অাজ ভগিনী নিবেদিতার ১৫৩তম জন্মদিন
গিরিবালা ঘোষকে জানা আছে? শোনা আছে পারুলের গল্প? আজ ভগিনী নিবেদিতার জন্মদিনে বড্ড মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁদের। গিরিবালা বছর বাইশ-তেইশের এক বিধবা, বালিকা কন্যাকে নিয়ে মামার বাড়ির আশ্রিতা। গিরিবালার খুব ইচ্ছে ‘নিবেদিতার স্কুল’-এ পড়ার। কিন্তু সে কী করে সম্ভব? মেমসাহেবের স্কুল— ম্লেচ্ছ সংসর্গ! গিরিবালার দিদিমা গঙ্গায় স্নান করতে যান রোজ, নিবেদিতার স্কুলের পাশ দিয়ে। এক দিন শুনতে পেলেন সমবেত ভাবে মেয়েরা স্তবগান করছে। বরফ একটু গলল। কিন্তু মেয়ে যাবে কী ভাবে? বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি ঢোকে না যে! নিবেদিতার কানে গেল সে কথা। তিনি সোজা চলে গেলেন গিরিবালার মামার কাছে। তাঁকে বললেন, মেয়েরা গঙ্গাস্নানে তো যায়, কালীঘাটে তো যায়! তা-ই না-হয় মনে করুন তিনি। ১১টা থেকে ৪টে তাঁকে দিন মেয়েটিকে। বলতে বলতে হাঁটু ভেঙে পায়ের কাছে বসে পড়লেন তিনি। সন্ত্রস্ত, বিব্রত মামা তাড়াতাড়ি অন্তঃপুর থেকে ভাগনিকে নিয়ে এসে নিবেদিতার হাতে সমর্পণ করলেন।
আর পারুল? শ্বশুরবাড়ি যেতে না চেয়ে পালিয়ে চলে এসেছিল নিবেদিতার কাছে। থেকে গিয়েছিল তাঁর সঙ্গে। তার নতুন নাম হল সরলা। এই সরলাই হয়ে উঠেছিলেন প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা মাতাজি— শ্রী সারদা মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষা। বিবেকানন্দের স্বপ্নের ‘স্ত্রী মঠ’ সার্থক হল এত দিনে।
নিবেদিতা প্রসঙ্গে এই দু’টি নাম কেন এল সে কথা বলি। নিবেদিতা বললেই ‘লোকমাতা’ রূপটি যত সহজে আসে, তাঁর শিক্ষয়িত্রী পরিচয় তত সহজে আসে না। অথচ তিনি ছিলেন স্বভাব-শিক্ষয়িত্রী। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল (নিবেদিতা) ছাত্রাবস্থা থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষাশেষে যখন তিনি কেসউইকে স্কুলে যোগ দেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭। ১৯ বছর বয়সে রেক্সহ্যাম শহরে নতুন স্কুলে পড়ানো শুরু করেন। সঙ্গে চার্চের কাজও করতেন। চার্চের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিন বছর পরে চেস্টারে নতুন স্কুলে যোগ দেন। পাশ্চাত্যে তখন শিশুশিক্ষা নিয়ে নতুন ভাবনার জোয়ার। এই নতুন শিক্ষানীতির মূল দর্শনই ছিল শিশুকেন্দ্রিকতা। শিশুর আগ্রহ, সামর্থ্য, চাহিদা, পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাদান। শিক্ষাবিদ পেস্তালৎসি এবং দার্শনিক ফ্রেডরিক ফ্রোয়েবলের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা মার্গারেটকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই সময় তিনি উইম্বলডনে নতুন স্কুলে যোগ দেন। ১৮৯২ সালে নিজেই স্কুল খোলেন। শিক্ষিকা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষা বিষয়ে তাঁর বক্তৃতা এবং প্রবন্ধগুলি বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে।
বিবেকানন্দ যখন স্ত্রীশিক্ষা ও নারীকল্যাণের কাজে মার্গারেটকে ডাক দিলেন, তখন তাঁর কাছে ক্ষেত্রটা কাজের জন্য নতুন ছিল না। নতুন ছিল দেশ, মানুষজন, আর এক বৈদান্তিক সন্ন্যাসী। অসামান্য ধী-শক্তিসম্পন্ন এই নারী পরে বহু পাঠ ও ভ্রমণের মধ্য দিয়ে এই দেশকে নিজের মতো করে বুঝলেও, বিবেকানন্দের প্রভাব আমৃত্যু তাঁকে সঙ্গ দিয়েছে। ফলে মেয়েদের বিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা করলেন, সেটা উনিশ শতকীয় ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারণার অনুবর্তী হল না। উল্টো দিকে খানিকটা জাতীয়তাবাদী চরিত্র তাতে দেখা গেল। এ জন্য তাঁকে কিছুটা সমালোচনা এবং অনেকটা উপেক্ষা সহ্য করতে হয়েছে। উনিশ শতকের শিক্ষা-ইতিহাসে ‘নিবেদিতার স্কুল’-কে খানিকটা ব্রাত্য করেই রাখা হয়েছে।
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেই গুরুর দীক্ষায় মার্গারেট হয়েছেন ‘নিবেদিতা’। ভারতবর্ষের জন্য নিবেদিত হয়েছেন তিনি। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করছেন তিনি। আর প্রখর বাস্তবজ্ঞানে বুঝে নিচ্ছেন কোন শিক্ষা প্রয়োজন উত্তর কলকাতার পল্লির মেয়েদের জন্য! কোথায় স্থাপন করেছিলেন স্কুল? কারা সেখানে পড়বে? দীর্ঘদিনের শিক্ষয়িত্রী বুঝেছিলেন— যেখানে বিদ্যালয়, সেইমতো ব্যবস্থা করাই যুক্তিসঙ্গত।
বাগবাজারের পল্লির গোঁড়ামিকে অস্বীকার করেননি নিবেদিতা। তাকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েই জ্ঞানের আলো জ্বালার চেষ্টা করলেন ঘরে ঘরে। কালীপুজোর সন্ধ্যায় শ্রীশ্রীমা উদ্বোধন করলেন বিদ্যালয়ের। ফিতে কেটে ইউরোপীয় কায়দায় দ্বারোদ্ঘাটন নয়, রীতিমতো পূজার্চনা হয়েছিল। প্রতি দিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সমবেত স্তবগান হত। ভাগ্যিস! তাই তো গিরিবালারা স্কুলে যাওয়ার ছাড়পত্র পেলেন! শেখানোর প্রাথমিক উপায় তিনি নির্ধারণ করেছিলেন তাঁর উইম্বলডন স্কুলের অভিজ্ঞতা থেকে। ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া, আলপনা দিয়ে মেয়েদের শিক্ষা শুরু হত। অর্থাৎ পুজো-অর্চনা-ব্রত পালনের অভ্যাস থেকেই মুক্তির উপায় খোঁজা শুরু হল। ক্রমশ পড়ানো হত বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস। ভূগোল-ইতিহাসের ক্লাসে জড়িয়ে থাকত ‘স্বদেশ’, ভারতবর্ষ। প্রসঙ্গত উঠে আসত পুরাণের নারী প্রসঙ্গ— সীতা, সাবিত্রী, সতী; উঠে আসত বীরাঙ্গনা কাহিনি— রানি ভবানী, রানি লক্ষ্মীবাই। নিবেদিতাই কি তবে প্রথম মানবীবিদ্যা চর্চা শুরু করেছিলেন এ দেশে? বাইরের শিক্ষাকে অন্তঃপুরে ঢোকানোর চেষ্টা করেননি নিবেদিতা, যেমনটি উনিশ শতকে হচ্ছিল কোথাও কোথাও। নিবেদিতা অন্তঃপুরকে প্রসারিত করেছিলেন বাইরের দিকে।
তেঁতুলবিচি দিয়ে যোগ-বিয়োগ শিখত মেয়েরা, শিখত জোড়-বিজোড়ের অঙ্ক। মেয়েদের শরীরচর্চার দিকে তাঁর নজর ছিল প্রখর। স্কিপিং করানোর জন্য নিজের গাউনের দড়ি পর্যন্ত খুলে দিতেন। নিজে ব্যায়াম শেখাতেন। কেউ কুঁজো হয়ে বসলে ধরে সোজা করে দিতেন। সেই যুগে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে রক্তের ফোঁটার মধ্যে জীবাণু চেনাতেন তিনি। আর একাদশীর দিন বিশেষ যত্ন নিতেন বিধবা ছাত্রীদের। মেয়েরা একাদশী পালন করত, সমবেত ভাবে স্তব পাঠ করত, আর প্রতি দিন স্কুল বসার আগে গাইত ‘বন্দে মাতরম্’। নিবেদিতা চেয়েছিলেন তাঁর মেয়েরা গর্ববোধ করুক দেশের জন্য। স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকার রূপ ভেবেছিলেন তিনি— লাল রেশমের কাপড়ের উপর সোনালি সুতো দিয়ে বজ্রচিহ্ন সেলাই করে দিয়েছিল স্কুলের মেয়েরা। ছাত্রীদের বক্তৃতা শুনতে নিয়ে যেতেন।
স্বামীজির মহাপ্রয়াণের পর বিদ্যালয়ের কাজে যোগ দিলেন তাঁর মার্কিন শিষ্যা সিস্টার ক্রিস্টিন। বয়সে বড় মেয়েদের নিয়ে গড়ে উঠল ‘বিবেকানন্দ পুরস্ত্রী বিভাগ’। এই মেয়েরা ঘরের কাজ সেরে দুপুরবেলায় আসতেন, মূলত শিখতেন কাটিং আর সেলাই। ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের সঙ্গে তাঁরা বাংলা ও ইংরেজিও শিখতেন। ১৮৮১ সালের জনগণনা শিহরন জাগানো তথ্য সরবরাহ করে। জানা যায় মেয়েদের প্রতি ১০০ জনে ২০ জনই বিধবা এবং তাঁদের বয়স ১-৬০ বছর। এর যে ভগ্নাংশই উত্তর কলকাতার এই পল্লিটিতে থাকুক না কেন,
সে সংখ্যাও খুব কম নয়। বাঙালি হিন্দু বিধবা এবং দরিদ্র পুরস্ত্রীর যথাযথ বৃত্তি শিক্ষা কেন দরকার, নিবেদিতা বুঝেছিলেন।
ভগিনী নিবেদিতাকে নিয়ে বহু আলোচনা হয়। তাঁর তেজস্বিতা, দেশাত্মবোধ, আধ্যাত্মিকতা। কিন্তু হারিয়ে যেতে থাকে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়— তিনি এক অসামান্য শিক্ষয়িত্রী।
লেখক বিদ্যাসাগর কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনারত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy