ছবি: সংগৃহীত
ইতিহাসের অধ্যাপক লিক্টমান ১৮৬০-১৯৮০ সময়সীমার সমস্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তথ্যকে মিলিয়ে-মিশিয়ে একটা মডেল বানিয়েছেন: দ্য কি’জ় টু দ্য হোয়াইট হাউস। সমীক্ষালব্ধ তথ্যকে মডেলে ফেলে, নির্ভুল অনুমান করেছেন ১৯৮৪ থেকে ন’টা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল, এমনকি ২০১৬-তে ট্রাম্পের জয়ের মতো আপাত-অসম্ভব ঘটনাও। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে, সমীক্ষার সঙ্গে ট্রাম্পের জীবন আর প্রচার-স্টাইল মিলিয়ে আর একটা সাঙ্ঘাতিক অনুমান করেন লিক্টমান। ভবিষ্যতে ইমপিচ্ড বা অভিযুক্ত হবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এর আগে ২৩০ বছরের মার্কিন ইতিহাসে ইমপিচমেন্ট হয়েছে মাত্র দু’জন প্রেসিডেন্টের। ১৮৬৮-তে অ্যান্ড্রু জনসন, ১৯৯৮-তে বিল ক্লিন্টন। অবশ্য ১৯৭৪-এ ইমপিচমেন্টের ভোটাভুটির আগেই পদত্যাগ করেন রিচার্ড নিক্সন।
মার্কিন সংবিধান অনুসারে, বিশ্বাসঘাতকতা, ঘুষ নেওয়া, বা এই ধরনের কোনও বড়সড় অপরাধের জন্য প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্ট সম্ভব। তবে এর অন্তর্নিহিত ফল্গুস্রোত অনেকটাই রাজনৈতিক, নিঃসন্দেহে। হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভের রাজনৈতিক ভারসাম্যটাই এখানে আসল। তবে এটা প্রেসিডেন্টকে পদচ্যুত করার প্রথম ধাপ মাত্র। মূল বিচারটা করে সেনেট। সেই বিচারে অ্যান্ড্রু জনসন বা বিল ক্লিন্টন কেউই অপসারিত হননি। ট্রাম্পও না।
প্রেসিডেন্ট হওয়া ইস্তকই ট্রাম্পকে ইমপিচ করা নিয়ে বিস্তর জল্পনা মার্কিন সমাজে আর রাজনীতির আবর্তে। এমনকি তার আগেই, ২০১৬-র ডিসেম্বরে, ডেমোক্র্যাট সেনেটরেরা, প্রেসিডেন্টকে স্বার্থের সংঘাত ঘটার মতো সম্পত্তি হস্তান্তরিত করতে বলে একটি বিল পেশ করেন। অন্যথায় তা হবে ইমপিচ-যোগ্য অপরাধ। অনেকেই মনে করেন, বিলটির উদ্দেশ্যই ছিল ভবিষ্যতে ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করার পথ প্রশস্ত করা। মার্কিন সংবিধান-বিশেষজ্ঞ অ্যালান হির্শ ২০১৮ সালের বই ইমপিচিং দ্য প্রেসিডেন্ট: পাস্ট, প্রেজ়েন্ট, অ্যান্ড ফিউচার-এ আলোচনা করেছেন, কতটা স্বাভাবিক ট্রাম্পের অভিযুক্ত হওয়া।
ক’মাস আগেই ট্রাম্প আপত্তিকর টুইট করে বসলেন চার জন ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস-উওম্যান সম্পর্কে। এ জন্যে তাঁকে ইমপিচমেন্টের চেষ্টা হয় জুলাইয়ের মাঝামাঝি। ইমপিচমেন্টের বিরুদ্ধে সব রিপাবলিকান ভোট দিলেও, দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন ডেমোক্র্যাটেরা— ৯৫ জন ভোট দেন ইমপিচমেন্টের পক্ষে, ১৩৭ জন বিপক্ষে। অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটেরা ট্রাম্পের কাজকে আপত্তিকর ভাবলেও, ইমপিচমেন্টের উপযুক্ত কারণ মনে করেননি।
হাউস অবশ্য ডিসেম্বরে ইমপিচ করেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। অভিযোগ দু’টি। ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাট জো বিডেন আর তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে চাপ দিয়েছেন ইউক্রেনকে। সেই সঙ্গে তিনি কংগ্রেসকে বাধা দিয়েছেন নিজের বিরুদ্ধে তদন্তে। মোটামুটি পার্টি-লাইন অনুসারে ভোট পড়লেও, দু’জন ডেমোক্র্যাট ভোট দিয়েছেন বিপক্ষে, এক জন ভোট দিয়েছেন একটি মাত্র অভিযোগের পক্ষে, আর তুলসী গাবার্ডের মতো হেভিওয়েট নেত্রী ভোট দেননি কোনও পক্ষেই।
সেনেটে ট্রাম্প ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন, প্রত্যাশিত ভাবেই। কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা কি জানতেন না তা? নিশ্চয়ই ২০২০-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল এই ইমপিচমেন্ট অঙ্কের পিছনে। ট্রাম্পই আমেরিকার ইতিহাসে ইমপিচ্ড হওয়া প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি পুনর্নিবাচনের জন্য লড়বেন। সেনেটের ইমপিচমেন্ট ভোটের ২৭২ দিন পরে সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ ভোট। আপাত দৃষ্টিতে ইমপিচমেন্টের বিশেষ কোনও প্রভাব দেখা যাচ্ছে না জনমতে। আমেরিকা মোটামুটি আধাআধি ভাগ হয়ে আছে ইমপিচমেন্ট নিয়ে, ট্রাম্পের সমর্থনে আর বিরোধিতায়। ডেমোক্র্যাটদের ৮৩% আর নিরপেক্ষদের ৫০% চেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট এবং অপসারণ। ও দিকে রিপাবলিকানদের ৯০%ই এ-সবের বিরুদ্ধে। ট্রাম্প জমানাতে এতটা বড় মাপের ঘটনাও যে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিচ্ছে না দলমতকে, বদলাচ্ছে না মার্কিন রাজনীতির ভারসাম্য, এতে বিস্ময়াভিভূত রিপাবলিকান পোলস্টার বিল ম্যাকইনটার্ফ-ও।
লিক্টমানের মডেলে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে ‘স্ক্যান্ডাল’-এরও। যেমন, অনেকটা ক্লিন্টনকে ইমপিচ করার রাজনৈতিক ফায়দাতেই হয়তো ২০০০-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেছিল রিপাবলিকানেরা। নইলে শান্তি-সমৃদ্ধির সেই সময়ে ডেমোক্র্যাটদের পরাজয় খুব স্বাভাবিক ছিল না। তবে, ‘ফায়ার’ এবং ‘ফিউরি’ নিয়ে অনায়াস সাবলীলতায় লোফালুফি খেলেন ট্রাম্প। সেই সঙ্গে, পোস্ট-ট্রুথের এই সময়কালে, সত্য আর মিথ্যা, ভাল আর মন্দের সীমারেখা হয়ে পড়েছে অস্পষ্ট, ধূসর।
১৯৯৮-তে ইমপিচমেন্টের প্রেক্ষিতে ইরাকে বিমান হামলা শুরু করেন ক্লিন্টন। তার সঙ্গে, আজকের ইরানি জেনারেল কাশেম সুলেমানির হত্যার ঘটনার মিল দেখতে পাচ্ছেন অনেকেই। ট্রাম্পও নির্ঘাত ইমপিচমেন্টকে কোনও ভাবে গণ-সহানুভূতিতে বদলাতে মরিয়া। ইমপিচমেন্টের পটভূমিতে ট্রাম্পের প্রতি অনুমোদন সামান্য হলেও বেড়েছে। গড়িমসি করে, সঠিক রাজনৈতিক মুহূর্ত হাতড়ে, জানুয়ারিতে ইমপিচমেন্টের আর্টিক্ল সেনেটে পাঠিয়েছেন স্পিকার।
কে বলতে পারে, ইমপিচমেন্ট ২০২০-র ভোটে খানিক সাহায্যই করতে পারে ট্রাম্পকে! ইমপিচ্ড হওয়াটা হয়তো অভিপ্রেতই ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের। সজ্ঞানে অথবা অবচেতনে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট।
মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy