বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। আত্মঘাতীও। কথাগুলো বাঙালির রাগবিদ্যাচর্চার গরিমার ক্ষেত্রেও খাটে। একটু খুলেই বলি। হিন্দুস্থানি ধ্রুপদী সঙ্গীতচর্চার ইতিহাসে রাগরাগিণীর নামের সঙ্গে স্থাননামের নিবিড় সম্পর্ক আছে। এ ইতিহাসও বেশ পুরনো। যেমন ভূপালের নামানুসারে ভূপালি, কলিঙ্গর নামে কলিংড়া ইত্যাদি। বাংলার নামেও তেমন এক রাগিণী আছে। কিন্তু দীর্ঘকাল নদীখাতে জল না বইলে খাত যেমন মজে যায়, নদী ক্রমে অবলুপ্ত হয়, তেমনই চর্চার অভাবে বহু রাগরাগিণীর মতো বাংলায় তৈরি রাগিণী ‘বঙ্গালী’ বর্তমানে উধাও। হারিয়ে গিয়েছে রাগিণী বঙ্গালীর ছেলে বঙ্গাল রাগটিও।
আমার অন্যতম সঙ্গীতাচার্য পণ্ডিত নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শুধ্ বঙ্গাল ও বঙ্গালভৈরব রাগ দু’টি শুনি। চল্লিশের দশকে উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলী থেকে কলকাতায় আগত রামপুর ঘরানার উস্তাদ মেহেদি হুসেনের কাছে তিনি উক্ত রাগ দু’টি শিখেছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, গঙ্গাবঙ্গ-রাঢ়বঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে রাগগুলি আর্যাবর্তে পৌঁছে গিয়েছিল। অর্থাৎ পশ্চিমদেশে বাঙালির জাতকৌলীন্য না থাকলেও রাগ-রসায়নে বেশ কৃতিত্ব ছিল। তাই সঙ্গীতশাস্ত্রে ছত্রিশ রাগিণীর তালিকায় বঙ্গালী মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। ‘আইন-ই-আকবরী’-তে বঙ্গালীর উল্লেখ আছে। আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে পূর্ব ভারতের সুবেদার ফকিরউল্লাহ তাঁর ‘রাগদর্পণ’-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাগ ভৈরবের পত্নী বঙ্গালী ও পুত্র বঙ্গাল-এর কথা লিখেছেন। ফকিরউল্লাহ স্বীকার করেছেন এ সব তিনি পেয়েছিলেন ‘মানকুতূহল’-এ। ‘মানকুতূহল’ রচনা করেন রাগবিদ্যায় অসামান্য ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন গ্বালিয়ররাজ তোমর মানসিংহ। রাজা মান জানিয়েছেন, সকালবেলা আনন্দময় পরিবেশে বঙ্গালী গাইতে হয়। ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ইতিহাসে রাগিণী বঙ্গালী ও তাঁর ছেলে বঙ্গাল-এর শিকড় পাওয়া যায় পঞ্চম শতাব্দীতে মুনি মতঙ্গের লেখা ‘বৃহদ্দেশী’ পুঁথিতে। কলকাতার সঙ্গীত গবেষক স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ বঙ্গালীর আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, মুনি মতঙ্গ তাঁর আচার্য কশ্যপ নাগের কাছে রাগিণী বঙ্গালী শিখেছিলেন। মতঙ্গের ভাষায় ‘বঙ্গাল দেশ সম্ভূতা’ বঙ্গালী ‘সকল লোক মনোহরা’ এবং ‘দিব্যরূপিণী’।
তবে মনে হয় রাগিণী বঙ্গালী প্রথমে দিব্যরূপিণী ছিলেন না। প্রাচীন ভারতে বনবাসী সমাজে প্রচলিত চার স্বরযুক্ত রাগরাগিণীর মতোই বঙ্গালী ছিলেন বনচারীদের সাংস্কৃতিক সম্পদ। কিন্তু শাস্ত্রীয় নিগড়ে বাঁধতে গিয়ে পরে আরও স্বরের আমদানি করা হয় এবং তখন থেকেই মনে হয় রাগিণী বঙ্গালী দিব্যরূপিণী হয়ে ওঠেন। নবম থেকে একাদশ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত গ্রন্থে জৈন সঙ্গীতজ্ঞ পার্শ্বদেব আবার তাঁর সময়ে প্রচলিত বঙ্গালকে ভাষারাগ রূপে দেখেছেন। এর পর ত্রয়োদশ শতকে দাক্ষিণাত্যে বসে সোঢ়লপুত্র শার্ঙ্গদেব রচনা করলেন ‘সঙ্গীতরত্নাকর’। ভারতীয় রাগবিদ্যার ইতিহাসে এটি একটি প্রামাণ্য বই। বইটিতে অনেক বার বঙ্গালী ও বঙ্গালের উল্লেখ আছে। বঙ্গাল-এর নানা তত্ত্বকথার সঙ্গে শার্ঙ্গদেব একটি তথ্যও দিয়েছেন। সেটা হল, কিন্নরী নামের বীণাবাদকেরা তাঁদের অজ্ঞতার জন্য প্রায়ই বঙ্গাল রাগে ‘পা’ বা পঞ্চম স্বরে বেশি ক্ষণ অবস্থান করেন। বীণায় নির্ভুল বঙ্গাল রাগবাদনের স্বররূপ বাতলে দিয়েছেন শার্ঙ্গদেব। আবার বাঁশিতে কী ভাবে বঙ্গাল রাগ বাজাতে হবে সেই নির্দেশিকাও আছে ‘সঙ্গীতরত্নাকর’-এ। সপ্তদশ শতাব্দীতে পণ্ডিত সোমনাথ তাঁর ‘রাগবিবোধ’-এ বঙ্গালের উল্লেখ করেছেন। অহোবলের ‘সঙ্গীত পারিজাত’, লোচন পণ্ডিতের ‘রাগতরঙ্গিণী’— এই সব বইয়েও কখনও বঙ্গাল কখনও বঙ্গালীকে পাই।
সে কালের ধারা অনুযায়ী সঙ্গীতশাস্ত্রীরা রাগের স্বররূপ বা তত্ত্বকথা লিখেই দায়িত্ব শেষ করতেন না। তাঁরা মনে করতেন বিমূর্ত রাগ যেন আবেগ-অনুভূতিতে তাড়িত এক মানবিক রূপ। সেই চিন্তা থেকেই রাগরাগিণীর ধ্যানমন্ত্রও তৈরি করতেন। দেখি, মহারাষ্ট্রের সঙ্গীতগুণী দামোদর তাঁর ‘সঙ্গীত দর্পণ’-এ বঙ্গালীর ধ্যান রচনা করেছেন। দামোদরের ধ্যানে, বঙ্গালীর গায়ের রং সকালের সদ্য ওঠা সূর্যের মতো। অরুণ বর্ণ। বাঁ হাতে ত্রিশূল আর কাঁখে ফুলের থালা। মাথায় জটাভার। গায়ে ভস্ম প্রলেপ। বলাই বাহুল্য, এ-হেন বঙ্গালী ভৈরবপ্রিয়া হবেই। তাই ভৈরব রাগের পত্নী বঙ্গালী। মুনি নারদও একটু অন্য ভাবে বঙ্গালীর ধ্যান লিখেছেন। এঁর বঙ্গালীর গায়ের রং তামাটে। পরনে নীল শাড়ি। ধীরা-প্রগল্ভা-রতিলালসা তাড়িতা। সঙ্গীতার্য নারদের বঙ্গালীও ভৈরবপ্রিয়া।
এত ক্ষণের আলোচনায় বাঙালির লেখা কোনও সঙ্গীতশাস্ত্র নেই। বাঙালি সঙ্গীতশাস্ত্র রচনায় অপারগ— এই অপবাদ ঘুচল পঞ্চদশ শতাব্দীতে। লহড়িবংশের শুভঙ্কর লিখলেন ‘সঙ্গীত দামোদর’। উল্লেখ্য, এটি ছাড়া প্রাচীন ও মধ্যযুগের বঙ্গে সঙ্গীততত্ত্বের আর কোনও পুঁথি পাওয়া যায়নি। আনন্দের কথা, সঙ্গীতাচার্য শুভঙ্কর কিন্তু ভৈরবপত্নী বঙ্গালীর উল্লেখ করেছেন। প্রাক্চৈতন্যযুগে রচিত বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ পুঁথি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। পুঁথির রাধাবিরহ খণ্ডের চোদ্দোতম পদ গায়নের জন্য নির্দিষ্ট রাগটি হল বঙ্গাল।
কিন্তু আক্ষেপের কথা, বঙ্গালী বা বঙ্গাল রাগ প্রসঙ্গে বাঙালির একমাত্র ঘরানা বিষ্ণুপুর বড়ই কৃপণ। কিছুটা নির্দয়ও বলা যেতে পারে। বিষ্ণুপুর ঘরানাজাত বিশালবপু কোষগ্রন্থগুলির একটিতেও বঙ্গালী বা বঙ্গালের কোনও চীজ বা বন্দিশ নেই। ১৩২১ বঙ্গাব্দে বর্ধমানরাজ বিজয় চাঁদ মহতাবের অর্থানুকূল্যে সঙ্গীতাচার্য গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপিতে ‘সঙ্গীতচন্দ্রিকা’র দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশ করেন। বইটির পরিশিষ্টে তিনি বঙ্গালীর পরিচয়টুকু দিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর অপর সঙ্গীত গবেষক ও গুণী পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে তাঁর ‘ক্রমিক পুস্তক মালিকা’র পঞ্চম খণ্ডে ভৈরব রাগগোষ্ঠীর তালিকায় বঙ্গালী বা বঙ্গালতনয়-বঙ্গালভৈরবকে রেখেছেন। তাঁর মতে বঙ্গালী নামে অন্য এক রাগ আছে। যদিও তিনি বঙ্গালী নিয়ে আর কিছুই বলেননি। আবার বিলাবল ঠাটের পটমঞ্জরী রাগের আলোচনায় লিখেছেন, “ইস্ রাগভেদ কো কোই কোই ‘বঙ্গাল বিলাবল’ ভি কহতেঁ হ্যায়।” কিন্তু ‘সঙ্গীতচন্দ্রিকা’র রবীন্দ্রভারতী সংস্করণে ছত্রিশ রাগিণীর তালিকায় ভৈরবের পত্নীরূপে বঙ্গালী থাকলেও রাগপরিচয়টুকু উধাও! এ ভাবেই ক্রমে গায়কদের কণ্ঠ থেকে, যন্ত্রীদের যন্ত্র থেকে হারিয়ে গেল বাংলায় তৈরি রাগিণী বঙ্গালী ও তাঁর
ছেলে বঙ্গাল। প্রসঙ্গত, ব্রহ্মসঙ্গীত রচনার যুগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে অনেক রাগরাগিণীর প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গালী-বঙ্গাল বা বঙ্গালভৈরবের প্রয়োগ করেননি।
নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব’তে লিখেছেন, ‘‘ভাষা সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানাপেক্ষা চারুকলা ও সঙ্গীতের আবেদন একদিকে যেমন সূক্ষ্মতর অন্যদিকে তেমনই প্রত্যক্ষতর এবং পরিধি হিসাবে বিস্তৃততর।’’ সেই জন্য বঙ্গালী বা বঙ্গাল এই দু’টি নিছক রাগ নয়। প্রাচীন বাঙালির বৌদ্ধিক ব্যাকুলতা ও আবেগের প্রকাশ। আমাদের মানসিক সিলমোহর। কিন্তু আমরা সেই ছাপ চিনতে পারিনি। তাই বিশ্বভারতী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের পাঠ্যক্রমে বঙ্গালী বা বঙ্গালের ঠাঁই হয়নি।
এই লুপ্তপ্রায় বা অপ্রচলিত রাগ দু’টিকে আসরে এবং শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব বাঙালি সঙ্গীতগুণীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy