Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
কেনাবেচার সুখদুঃখ

পিসিমা কেন আড়াই কোটি টাকার কমে বাড়ি বেচতে রাজি নন

‘‘ব্যাসদেব তোর কোনও উপকারেই এলেন না দেখছি।’’ দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন শিবুদা, কিন্তু মুখের হাসি বলছে, উত্তরটা তাঁর বিলক্ষণ পছন্দ হয়েছে।

অমিতাভ গুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share: Save:

গোপালের দোকানে যখন শিবুদা ঢুকলেন, সূর্য মন দিয়ে রাজশেখর বসুর মহাভারত পড়ছিল। সপ্তাহখানেক ধরে ওর মহাভারত পর্ব চলছে।

‘‘বল দিকি, দুনিয়ায় সবচেয়ে সুখী কে?’’ প্রশ্ন করলেন শিবুদা।

‘‘যার রোজগার নিজের ভায়রাভাইয়ের চেয়ে একশোটা টাকা বেশি, সে।’’ মুচকি হেসে উত্তর দিল সূর্য।

‘‘ব্যাসদেব তোর কোনও উপকারেই এলেন না দেখছি।’’ দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন শিবুদা, কিন্তু মুখের হাসি বলছে, উত্তরটা তাঁর বিলক্ষণ পছন্দ হয়েছে। ‘‘এটা কার কথা, জানিস? হেনরি লুই মেনকেন। মার্কিন লেখক। নিট্‌শের ভক্ত, আমেরিকান ইংরেজির ধরনধারণ নিয়ে দু’ভলিউম ‘দি আমেরিকান ল্যাঙ্গুয়েজ’ লিখেছিলেন— আবার, রম্যরচনার ক্ষেত্রে ঘোরতর ফিচেল ছিলেন। কী আশ্চর্য, বলতে বলতেই রাজশেখর বসুর কথা মনে পড়ল। সমাপতনের চূড়ান্ত!’’

‘‘সে আপনি যা-ই বলুন, পুজোর বাজারে যে ডিসকাউন্টে কেনাকাটা করতে পেরেছে, সে সবচেয়ে সুখী।’’ ফুট কাটল তপেশ। তার চেয়ারের পায়া ঘেঁসে ঢাউস প্যাকেট, প্রয়োজনের চেয়ে ঢের বেশি নতুন জামাকাপড় উঁকি মারছে।

‘‘খালি তুচ্ছ কথা।’’ ধমক দেন শিবুদা। তার পরই সুর নরম। ‘‘কথাটা অবিশ্যি খুব ভুল বলিসনি। টাকাকড়ির সঙ্গে তো বটেই, ডিসকাউন্টের সঙ্গেও সুখের ঘোরতর সম্পর্ক রয়েছে। ছুটকো আনন্দ নয়, রীতিমতো সুখ। মগজে যন্ত্র বসিয়ে ছবি তুলে প্রমাণ করে দিয়েছেন নিউরো ইকনমিক্স-এর গবেষকরা।’’

গোপাল চা দিয়ে যায়। শিবুদা নিজের কাপটা টেনে নিলেন। আয়েশ করে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, ‘‘আসল কথা হল ঠকে না যাওয়া। বুঝলি? কিন্তু, ঠকছিস না যে, সেটা বুঝবি কী ভাবে? ড্যানিয়েল কানেম্যানের উত্তর ছিল, রেফারেন্স পয়েন্ট ধরে। এই যে ডিসকাউন্টে জামাকাপড় কেনার সুখ— তপেশ যে প্রায় কিডনি বেচে ডিসকাউন্টে পুজোর বাজার করে এল— সেটা কেন? কারণ, ওর কাছে এই জামাকাপড়গুলোর দামের যে রেফারেন্স পয়েন্ট ছিল, ডিসকাউন্টে তার চেয়ে সস্তায় পেয়েছে। ব্যস, তপেশ জানে যে ও ঠকেনি। কথা হল, ওর মাথায় দামের যে রেফারেন্স পয়েন্টটা ছিল, সেটা এল কোত্থেকে? সে কথা আগে বহু বার তোদের বলেছি— অ্যাঙ্কর এফেক্ট-এর কথা— আবার বললে তোরা বিরক্ত হবি। কিন্তু, বেচাকেনার মধ্যে সুখের গল্প কি শুধু এটুকুই?’’ থামলেন শিবুদা।

‘‘ভাদ্র মাসের গুমোট গরম, তার ওপর গোপালদা কিছুতেই পাখা সারাবে না, আর আপনি এর মধ্যে সুখের ফিরিস্তি ফাঁদছেন! ধন্যি মশাই!’’ তপেশকে চুপ করিয়ে রাখে, কার সাধ্য।

শিবুদা পাত্তা দিলেন না। শিশিরের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিলেন, সেটাকে দেশলাই বাক্সের ওপর দু’বার ঠুকে তার পর ধরালেন। বারকয়েক ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘‘যেটা বলছি, শোন। ভবিষ্যতের দুই নোবেলজয়ী দুটো আলাদা ইউনিভার্সিটিতে বসে একটা জিগ্‌স পাজ়ল সলভ করে ফেললেন। এক দিকে কানেম্যান আর তাঁর ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী অ্যামস টারস্কি। তাঁরা আবিষ্কার করলেন প্রসপেক্ট থিয়োরি— একশো টাকা লাভ করলে মানুষের যতখানি আনন্দ হয়, একশো টাকা ক্ষতি হলে দুঃখ হয় তার চেয়ে ঢের বেশি। সটান দুই থেকে আড়াই গুণ। অন্য দিকে রিচার্ড থেলার। তিনি লক্ষ করলেন, কোনও জিনিস কেনার জন্য আমরা যত টাকা দিতে রাজি, সেই জিনিসটা আমাদের মালিকানায় থাকলে সেটা বেচার জন্য আমরা ঢের বেশি দাম চাই। থেলার এর নাম দিলেন এনডাওমেন্ট এফেক্ট। এ দুটোকে জুড়লে কী দাঁড়াচ্ছে, বল দিকি।’’

শিবুদাও ঘামছেন রীতিমতো। টেবিলে পড়ে থাকা আনন্দবাজারটা তুলে হাওয়া খেলেন খানিক। তার পর বললেন, ‘‘থেলার তখন রচেস্টারে পিএইচ ডি করছেন। অর্থনীতির ছাত্র, কিন্তু ঘোর বিদ্রোহী। তখন সত্তরের দশক। থেলার সারা ক্ষণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন কে কোথায় অর্থনীতির নিয়মকানুন ভাঙছে। দেখলেন, তাঁদেরই এক অধ্যাপক, রিচার্ড রসেট, ওয়াইন জমান। বিদেশে অনেকেরই ওয়াইন জমানোর শখ। ছবি জমানোর মতোই। তেমন দুষ্প্রাপ্য বোতল থাকলে ভাল দামে বিক্রিও হয় সেই ওয়াইন। অধ্যাপক রসেটও কেনাবেচা করতেন। কিন্তু, থেলার দেখলেন, যে ওয়াইনের বোতল কেনার জন্য রসেট ৩৫ ডলারের বেশি খরচ করতে রাজি নন, ঠিক সমান গুণমানের অন্য একটা তাঁর কাছে থাকলে সেটা বিক্রি করার সময় নিদেনপক্ষে ১০০ ডলার দাম চাইছেন। নিতান্তই অর্থনীতির নিয়মবিরুদ্ধ কাজ। তপেশের মতো গণ্ডমূর্খও জানে, যে কোনও যুক্তিযুক্ত মানুষের কাছে কোনও একটা জিনিসের একটাই দাম হয়। মানে, এক বোতল ওয়াইনের দাম যদি আমার কাছে ৫০ ডলার হয়, তবে ৫০ ডলার বা তার চেয়ে কম যে কোনও দামে আমি বোতলটা কিনতে রাজি হব, আর ৫০ ডলার বা তার চেয়ে বেশি যে কোনও দামে সেটা বেচতে চাইব। রিচার্ড রসেটের কেনা আর বেচার দামে ফারাক ঝাড়া ৬৫ ডলারের। এটা কিন্তু লাভ রাখার গল্প নয়, কারণ রসেট যে বোতলটা বেচবেন, সেটা কিনেছিলেন কম দামেই, কাজেই লাভের জন্য ১০০ ডলার দাম চাওয়ার দরকার নেই। ইর‌্যাশনাল, মানে অর্থনীতির যুক্তিবিবর্জিত তো বটেই, কিন্তু কেন? এই রহস্যের সমাধান করল কানেম্যান আর টারস্কির একটা— তখনও অপ্রকাশিত— পেপার।’’

‘‘রহস্যের কী আছে? এই চক্করে পড়েই তো পিসিমা শ্যামবাজারের বাড়িটা এখনও বেচতে পারল না। আড়াই কোটি টাকা দাম হাঁকছে। কেউ তার চেয়ে কম দামের কথা বললেই ‘ঠকানোর চেষ্টা কোরো না’ বলে ভাগিয়ে দিচ্ছে।’’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপেশ। পিসিমার বাড়ির পিছনে যাবতীয় ছোটাছুটি তাকেই করতে হয়।

‘‘একদম মোক্ষম কথাটা বলেছেন পিসিমা’’, তপেশের কথা লুফে নেন শিবুদা। ‘‘হাতে থাকা জিনিস— শুরুতে যেটা বেচার জন্য ছিল না, ভোগ করার জন্য, বা জমানোর জন্য ছিল— সেটা বেচতে গেলে আমরা তার দামকে বাজার দামের চেয়ে বেশি ধার্য করি। দামের রেফারেন্স পয়েন্টে আবেগও ঢুকে যায়। কেউ তার চেয়ে কম দিতে চাইলেই মনে হয় ঠকিয়ে নিচ্ছে। তোর পিসিমাই কিন্তু শ্যামবাজারে ওই রকমই আর একটা বাড়ি মোটেও আড়াই কোটি টাকায় কিনবেন না। তাঁর বাড়ির জন্য অন্যরা যে দাম দিতে চাইছে, তিনিও খুব জোর তত টাকাই দেবেন। কিন্তু, সেটা কেন, থেলারও বোঝেননি, তুইও বুঝিসনি। বুঝেছিলেন কানেম্যানরা।’’

‘‘আপনি কিন্তু কানেম্যানের ফ্যানবয় হয়ে উঠছেন কালেদিনে।’’ সূর্য বলে।

‘‘কালেদিনে হচ্ছি না, ঢের আগে থেকেই আমি কানেম্যানের ভক্ত। না হয়ে উপায় নেই’’, শিবুদা স্বীকার করেন। ‘‘এই যে কেনার দামের চেয়ে বেচার দাম বেশি চাওয়া, তার সহজ কারণ— হাত থেকে কোনও জিনিস চলে যাওয়াকে আমরা ক্ষতি হিসেবে দেখি, হাতে কিছু আসাকে দেখি লাভ হিসেবে। প্রসপেক্ট থিয়োরির কথা বলছিলাম না একটু আগে, সমান ক্ষতির অনুভূতি লাভের অনুভূতির চেয়ে ঢের তীব্র— সেই তীব্রতাই সম্ভাব্য ক্ষতি ঠেকানোর জন্য বাড়তি দাম চাইয়ে নেয়। পিসিমাকে দিয়েও, রিচার্ড রসেটকে দিয়েও। দোকানদারের কিন্তু এই অনুভূতি হয় না— তাঁরা দোকানে জিনিস রাখেন বেচার জন্যই, কাজেই সেটা দিয়ে দেওয়ার সময় ক্ষতির অনুভূতি হওয়ার প্রশ্ন নেই।’’

শিশির বলল, ‘‘পিসিমা থেকে রচেস্টারের অর্থনীতিবিদ— লম্বা লিস্ট তো!’’

‘‘তুই-আমিও আছি’’, শিবুদা উত্তর দেন। ‘‘অনেকে সারা জীবন চাকরি পাল্টাতে পারে না এই এনডাওমেন্ট এফেক্টের খপ্পরে পড়ে। নতুন চাকরির অফারটা হাতে থাকা চাকরির চেয়ে ভাল হলেও ক্ষতির অনুভূতিকে পুষিয়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট ভাল নয়— ফলে, মন সায় দেয় না চাকরি পাল্টাতে। সোনার গয়না ব্যাঙ্কের লকারে পড়ে থাকে। সেই গয়নার দামের টাকাটা দিয়ে অন্য কিছু কিনলে হয়তো আর একটু বেশি ভাল থাকা যেত— কিন্তু, প্রাণে ধরে গয়না বেচে গাড়ি কেনা যায় না।

‘‘তার চেয়েও মজার কথা হল, এনডাওমেন্ট এফেক্টের খপ্পরে পড়ার জন্য আদৌ জিনিসটার মালিক না হলেও চলে। খানিক ক্ষণ জিনিসটা ব্যবহার করলেই মনের মধ্যে অধিকারবোধ এসে যায়। আর, অনেক দিন ধরে যদি সেই জিনিসটা কেনার ইচ্ছে পুষে রাখিস মনে, তা হলে তো বটেই। এই যে গাড়ির সেলসম্যানরা টেস্ট ড্রাইভ করতে ডাকে, এর পিছনে আসলে সেই এনডাওমেন্ট এফেক্টেরই গল্প। গাড়িটা চালানোর পর তোর নিজের মনেই সেটার প্রতি টান তৈরি করে দেয় এনডাওমেন্ট এফেক্ট। সেই গাড়িটা না কেনাকে তখন তোর মন একটা ক্ষতি হিসেবে দেখবে, আর সেই ক্ষতি আটকাতে চাইবে। শপিং মলে ঘুরে ঘুরে জিনিস দেখলেও একই কাণ্ড হয়। যারা কিচ্ছুটি কেনে না, শুধু ঘুরে বেড়ায়, তাদের নাম হল ‘মল-র‌্যাট’। মলের ব্যবসার জন্য এরাও খুব জরুরি কিন্তু। হাতে টাকা এলেই কিনতে ছুটবে সেই সব জিনিস, এত দিন ধরে দেখে দেখে যেগুলোর ওপর মালিকানা তৈরি করে নিয়েছে তাদের মন।’’

‘‘শিবু সেনের কথা অমৃতসমান’’, চেয়ারের পাশ থেকে জামাকাপড় ভরা ব্যাগটা তুলে নেয় তপেশ। ‘‘এত দিন র‌্যাট ছিলাম, আজকে ক্যাট হয়েছি। শিকার করে ফিরছি বাড়িতে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Shoopping Discount
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy