উৎসবের দিনে উপস্থিত মেয়েদের ‘বহিরাগত’ বলে শনাক্ত করা হয়েছে।
নানা সোস্যাল নেটওয়ার্ক থেকে যা বোঝা যাচ্ছে, সমাজের একটি দিকের কথা হল, এ এক ভয়ঙ্কর অশ্লীল কাজ। এমনটা কখনও করা উচিত নয়। তাঁদের যুক্তিটি হল, যা অপশব্দ তা প্রকাশ্যে আনাটা অনুচিত। অন্য পক্ষের মত, কোনটি অপশব্দ, তা সমাজই স্থির করে। অভিধান নয়। ভাষা বহতা নদী। সে গ্রহণ করে, বর্জনও করে। তাই এখনই কোনও কিছুকে ‘অপ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া উচিত নয়। তবে এই পক্ষটিও স্কুলের ছাত্রীদের গান বা রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রীদের পৃষ্ঠদেশে অঙ্কিত লিপি-কে সরাসরি সমর্থন করছেন না।
এই পরিস্থিতিতে মনে হয়, পরাজয়ের ভাষা এবং ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ভাষা কোথাও এক হয়ে গিয়েছে। কেননা কৃতিত্ব দেখনোর পরিসর ছোট হয়ে আসছে। বইয়ের পাঠ ও সমাজের বাস্তব চেহারা নিরন্তর ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। বাহবা পাওয়ার সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। তবে কিছু করে দেখানোর ভাবনায় এসেছে নানাবিধ মিশেল। বয়স্ক কাউকে দেখে জোরে খারাপ শব্দ উচ্চারণ করলে তাতে অনেককে চমকে দেওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু তাকে ‘বিপ্লব’ বলে মানা যায় কি না, সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু এই হিরোইজম এখন আনন্দে বেঁচে থাকার বড় রসদ। সেই সাহস দেখানো থেকে মেয়েরা পিছিয়ে থাকছে না।
কিন্তু আমাদের কাছে এই প্রশ্নটি উঠছে যে, ছেলেরা এমন করলে, আমরা কি এতটাই চমকে উঠতাম? প্রকাশ্য রাস্তায়, যানবাহনে, আড্ডায় অনেক ছেলের মুখে নানা অশ্লীল শব্দ হজম করতে অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রেই কি বেশি করে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ঘটনাটি? এ কথা অবশ্য ঠিক যে, একটি ছেলের দল যদি এ ভাবে গান গাইত, বা পিঠে এমন শব্দ লিখে রাখত, তা হলেও নিন্দার ঝড় উঠত। পথে যাওয়ার সময় ট্রেনে বা বাসে আচমকা একটা মন্তব্য এক কথা। আর সবাইকে দেখাবো বলেই এমনটা করা, সেটা আর এক রকম কথা!
বিতর্ক আরও উষ্ণ হয়েছে এই কারণে যে, ঘটনাটি ঘটেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আমাদের ধারণা, আড্ডায় যা করা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা করা যায় না। আড্ডায় যে পোশাকে যেমন যাওয়া যায়, তেমন পোশাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া যায় না। কিন্তু এই ধারণার পরিবর্তন অনেক দিন ধরেই ঘটছে। ইউনিফর্ম জরুরি কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে অনেক বার।
ঠিক তেমন ভাবেই ওই স্কুল ও কলেজের ছাত্রীরা আক্রমণ করেছে আরও একটি প্রতিষ্ঠানকে। রবীন্দ্রনাথের গানে অপশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
অর্থাৎ, প্রথম সমস্যা হল ছাত্রীরা এমন কাজ করেছে, দ্বিতীয়ত, তারা করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও তৃতীয়ত অপশব্দ বসেছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে।
স্বাভাবিক ভাবেই বাঙালির পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট দেখে মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রসঙ্গীতে অপশব্দ ব্যবহার যতটা না ক্ষুব্ধ করেছে মানুষকে, তার চেয়ে বেশি করেছে মেয়েদের এমন অশালীনতায়। কেননা, যে ব্যক্তি প্রথম এই গানটি এই ভাষায় গেয়েছিলেন, তিনি পুরুষ এবং তখন কিন্তু এতটা শোরগোল হয়নি। কয়েক জন নেটিজেন তা নিয়ে রাগারাগি, গালিমন্দ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা এমন বড় আকার নেয়নি।
তাই মনে হয়, যে শব্দগুলি প্রত্যহ এক শ্রেণির মানুষের ভাষা বলে দাগিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল সমাজ,এখন সেই ভাষা মেয়েরা নিজেদের পিঠে লিখে ফেলছে বলেই বেশি বিব্রত বোধ করছেন অনেকেই।
অপমান ও অবমাননায় মর্মাহত হওয়ারই কথা। যে ব্যক্তি জীবনে একটি অপভাষা ব্যবহার করেননি, তাঁর পরিবারের মেয়ে কলেজের হস্টেলে বসে জোরে জোরে এই গানের রেকর্ড শুনছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটি তাঁর সন্তানের স্বাধীনতাও। সন্তানের কাছ থেকে তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার অভিভাবকের নেই। এই গানটি শোনা মেয়েটির চয়েস। সেই চয়েসকে আড়াল দিতে হবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে।
কিন্তু সে বিতর্কের পাশেই এ কথাও বলা যায়, ছেলেরা যা পারে মেয়েরাও তা পারে, এই বিরাট সমাজ তা কিছুতেই স্বীকার করে না। বিশ্বাসে স্থানও দেয় না। পাড়ার চত্বরে যে যে কোনও দিন অশ্লীল শব্দের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেনি, সে-ও আজ খুব অসহায়। মেয়েদের এমন অভব্য কথা শুনে ও দেখে বঙ্গে সব ‘সব শেষ’ বলে একযোগে কপাল চাপড়ে চলেছে তারা। এই দিনচর্চা সমাজকে অন্ধ যুক্তিহীন একদল ‘হ্যাঁ-বাদী’ মানুষের দল উপহার দেয়। যাদের কাজ সমাজের মেয়েদের সংযত রাখার নৈতিক শিক্ষার তালিকায় নিত্য সংযোজন আনা।
এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত না হলেও একটা কথা বলা যায়। কিছু দিন আগে পর্যন্ত মেয়েরা সিগারেট খেলেও আপত্তি উঠত। তখন বলা উচিত ছিল, ধুমপান সকলের পক্ষেই খারাপ, শুধু মেয়েদের জন্য নয়। ছেলেদেরও বারণ করতে হবে। কিন্তু ছেলেরা তা না শুনলে সমাজে গেল গেল ভাব আসবে না। অথচ, কিছু মানুষের ধারণা, মেয়েরা বারণ সত্ত্বেও সিগারেট খেলে সমাজে মস্ত বিপদ ঘনিয়ে আসবে।
এই বিতর্কের মধ্যে আশার কথা হল, নতুন প্রজন্মের কাছে ধূমপান, মদ্যপানের মতোই ‘কুল’ অপশব্দের ব্যবহারও। স্ল্যাং যদি এক অনবদ্য সুরে ও ছন্দে বাধা পড়ে তো কথাই নেই। আবার ‘ফান’টাও একদম আনকোরা নতুন। যে যৌনজড়তা থেকে অপশব্দ ব্যবহারে ভীতি তৈরি হয়, তা যদি কেটে যায়, তা হলে আখেরে সমাজের কল্যাণই। মেয়েরা নির্ভীক হচ্ছে। বেপরোয়া হতে শিখছে। সমাজের রক্তচোখ তাদের মনের ইচ্ছায় দেওয়াল তুলতে পারছে না। লোকলজ্জা নামক নির্জীব কালো পাথরকে তারা পা দিয়ে সরিয়ে ফেলছে। বিশ্বাস করছে, প্যারোডিতে সমাজ রসাতলে যায় না। অন্যায় ও অসাম্য দেখে চোখ বুজে থাকলেই সমাজের বুকে পলি জমে। মেয়েদের সেই অন্যায়কেই মেনে নিতে শেখানো হয় ছোট থেকেই। এমন অনৈতিক শিক্ষা পেয়ে তারা সব সময় সমাজকে পাঠ দেওয়ার পতাকা ওড়াবে এমন আশা করাটা অন্যায়। প্রশ্রয় না দিয়েও তাই পরিস্থতিটা বিবেচনা করা যেতে পারে।
শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy