ভারতে গত তিন দশকে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নটি মূলত আবদ্ধ ছিল পুঁজি ও উদ্যোগের গণ্ডিতেই। উৎপাদনের আর দুইটি উপাদান— জমি ও শ্রম— সেই সংস্কারের পরিধির বাহিরেই থাকিয়া গিয়াছিল। অকারণে নহে। জমি ও শ্রম, দুইটি বিষয়ই রাজনৈতিক ভাবে অতি তাৎপর্যপূর্ণ— নির্বাচনের ফলাফলে তাহার প্রভাব পড়িবে, সেই আশঙ্কাই রাজনৈতিক শ্রেণিকে এই দুইটি সংস্কার হইতে দূরে রাখিয়াছিল। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই বিরল রাজনৈতিক সাহসটি দেখাইতে পারিয়াছেন। ভারতে শ্রম আইন সংস্কারের বকেয়া কর্তব্যটি তিনি সম্পাদন করিলেন। আর্থিক সংস্কার কথাটির যদি একটিমাত্র অর্থ হয়, তবে তাহা হইল, ব্যবসার প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব সরল, বাধাহীন, এবং সরকারি দখলদারি হইতে মুক্ত করা। ভারতে শ্রম আইনের ছবিটি ছিল এই অবস্থার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। দেশে এত দিন ৪৪টি পৃথক শ্রম আইন ছিল— তাহার ধারা, উপধারা, শর্তাবলি মিলাইয়া ১২০০-র অধিক নিয়ম প্রযোজ্য ছিল। অর্থাৎ, লাইসেন্স-ইনস্পেক্টর রাজের স্বর্গ! ব্যবসা করিতে হইলে এই আইনের গোলকধাঁধায় পথ হারানো, এবং ইনস্পেক্টর
রাজ-এর হাতে নাজেহাল হওয়াই ছিল ভবিতব্য। কাহারও হাতে এই গোত্রের বিপুল ক্ষমতা থাকিলে তাহাকে ব্যবহার করিয়া অন্যায় সুবিধা আদায় করিবার প্রবণতা বাড়াই স্বাভাবিক। ফলে, বারে বারেই অভিযোগ শোনা গিয়াছে, শ্রম আইন আসলে দুর্নীতির আখড়াবিশেষ। সেই দুর্নীতিতে সর্বাধিক ক্ষতি হয় আর্থিক কুশলতার, প্রতিযোগিতার। অর্থাৎ, ক্ষতি দেশের আর্থিক স্বার্থের। সেই কারণেই শ্রম আইন সংস্কারের সিদ্ধান্তটি অতি প্রয়োজনীয়। ৪৪টি আইনকে চারটি বিধিতে সীমাবদ্ধ করায়, আশা করা চলে, প্রক্রিয়াতে স্বচ্ছতা আসিবে।
কিন্তু, সেই গুরুত্বকে ছাপাইয়া একটি অন্য প্রশ্ন প্রকট হইয়া উঠিতেছে— অর্থনীতি যখন মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়াছে, সংগঠিত ক্ষেত্রেই কয়েক কোটি মানুষ কাজ হারাইয়াছেন, কর্মসংস্থানহীনতার হার স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাইয়াছে, তখনই কি এই সংস্কার করা অপরিহার্য ছিল? কেহ বলিতেই পারেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী শ্রম আইন সংস্কারের ন্যায় বিতর্কিত বিষয়ের জন্য এই সময়টি সচেতন ভাবেই বাছিয়াছেন। করোনাভাইরাসের অজুহাতে সংসদে বিরোধিতার পরিসর সঙ্কুচিত হইয়াছে, বিক্ষোভ-আন্দোলনের উপরও হরেক নিষেধাজ্ঞা। এই অবকাশে শ্রমবিধি পাশ করাইয়া লওয়া একটি সুকল্পিত স্ট্র্যাটেজি। শিক্ষানীতি বা কৃষি বিলের ক্ষেত্রে সরকার যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছে বলিয়া অভিযোগ, শ্রমবিধির ক্ষেত্রেও তাহার অন্যথা হয় নাই।
এই নূতন শ্রমবিধিতে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা আরও বাড়িবে বলিয়াই অনেকে সংশয় প্রকাশ করিতেছেন। প্রয়োজনে শ্রমিক ছাঁটাই করিবার অধিকারটি নমনীয় শ্রমবিধির প্রাণভ্রমরা, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রশ্ন উঠিতেছে, ছাঁটাইয়ের প্রবণতা যখন চরমে উঠিয়াছে, তখনই তাহাতে সরকারি অনুমোদনের সিলমোহর লাগাইয়া দিলে শ্রমজীবী মানুষের উপর কী প্রভাব পড়িবে? আরও বড় প্রশ্ন, এখন শ্রম আইন সংস্কারের ফলে অর্থনীতির সুরাহা হইবে কি? আইন নমনীয় হইয়াছে, শুধু সেই কারণেই কি কেহ নূতন বিনিয়োগ করিতে আগ্রহী হইবেন? এই প্রশ্নের উত্তর প্রধানমন্ত্রী জানেন বলিয়াই আশা করা চলে। বাজারে যখন চাহিদা থাকে, বিনিয়োগের অনুকূল পরিস্থিতি থাকে, নমনীয় শ্রমবিধি তখন লগ্নিকারীদের বাড়তি উৎসাহ জোগায় বটে, কিন্তু প্রয়োজনে শ্রমিক ছাঁটাই করা চলিবে, শুধু এই কারণেই কেহ বিনিয়োগ করিতে আসিবেন না। অতঃপর প্রশ্ন উঠিবে, শ্রম আইন সংস্কারের ন্যায় তাৎপর্যপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তকে এই অবান্তর বিতর্কের মধ্যে ফেলিয়া দেওয়া কি রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক?