ঘটনাবহুল একটা বছর। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি দম ফেলার সময় দেননি। একটা শেষ হতে না হতেই তাঁরা আর একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন। প্রতিটি ঘটনা নিয়েই হয়তো ভবিষ্যতে ভারতের ইতিহাসের পৃথক পৃথক অধ্যায় লেখা হবে। মোদী-শাহ এক অধ্যায় থেকে আর এক অধ্যায়ে হেলায় পা ফেলেছেন।
মোদী সরকারের দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বর্ষপূর্তি এসে গেল শুনে অনেকেই বলছেন, ‘ওহ্, এরই মধ্যে এক বছর কেটে গেল না কি!’ ঘটনার ঘনঘটা হলে কী ভাবে সময় কেটে যায়, টের পাওয়া যায় না।
কিন্তু লক্ষ্যপূরণ হল কি!
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ৩০৩ আসনে জিতে ৩০ মে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী শপথ নিলেন। তার আগে ২৫ মে তিনি সংসদের সেন্ট্রাল হলে এনডিএ-র বৈঠকে সংবিধানে মাথা ছুঁইয়ে ঘোষণা করলেন নতুন লক্ষ্য। ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’-এর সঙ্গে ‘সব কা বিশ্বাস’। সকলের বিশ্বাস অর্জন। সংখ্যালঘু মুসলমানদেরও। সেন্ট্রাল হলের গ্যালারিতে হাজির থেকে সে দিন মনে হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদীই এই ভাবে ইতিহাসের মোড় ঘোরাতে পারেন। বিজেপিকে একার জোরে সরকার গড়ায় উচ্চতায় নিয়ে তিনি কি না এখন মুসলমানদেরও আস্থা অর্জন করতে চান!
দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হল তিন তালাক নিষেধাজ্ঞা আইন দিয়ে। মুসলিম মহিলাদের তাঁদের ‘ধর্ম’ থেকে রক্ষা করতে। তার পর জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ তকমা ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দিয়ে ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ। রেশ কাটতে না কাটতেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। মুসলিম বাদে বাকি সব ধর্মের মানুষকে আশ্রয়। সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি এনে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের বিদায়ের হুঁশিয়ারি। ভারতীয় জনতা পার্টির নিজস্ব আগমার্কা কর্মসূচির আর একটি কাজই বাকি ছিল। তাতে সুপ্রিম কোর্ট সবুজ সঙ্কেত দিয়ে দিল। অযোধ্যায় ‘ভব্য’ রামমন্দির তৈরি হবে, প্রধানমন্ত্রী নিজে লোকসভায় সেই ‘খুশির খবর’ শোনালেন। এতেও যদি অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণ কম হয়ে থাকে, তার জন্য অদূর ভবিষ্যতে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ছিনিয়ে আনার স্বপ্নও দেখানো হল।
কিন্তু ‘সকলের বিশ্বাস’ অর্জন হল কি?
৩৭০ রদ, সিএএ-এনআরসি থেকে অযোধ্যা নিয়ে মোদী সরকারের অবস্থানে দেশের মুসলিম নাগরিকদের বিশ্বাস অর্জন হয়েছে না কি তাঁদের কোণে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। শাহিন বাগ থেকে জামিয়া মিলিয়ার মুসলিমদের বিক্ষোভের বিরুদ্ধে পাল্টা অসন্তোষ উসকে দিতেই উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে হিংসা বেধেছে কি না, তা নিয়েও ময়না তদন্ত হয়েছে। কিন্তু মোদী সরকারের দ্বিতীয় জমানার সাফল্যের খতিয়ানে একের পর এক রাজনৈতিক পালক যোগ হয়েছে।
এই সরকারের প্রথম জমানার পাঁচ বছর ও দ্বিতীয় জমানার এক বছরে এখানেই আসল ফারাক। প্রথম পাঁচ বছরে গরিব মানুষের কল্যাণে একের পর এক প্রকল্প এসেছে। নিখরচায় রান্নার গ্যাসের ‘উজ্জ্বলা’, নিখরচায় বিদ্যুৎ সংযোগের ‘সৌভাগ্য’, মাথার উপরে ছাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, বাড়িতে শৌচাগারের জন্য ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘জন ধন’ প্রকল্পে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, চিকিৎসার খরচ জোগাতে ‘আয়ুষ্মান ভারত’— তালিকা দীর্ঘ। তার মধ্যে গরিব মানুষের আস্থা অর্জনের প্রয়াস, ‘স্যুট-বুট কি সরকার’-এর তকমা ঝেড়ে ফেলার মরিয়া চেষ্টা স্পষ্ট ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় জমানার প্রথম বছরে সেই সরকারেরই নজর ঘুরে গিয়েছে বিজেপির আসল ভোটব্যাঙ্কের দিকে। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ভোট-ব্যাঙ্কের প্রায় সব আকাঙ্ক্ষাই পূরণ হয়েছে। একেবারে বুলেট ট্রেনের গতিতে।
এ দেশে এই বুলেট ট্রেনের স্বপ্নও মোদী সরকারের দেখানো। কিন্তু দ্বিতীয় দফার প্রথম বর্ষপূর্তিতে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় যে দেশের ছবিটাই পাল্টে যাবে, তা বোধ হয় বিজেপির কেউই ভাবেননি। অতিমারির মোকাবিলায় নরেন্দ্র মোদীকে দেশের ‘রক্ষাকর্তা’ হিসেবে তুলে ধরতে বিজেপি ‘মোদী হ্যায় তো দেশ সুরক্ষিত হ্যায়’ বলে স্লোগান তুলবে ঠিকই। কিন্তু দেশের লক্ষ লক্ষ গরিব দিনমজুর কি তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন?
শহর থেকে গ্রামে ফিরতে দেশের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক এখন রাস্তায় নেমেছেন। লকডাউন শেষ হলে তাঁরা আবার কাজ ফিরে পাবেন, এ বিশ্বাস তাঁদের নেই। শহরে থাকলে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত বা মাথা গোঁজার ঠাঁই ঠিক জুটে যাবে, সে বিশ্বাসও চলে গিয়েছে। বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন দেখা ২০২০-র ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে বিশেষ ট্রেন এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে রওয়ানা হচ্ছে। কিন্তু পথ ভুলে অন্য রাজ্যে গিয়ে পৌঁছচ্ছে। তাই দু’দিন অপেক্ষা করলে গ্রামে ফেরার ট্রেন বা বাস ঠিক মিলে যাবে, গরিব শ্রমিকদের মনে এই সামান্য বিশ্বাসটুকুও নেই।
এ তা হলে কেমন ‘সব কা বিশ্বাস’? অথচ ২০১৬-র ৮ নভেম্বর রাত ৮টায় নরেন্দ্র মোদী যখন নোট বাতিল ঘোষণা করেছিলেন, তখন এই গরিব মানুষরাই বিশ্বাস করেছিলেন, রবিনহুডের মতো অসৎ বড়লোকদের উচিত শিক্ষা দিয়ে গরিব মানুষের উপকার করতেই মোদী এই কাণ্ডটা করলেন। এ বছরের ২৪ মার্চও তাঁরা রাত ৮টায় বিশ্বাস করেছিলেন, ২১ দিনের লকডাউন হলেই করোনাভাইরাস হার মানবে।
না হয় ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা ভোটের সময় গ্রামে ফিরতে পারেন না বলে ভোটার হিসেবে তাঁদের দাম নেই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী বাস্তবের সমস্যা জানেন না, তা বিশ্বাস করা মুশকিল। গরিব থেকে মধ্যবিত্ত, শিল্পপতি থেকে ব্যবসায়ী— রোজই হাজার হাজার মানুষের রুটিরুজিতে ধাক্কা লাগছে। তা প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়। লকডাউনের আগে থেকেই অর্থনীতি খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলছিল। এখন হয়তো সব দোষ করোনার উপরে চাপানো যায়। কিন্তু সেই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ‘আউট অব দ্য বক্স’ ভাবনা দূরে থাক, অর্থনীতির একেবারে সেই সার কথা, মানুষের হাতে টাকা তুলে দিয়ে বাজারে চাহিদা বাড়ানোর পথে কেন মোদী সরকার হাঁটছে না, তা বোঝা মুশকিল।
ছয় বছর আগে, ২০১৪-র ১৬ মে লোকসভা ভোটের ফলে নরেন্দ্র মোদীর ভারত জয়ের ঘোষণা হয়েছিল। এই ‘ছে সাল বেমিসাল’ উপলক্ষে বিজেপি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। দেখলে বোঝার উপায় নেই, দেশে কোনও অতিমারি বা লকডাউন চলছে। দিকে দিকে সুখ-সমৃদ্ধির ছবি তুলে ধরে একটাই বার্তা, ভারতের সৌভাগ্য, তাই দেশ মোদীর মতো প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে।
বাস্তব থেকে নজর সরিয়ে রাখার চেষ্টা? না কি শক্তপোক্ত বিরোধী নেতার অভাবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস? পরিকল্পনা ছাড়া চলাটাকেই নিয়ম ভেবে ফেলা?
দেখেশুনে মনে হয়, দেশের সামনে এখন যেন দু’খানা নরেন্দ্র মোদী। প্রথম জন প্রখর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। যিনি বাস্তব চেনেন, দেশের মানুষের নাড়ির স্পন্দন টের পান। তাঁদের এমনই চেনেন যে ভাল করেই জানেন, পাকিস্তানের নাম শুনলেই সওয়া’শো কোটি মানুষের রক্ত গরম হয়ে উঠবে। তিনি ডাক দিলে মানুষ এক কথায় প্রদীপ জ্বালাবে, থালা বাজাবে। আর দ্বিতীয় জন— রাত ৮টার টিভি-র পর্দার নরেন্দ্র মোদী। তিনি আচমকাই উদয় হয়ে ঘোষণা করেন, আর পাঁচশো-হাজার টাকার নোট বলে কিছু রইল না। এই মোদীই রাত ৮টায় উদয় হয়ে সে দিনই রাত ১২টা থেকে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করে দেন। শ্রমিকদের ঘরে ফেরার সময়ও দেন না। কেন রাত ৮টা-তেই এই সব ঘোষণা করতে হয়, কেন আগে বা পরে নয়, সে প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। কিন্তু এই নরেন্দ্র মোদীকে দেখে অনেকেরই মনে হয়, বাস্তবের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই। তিনি নিজের খেয়ালখুশি মতো চলেন।
‘সব কা বিশ্বাস’-এর ঘোষণাকারী মোদীর কোন রূপে মানুষ বিশ্বাস রাখবে, তা সময়ই বলবে। দেশের রক্ষাকর্তা, না কি দেশের অসফল শাসক?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy