ভারতে ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সিদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লেখায়।
গত পাঁচ বছরে ভারতে স্নাতকোত্তর শ্রেণিগুলিতে যেখানে এনরোলমেন্ট বেড়েছে ১.৫ শতাংশ, পিএইচ ডি-তে বেড়েছে ৮.৪ শতাংশ। ডাক্তারিতেও আগে এমবিবিএস ডিগ্রিই যথেষ্ট রোমহর্ষক ছিল, এখন এমডি-ও তার জৌলুস হারিয়ে ফেলছে ডিএম-এর কাছে। ডিগ্রি শিকার অভিযানে থেমে পড়লে চলে না। ভারতের পিএইচ ডি উৎপাদন কারখানাগুলির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরাই এই অভূতপূর্ব বৃদ্ধি নিয়ে বিচলিত। মান পড়ে যাচ্ছে বলে হাহুতাশও নিরন্তর। সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে গুণমানের ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কটি যেন স্বতঃসিদ্ধ বলেই ধরে নেওয়া হয়।
এই হাহুতাশ করছেন যাঁরা, তাঁদের সে ডিগ্রি আছে। কোনও ডিগ্রি-অভিলাষী নিজে নিশ্চয় বলবেন না, উচ্চতর ডিগ্রির মানোন্নয়নে আমি ডিগ্রি শিকার থেকে বিরত থাকছি।
‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘শিক্ষা বিস্তারে আমাদের গা নাই। তার মানে শিক্ষার ভোজে আমরা নিজেরা বসিয়া যাইব, পাতের প্রসাদটুকু পর্যন্ত আর কোনও ক্ষুধিত পায় বা না পায় সেদিকে খেয়ালই নাই।’’ এই ‘আমরা’রা উচ্চশিক্ষার মানের অবনতি নিয়ে সতত উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন। আর এই অবনতির কারণ হিসেবে দেখেন এর প্রসারণকে। উচ্চ মাধ্যমিকে অত্যুচ্চ নম্বর পেয়েও একটি যথাযথ বাক্য লিখতে না পারা ছাত্রকে কলেজে ভর্তি করে উচ্চশিক্ষার যে সর্বনাশ হচ্ছে, এ বিষয়ে তাঁরা নিঃসন্দেহ। আর তাদের প্রবেশপথে আরও শক্ত দেওয়াল তোলাকে তাঁরা তার সমাধান হিসেবে দেখেন। মানরক্ষার কারণে বিস্তারকেই ঠেকিয়ে রাখার পক্ষে যে মানসিকতা শিক্ষিত মহলে দেখি, তাকে কি খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়? বিশেষত সংখ্যার হিসেবে উচ্চশিক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ যখন দেশের বেশির ভাগ রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে?
কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে গুণমানের এমন ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক যে স্বতঃসিদ্ধ নয়, তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষায় ‘গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিয়ো’র দিকে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। উচ্চ মাধ্যমিক-পরবর্তী যে কোনও স্নাতক, স্নাতকোত্তর, ডিগ্রি, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট কোর্সে নথিভুক্তের সংখ্যা আর ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সিদের মোট সংখ্যা— এই দুইয়ের অনুপাতকে বলে গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিয়ো, সংক্ষেপে জিইআর। ভারতে উচ্চশিক্ষায় জিইআর ২৫.২ শতাংশ। অর্থাৎ ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সিদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লেখায়। এটা কি অনেক বেশি? ‘ব্রিক্স’ দেশগুলির মধ্যে ব্রাজিল ও চিন দু’দেশেই উচ্চশিক্ষায় জিইআর ভারতের দ্বিগুণ— যথাক্রমে ৫০.৫ এবং ৫০.০ শতাংশ। রাশিয়ায় ৮১.৮ শতাংশ। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় কিছুটা কম— ২০.৫ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির হিসেবে ব্রাজিল, চিন বা রাশিয়ার থেকে ভারত বহু দূর।
শতাংশের হিসেবে এই দেশগুলোয় অনেক বেশি যুবক-যুবতী উচ্চশিক্ষায় যাচ্ছে বলে কি সে সব দেশে শিক্ষিত বেকারও বেশি? তাও তো বলা যায় না। অর্থাৎ বেশি সংখ্যক মানুষ উচ্চশিক্ষায় এলে শুধু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বাড়বে, এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। উন্নত বিশ্বে উচ্চশিক্ষায় জিইআর ৫০ শতাংশের বেশি। সে সব দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যে ভারতের থেকে বেশি, তা বলা যায় না। আবার ভারতের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি জিইআর তামিলনাড়ুতে— ব্রাজিল বা চিনের প্রায় কাছাকাছি। আর পশ্চিমবঙ্গে? ১৮.৭ শতাংশ, যা ভারতের গড় জিইআর-এর থেকে অনেকটা কম। গুণমান ধরে রাখতেই আমরা উচ্চশিক্ষায় ছাত্রস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছি? সত্যি? পশ্চিমবঙ্গে প্রতি লক্ষ ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সিদের জন্যে কলেজের সংখ্যা ১২, সারা দেশের গড় যেখানে ২৮ (সরকারি ও অসরকারি মিলিয়ে)। বিহার (৭) বা ঝাড়খণ্ড (৮) ছাড়া আর কোথাও জনসংখ্যার অনুপাতে কলেজের সংখ্যা এত কম নয়। কর্নাটকে ৫১, কেরলে ৪৪, অন্ধ্রপ্রদেশে ৪৮। পশ্চিমবঙ্গের ‘শিক্ষিত’জনরা রাজ্যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কথা শুনলেই আতঙ্কিত হন। এত কলেজ, এত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ! এ শিক্ষার মান ভাল হতেই পারে না!
মানের অধোগতির অজুহাতে সংখ্যার সঙ্কোচনের মধ্যে যে কিছুটা শ্রেণিস্বার্থ যুক্ত, এ কথা অস্বীকার করা যায় কি? সংখ্যা কম থাকলে সেই স্বল্পসংখ্যক উচ্চশিক্ষিতরা দর বেশি পাবেন সমাজে। লেখাপড়া করার সঙ্গে গাড়িঘোড়া চড়ার সম্পর্কটা তা হলে পোক্ত থাকে। বাসে ওঠার পর এক শ্রেণির যাত্রী যেমন ড্রাইভারকে ক্রমাগত বলতে থাকেন আর কোনও স্টপে না দাঁড়িয়ে বাসটিকে সোজা ছুটিয়ে দিতে, সেই মনোভাবের সঙ্গে এর মিল পাওয়া যায়। তবে অন্য সমস্যাও আছে। কলেজের সংখ্যা বাড়ালেই কি দলে দলে ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষায় এসে ঢুকবে? বর্তমান কলেজগুলিতেই তো আসন ভর্তি হচ্ছে না। তামিলনাড়ু বা কর্নাটকে যেখানে সাধারণ মানের অসরকারি কলেজও ছাত্রছাত্রী পাচ্ছে, এখানে নয় কেন? তাই বুনিয়াদি শিক্ষা ও তার মান, সমাজের সর্বস্তরের শিশুদের যথার্থ গুণসম্পন্ন বিদ্যালয়শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি ও সুযোগের সাম্য, সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের সাম্য বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, এ সব বাদ দিয়ে উচ্চশিক্ষার আলোচনা হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আরও লজ্জিত হতে হয় তফসিলি জাতি ও জনজাতীয়দের মধ্যে এনরোলমেন্ট রেশিয়োর দিকে তাকালে। তামিলনাড়ুতে যেখানে তফসিলি জনজাতীয়ের মধ্যে জিইআর ৪০.৫, পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৯.৯ শতাংশ। অর্থাৎ এ রাজ্যের তফসিলি জনজাতিভুক্ত ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সিদের মধ্যে নব্বই শতাংশই কলেজে প্রবেশ করে না। যাঁরা বলেন পশ্চিমবঙ্গে জাতপাতের সমস্যা নেই, তাঁরা এই অসাম্যের দিকটি দেখেন না, বা দেখলেও একে মেধার অভাবের পরিণতি হিসেবে দেখেন, কারণ এই গোষ্ঠীভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ হয় বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারছে না, বা পারলেও কলেজে ভর্তির ন্যূনতম যোগ্যতামান ছুঁতে পারছে না। এই ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতামানে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে যা প্রয়োজন, তার দিকে কি কখনও নজর দিয়েছি?
তামিলনাড়ু বা কেরলে যে কোনও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলে দেখবেন সেখানে তথাকথিত নিম্নবর্ণের ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এক বার ম্যাড্রাস ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়-এ গবেষকদের কর্মশালায় পড়াতে গিয়েছি। কর্মশালায় তরুণ গবেষকরা নিজেদের গবেষণার কাজও উপস্থাপন করেন। এমন একটি উপস্থাপনা কিছুটা এগোতেই তুমুল তর্ক বাঁধল। তামিল ও ইংরেজি মেশানো সে তর্কের প্রায় কিছুই বুঝছিলাম না। কর্মশালা-সংগঠক অধ্যাপক বুঝিয়ে দিলেন তর্কের কারণ। উপস্থাপনাটি ছিল দলিত ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু সেই গবেষক দলিতদের একটি বিশেষ গোষ্ঠীরই ইতিহাস বলছেন, এবং সেখানে অন্য দলিত গোষ্ঠীদের অবদান তিনি অস্বীকার করছেন, এই অভিযোগে অন্য গবেষকরা তাঁকে বেশ এক হাত নিলেন। এই তর্কে অংশগ্রহণকারী প্রায় সবাই দলিত গোষ্ঠীভুক্ত। পিএইচ ডি ডিগ্রি-অভিলাষী গবেষকদের এমন বিষয় নিয়ে আবেগঘন তর্কে অবতীর্ণ হতে পশ্চিমবঙ্গে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এই তর্কের মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু একটি গবেষণার বিষয় নিয়ে তরুণ গবেষকদের মধ্যে যে গভীর আবেগের প্রকাশ দেখলাম, তা আমার অভিজ্ঞতায় ছিল না।
আমার ধারণা, উচ্চশিক্ষায় বৈষম্যহীন অন্তর্ভুক্তির যে প্রয়াস কেরল বা তামিলনাড়ুতে দেখা যায়, এটা তারই পরিণতি। দলিত গোষ্ঠীভুক্ত এত এত ছাত্রছাত্রী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় প্রবেশ করে, তা এক সামাজিক মন্থনের জন্ম দিতে বাধ্য। সেই মন্থন থেকে অমৃত বা গরল যা-ই উঠে আসুক না কেন, একে অস্বীকার করার বা ঠেকিয়ে রাখার উপায় নেই। এই সমাজবিপ্লব থেকে গা বাঁচিয়ে চলারও উপায় নেই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তফসিলি জাতি ও জনজাতীয়দের কণ্ঠস্বর যে তেমন জোরালো নয়, এ বিষয়টির সঙ্গে শিক্ষায় সর্বজনীনতা ও অন্তর্ভুক্তির দর্শনটি সরাসরি যুক্ত বলে মনে হয়। বস্তুত এটি দুষ্টচক্রের মতো। অন্তর্ভুক্তির অভাবে নিম্নবর্গের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ, আর কণ্ঠস্বরের দুর্বলতার ফলে অন্তর্ভুক্তিও অধরা থেকে যায়।
তামিলনাড়ুর উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা আদর্শ ব্যবস্থা নয়। প্রায়শই দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে ভাঙচুর করার দিক থেকে দেখলে এর প্রগতিশীল ভূমিকা দৃষ্টি এড়াবে না।
লেখক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা-র নির্দেশক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy