Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

‘স্বাভাবিক’

ইহার পরও যদি কেহ স্বাভাবিকতা না দেখিতে পান, তাহা অবশ্যই বিরোধীদের চোখের দোষ, মাথারও। দোষটির নামও মন্ত্রিবর নিশ্চিত জানেন।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৪
Share: Save:

প্রতি দিন আগের দিনকে ছাপাইয়া যাওয়া বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের, বিশেষত সেই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর, স্ব-ভাব। সুতরাং রাজ্যসভায় দাঁড়াইয়া তিনি যখন ঘোষণা করেন, কাশ্মীর লইয়া কিছুমাত্র চিন্তা নাই, তাহা একদম ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতে ফিরিয়াছে, তখন অবাক হওয়া অসম্ভব। বাস্তবিক, তিনি ও তাঁহার সহ-রাজনীতিকরা এই দেশকে এমন এক জায়গায় লইয়া আসিয়াছেন, যেখানে তাঁহারা যাহা ইচ্ছা বলিতে পারেন, যে কোনও যুক্তি সাজাইতে পারেন, বোধ-বুদ্ধি-জ্ঞান-তথ্যকে তুড়ি মারিয়া উড়াইতে পারেন। বিরুদ্ধবাদীকে ঘোর আক্রমণ শানাইয়া বলিতে পারেন যে, তাঁহাদের মাথায় যাহা ঢুকিয়া আছে, তাহাতে তাঁহারা এমনই আবদ্ধ যে পরিষ্কার কিছু দেখিতে পাইতেছেন না। তাঁহারা দেখিতে পাইতেছেন না যে, পর্যটকরা কাশ্মীরে দিব্য ঘুরিতে যাইতেছেন। দেখিতে পাইতেছেন না যে, মানুষ সেখানে প্রতি দিন নিহত হইতেছেন না। দেখিতে পাইতেছেন না যে সংবাদমাধ্যম সেখানে কাজ করিতেছে। দেখিতেছেন না যে, সেখানে কার্ফু জারি থাকিতেছে না। ইহার পরও যদি কেহ স্বাভাবিকতা না দেখিতে পান, তাহা অবশ্যই বিরোধীদের চোখের দোষ, মাথারও। দোষটির নামও মন্ত্রিবর নিশ্চিত জানেন। তাহার নাম সেকুলার-ত্বের অসুখ— যাহার পুনর্নামকরণ হইয়াছে সেকুলারিজ়ম। সমগ্র ছবিটিই আঁকিয়া ফেলা হইয়াছে। সেই নব্য ভারত-ছবির একটি অত্যন্ত গুরুতর উপাদান কাশ্মীর। সেই নব্য রাজনীতির কেন্দ্রভূমি জুড়িয়া আছে কাশ্মীরকে ‘শিক্ষা’দানের বিষয়টি। তিনশত সত্তর ধারা তুলিয়া দিয়া সেই শিক্ষাদান ঘটানো গিয়াছে। অতঃপর উত্তর-কাণ্ডে সব কিছুকে স্বাভাবিক বলিয়া দেখানো এখন তাঁহাদের রাজনৈতিক ও আদর্শনৈতিক বাধ্যতা।

তবে কিনা, তাঁহাদের অনুসরণে অন্যদেরও কাশ্মীরকে স্বাভাবিক বলিয়া মানিয়া লওয়াই ভাল। বুঝিয়া লওয়া ভাল যে কাশ্মীরের জীবন সম্ভবত এমন ছন্দেই চলিবে। যেখানে মানুষ নিহত না হইলেই তাহাকে সুসংবাদ ধরা হইবে। মানুষ বাড়ি হইতে না বাহির হইতে পারিলেও বাঁচিয়া থাকিতে পারাই এক বিরাট সৌভাগ্য বলিয়া গণিত হইবে। স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীরা যাইবার সাহস কিংবা স্পৃহা না দেখাইলেও সেগুলি যে মাটির উপর দাঁড়াইয়া আছে, ইহাকেই স্বাভাবিক বলিতে হইবে। চাকরিবাকরি করিলে না যাইতে পারিলে ঠিকই আছে, জঙ্গি বা সেনার গুলিতে মরিলে তো চাকরি করার প্রশ্নই উঠিত না। সংবাদপত্র ছাপিয়া বাহির হইতেছে ইহাই তো যথেষ্ট, তাহাতে স্বাধীন কিছু লিখিবার প্রয়োজন কেনই-বা। কিছু মিথ্যাকেও মানিয়া লওয়া আজকাল স্বাভাবিকের পর্যায়েই পড়ে। যেমন, পর্যটকরা যাইতেছেন লাদাখে কিংবা জম্মুতে— কাশ্মীর উপত্যকায় নহে, কিন্তু সরকারি বক্তব্যের সহিত পর্যটনের হিসাব না মিলিলে সেই হিসাব সামনে আসিবেই বা কেন। সরকারি উদ্যোগে বিদেশি ‘পর্যবেক্ষক’রা কাশ্মীরে ঘুরিয়া আসিবেন, কিন্তু ভারতীয় নেতাদের সেখানে যাইবার অধিকার নাই— ইহাও তো সুবোধ্য, কেননা আজিও তো সকল নেতা সরকারি মতে চলিতে নারাজ। বিজেপি ছাড়া কাশ্মীরের অন্যান্য দলের নেতারা বন্দি আছেন, থাকিবেনই তো— কাশ্মীরি বলিয়া তাঁহারা বিশেষ অধিকার দাবি করিতে পারেন, আর বিশেষ ধরনের স্বাভাবিকতার সহিত মানাইয়া লইতে পারেন না?

মন্ত্রীর মন্তব্যের সূত্র ধরিয়াই বিরোধীরা একটি প্রশ্ন করিতে পারিতেন। এমন নহে তো যে কাশ্মীর বলিতে অমিত শাহদের মাথায় কিছু পূর্বধারণা রহিয়াছে, যাহার ছায়ায় চরম অস্বাভাবিকতাকেও স্বাভাবিক বলিয়া ভ্রম হয়? বিরোধীরা এই প্রশ্ন করিতে পারিতেন, কিন্তু করিবেন না। কেননা, যে কোনও কারণেই হউক, এই ভারতে বিরোধীরা বিরোধিতা করিতে ভুলিয়াছেন। অনর্থ ঘটিলেও চোখ বুজিয়া মুখ বন্ধ করিয়া থাকিতে শিখিয়াছেন। কাশ্মীর প্রশ্নে তো বটেই। ইহাও আর এক ‘স্বাভাবিক’।

অন্য বিষয়গুলি:

Jammu And Kashmir Amit Shah
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy