Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ফুলকলি, শরিফা, কল্পনারাই ঘরের সন্ধ্যাপ্রদীপ

যৌথখামারের ধারণা সফল হয়নি সর্বত্র। কিন্তু যৌথস্বপ্ন বোনার যে পরিক্রমা শুরু হয়েছে তা এই দশভুজাদের হাতে নিরাপদ। একে বাড়তে দিতে হবে। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামমাত্র চতুর্থ শ্রেণিতেই আটকে গেল পড়া। বিয়েটাও টিকল না। নশিপুরের জ্যোৎস্নাও হাল ছাড়ার পাত্রী নন। ছেলে কোলে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়লেন। অভাবে দিন চলে না। বন্ধ হয়ে গেল ছেলের পড়া। কিন্তু হার মানলেন না তিনি।

স্বনির্ভর গোষ্ঠী

স্বনির্ভর গোষ্ঠী

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:০১
Share: Save:

ইসলামপুরের হাজরাপাড়ার ফুলকলি হাজরাকে সবাই একডাকে চেনেন। তিনি ‘অগ্রগামী মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী’র কর্ণধার। এক দিন এই কাজের টানেই চৌকাঠ পেরিয়েছিলেন। তার জন্য শ্বশুরবাড়িতে কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি। লেখাপড়ার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তার পরেই বাল্যবিবাহের শিকার। সেই মেয়েই পরে যা করলেন তা ম্যাজিক বললেও ভুল হবে না। শ্বশুরবাড়িতে একতলার উপরে দোতলা গাঁথলেন নিজের রোজগারের টাকায়। ঘরে এল ১৪ ইঞ্চির রঙিন টিভি। নিজের সংসার ও কাজকে দশভুজার মতো সামলে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন গ্রামবাসীকে। তার পর থেকে প্রতি বছর মেয়েদের নিয়ে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন তিনি। এ বারের বাজেট এক লক্ষ কুড়ি হাজার। পঁয়তাল্লিশ জনের কমিটি। গোটা হাজরাপাড়া হাজির সেই মণ্ডপে। তিনি সাতটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়েছেন পুজোর কাজে। এ বারের থিম সমাজ ও পরিবেশ সচেতনতা। থাকছে বাল্য বিবাহ রদ, ঘরে ঘরে শৌচালয়, সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ ও প্লাস্টিক বর্জনের মতো বিষয়। নিজের মণ্ডপ নিয়ে খুব গর্ব ফুলকলির। তিনি বলেন ‘‘পঞ্চায়েত থেকে পুরস্কার পেয়েছি। মমতা দিদিও দিয়েছেন ১০ হাজার টাকা পুরস্কার।’’

মাত্র চতুর্থ শ্রেণিতেই আটকে গেল পড়া। বিয়েটাও টিকল না। নশিপুরের জ্যোৎস্নাও হাল ছাড়ার পাত্রী নন। ছেলে কোলে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়লেন। অভাবে দিন চলে না। বন্ধ হয়ে গেল ছেলের পড়া। কিন্তু হার মানলেন না তিনি। প্রশিক্ষণ নিলেন পঞ্চায়েতে। বাপের বাড়িতে শুরু করলেন ‘রূপালী গোষ্ঠী’। তার পরে আর পিছন ফিরে তাকাননি জ্যোৎস্না। নিজের বাড়ি করলেন উপার্জনের টাকায়। জোৎস্নার মুখে জয়ীর হাসি, ‘‘দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে বাড়ির আরও কাজ করালাম। এক জায়গায় দশ জনের জিনিসপত্র রাখতে পারব এখন। হলঘরে বসে কাজও করাতে পারব।’’ এখন জোৎস্নার ঘরে আশি হাজার থেকে এক লক্ষ টাকার জিনিস। পাটের ব্যাগ, কার্পেট, দেওয়াল সজ্জার নানা সম্ভার। নিজের দলে ১০ জন মেয়ে নিয়মিত কাজ করছেন। উৎসবে ওদের মুখে হাসি ফুটলেই জ্যোৎস্নার পরীক্ষা পাশের মতো আনন্দ হয়।

হরিহরপাড়ার ৩৩ বছরে মীরা মণ্ডল ‘সিদ্ধিনন্দী স্বনির্ভর গোষ্ঠী’র কর্ণধার। বাড়ি ও শ্বশুরবাড়িতে তিনিই একমাত্র মাধ্যমিক পাশ। বিয়ের পরে তাঁত বোনার কাজ শিখেছেন। এখন নিত্য নতুন ডিজাইনের গামছা বোনেন। পুজোর সময় অনেক অর্ডার আসে। দলে আছে এক পড়ুয়া কন্যাশ্রী যোদ্ধাও। সংসারে শ্রী ফিরেছে। খেতে কাজ করা স্বামীর জীবনেও এসেছে স্বস্তি। মীরা বলছেন, ‘‘কাজ শুরুর দিন থেকে পুজোর মানেটাও বদলে গিয়েছে, জানেন।’’

দৌলতাবাদের ‘ভাগ্যলক্ষ্মী গোষ্ঠী’র কল্পনা মণ্ডলের একার উপরেই সংসারের ভার। প্রথমে নিজে কাজ শিখেছেন। উপার্জনের পয়সায় ছেলেকে কিনে দিয়েছেন টোটো। সঙ্গে আছে দশ জন মেয়ের দল। ইতিমধ্যে তিনি ঘুরে এসেছেন দিল্লি, ওড়িশা, রাজস্থান। তাঁর গোষ্ঠীর জিনিস পাড়ি দিচ্ছে আসানসোল। এ বারে সেখান থেকেই এসেছে পুজোর ডাক। সঙ্গে আছে প্রায় এক লক্ষ টাকার ব্যাগ, মালা, পাখি, ঘর সাজানোর নানা উপকরণ। খুব যে লাভের মুখ দেখেন এমন নয়, তবে সংসার-যাত্রা কিছুটা হলেও মসৃণ হয়েছে।

বহরমপুরের ফেরিঘাট পেরিয়ে আধারমানিকের রিনা চৌধুরী কাচের রকমারি শো-পিস বানান। ‘তুলসিপাতা গোষ্ঠী’র নামে কাজও শুরু করেন। কিছু দিন পরে তিনি উপলব্ধি করেন পরিবারে মধ্যেই বুনতে হবে স্বপ্ন। আগ্রায় থেকে তিন বছর শিখে এসেছেন কাজ। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তিনি এই কাজ করে চলেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনিই মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পরেও মেয়েরা সমান ভাবে রিনার সঙ্গে কাজ করেন। পুজোর সময় মণ্ডপে নানা অনুষ্ঠান হয়। অতিথি আপ্যায়ন ও পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় শো-পিস। তাই অনেক শো-পিসের অর্ডার এসেছে এ বার। সে সব কাজ করতে গিয়ে নাওয়াখাওয়া ভুলেছেন রিনা। পরিবারে একমাত্র ছেলে সেগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকেন।

ইসলামপুরের ‘পুষ্প গোষ্ঠী’র সোনালি হাজরা শাশুড়ির মৃত্যুর পরে কাজ বন্ধ হতে দেননি। মাত্র ২৭ বছরে শক্ত করে ধরে ফেলেছেন গোষ্ঠীর হাত। কডের মাদুর ও ফুল বানান। এ বার পুজোতে কলকাতায় ২৬ টাকা দরে মাদুরের বরাত এসেছিল অনেক। বর্ধমানের পুজো প্যান্ডেলেও গিয়েছে প্রায় সাত হাজার টাকার ফুল। স্বামী মাঠে কাজ করেন। দলের মেয়েদের নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন সোনালি।

সালারের ‘ফতেমা গোষ্ঠী’র শরিফা খাতুনের কাছে এসেছে কাঁথাস্টিচের শাড়ির বরাত। দুর্গাপুজোর থিমে ছয় থেকে নয় হাজার টাকার শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। রাজ্যের বাইরে মুম্বই ও রাজস্থানেও তাঁর শাড়ি যাচ্ছে। মেলার বাইরে পুজোর সময় ব্যস্ততা তুঙ্গে। মেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া আছে কাজ। স্টিচ করা, ডিজাইন আঁকা, রং পছন্দ করা সবটাই শরিফার তত্ত্বাবধানে করছেন মেয়েরা।

নবারুণ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর লায়লা ও তাঁর গোষ্ঠীর মেয়েরা ১০ থেকে ১৮ ইঞ্চির কার্পেট তৈরি করেন। প্রায় এক লক্ষ টাকার বরাত পেয়েছেন এ বার পুজোয়। ১০-১১ ইঞ্চির পাটের কার্পেট তৈরি করতে হবে। পুজোর সময় নানা জায়গায় একাই ‘স্যাম্পেল’ দেখাতে ছোটেন। ট্রেন থেকেই জানালেন, ‘‘ভরসা বলতে এই মোবাইল। মেলা করার পরে জিনিস পছন্দ হলে কখনও রাজ্যের বাইরের ক্রেতারাও মোবাইল নম্বর নিয়ে রাখেন। তাঁরাই বড় অর্ডার দেন।’’

একা শব্দটা এখন একেবারে কোণঠাসা। মুহূর্তে সমগ্র হয়ে ওঠার জন্য দুনিয়া তোলপাড়। নিঃশব্দে দশভুজা হয়ে উঠেছেন যে মহিলারা তাঁরা কিন্তু নিঃশব্দে কাজ করতেই ব্যস্ত। নিজেদের এই বিরাট কর্মজগতের বাইরে তেমন ফুরসত মেলে না। তাঁদের লেখাপড়ার দৌড় খুব বেশি দূর নয়। তার উপরে কাঁধে রয়েছে বিরাট সংসারের দায়িত্ব। কিন্তু সততার সঙ্গে তাঁরা নিজেদের পথ খুঁজে নিয়েছেন। অভাবের সংসারে হাতিয়ার করেছেন কর্মকেই। ওঁরা লড়াই করে প্রাণ ফেরাচ্ছেন পরিবারে।

ফুলকলি, শরিফা, কল্পনারাই আসলে ঘরের সন্ধ্যাপ্রদীপ। তাঁরা অন্ধকারেও পথ দেখান। শিক্ষার বাইরে বিকল্প এক আলাদা উপার্জনের সুযোগকে ওঁরা পরিশ্রম দিয়ে জয় করেছেন। যৌথ খামারের ধারণা সফল হয়নি সর্বত্র। কিন্তু যৌথস্বপ্ন বোনার যে পরিক্রমা শুরু হয়েছে তা এই দশভুজাদের হাতে নিরাপদ। একে বাড়তে দিতে হবে। ভক্তিতে মা দুর্গার কাছে মাথা নত করি বছরে এক বার। রুক্ষ মাটির এই দশভুজারা আমাদের মাথা নত করতে বাধ্য করেন। প্রতিদিন।

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

অন্য বিষয়গুলি:

Self Help Group Berhampore Agragami Self Help Group Durga Puja 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy