মার্কিন কংগ্রেসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সওয়াল-জবাবের দিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার হাজিরা না দেওয়ায়, তাঁহার বসিবার টেবিলে একটি মুরগির মূর্তি রাখিয়া এবং মুরগির মাংস খাইয়া তাঁহাকে বিদ্রুপ করা হইল। কারণ মুরগি ভীরুতার প্রতীক হিসাবে পরিচিত। কেহ যদি কোনও মোকাবিলার ক্ষেত্রে পিছাইয়া যায়, তবে ইংরাজিতে বলা হয়, সে ‘চিকেন আউট’ করিল, অর্থাৎ ভয় পাইয়া পলাইল। একটি খেলাও রহিয়াছে, ‘চিকেন’, যাহা যদিও অর্থনীতির ‘জ়িরো সাম গেম’ বুঝাইতে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু বাস্তবেও খেলা যাইতে পারে। খেলাটি বিপজ্জনক। দুই দিক হইতে দুইটি গাড়ি দ্রুত গতিতে পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইবে। যদি দুইটি গাড়িই সমানে চলিয়া আসিতে থাকে, তবে এক সময় ধাক্কা লাগিবে ও খুব সম্ভব দুই চালকই মারা যাইবে। একটি গাড়ির চালক যদি গাড়ি অন্য পথে ঘুরাইয়া লয়, তবে দুই জনেই বাঁচিবে, কিন্তু যে মোকাবিলা হইতে সরিয়া যাইল, সে ভীরু হিসাবে চিহ্নিত হইবে, অর্থাৎ, মুরগি প্রতিপন্ন হইবে। খেলাটি খেলিতে গেলে, দুই পক্ষকে আন্দাজ করিতে হইবে, অপর পক্ষ কী করিতে চলিয়াছে, সে নির্দিষ্ট পথে চলিলে এই খেলোয়াড়কে সরিয়া যাইতে হইবে, যদি অন্য পক্ষ সরিয়া যাইবার কথা ভাবে তবে নির্দিষ্ট পথে থাকিতে হইবে। কিন্তু এই আন্দাজ সহজ নহে। কিছু দিন পূর্বে মন্দারমণির সৈকতে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় দুই চালকের প্রাণহানি হইয়াছিল, সম্ভবত তাহারা এই খেলাটিই খেলিতেছিল। তাহাদের মধ্যে অন্তত এক জন যদি জয়ী হইবার নেশা অপেক্ষা বিচক্ষণ ভাবে পরাজয় স্বীকারকে কাম্য মনে করিত, তাহাকে হয়তো সামান্য ব্যঙ্গোক্তি সহ্য করিতে হইত, কিন্তু আজ দুইটি প্রাণ ও দুইটি গাড়ি বহাল তবিয়তে বিরাজ করিত।
কিছু হলিউডি ছবিতে এই রোমহর্ষক খেলাটি চিত্রায়িত হইয়াছে। ‘রেবেল উইদাউট আ কজ়’ ছবিতে একটি চরিত্র মারা যায় এইটি খেলিতে গিয়া, ‘ফুটলুজ়’ ছবিতে আবার একটি চরিত্র জিতিয়া যায়, কারণ গাড়িতে তাহার জুতার ফিতা আটকাইয়া যাওয়ায় সে লাফাইয়া পলাইতে পারে না। উভয় ক্ষেত্রেই তরুণ বয়সের বেপরোয়া স্পর্ধা, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা, আত্মসম্মান সম্পর্কে স্ফীত ধারণা, অন্যকে মুগ্ধ করিবার তাগিদের বশে চরিত্রেরা এই খেলায় প্রবৃত্ত হয়। পারমাণবিক যুদ্ধের সমীকরণ বুঝাইতে, বার্ট্রান্ড রাসেল লিখিয়াছিলেন, সরকারগুলির নীতি হইল বিপদের শেষ সীমা অবধি যাওয়া ও পরিণাম আন্দাজ করা, ঠিক চিকেন খেলাটির ন্যায়। দায়িত্বজ্ঞানহীন কমবয়স্ক ছেলেরা খেলাটি খেলিয়া থাকে, তাই এটিকে নীতিহীন ও অধঃপতিত ভাবা হয়, যদিও ইহাতে কেবল দুইটি জীবন বিপদগ্রস্ত হয়। কিন্তু খেলাটি যখন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনায়কেরা খেলেন, নিজেদের প্রাণের সহিত আরও লক্ষকোটি মানুষের প্রাণ বাজি রাখেন। দুই পক্ষেই মনে করা হয়, নিজ পক্ষের নেতাগণ প্রবল সাহস ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতেছেন, কেবল অন্য পক্ষের নেতাগণ নীচ ও নিন্দার্হ। ইহা অবশ্যই উদ্ভট ধারণা। এমন ভয়াবহ বিপজ্জনক খেলাটিতে অংশ লইবার জন্য উভয় পক্ষই সমান দায়ী। এমন হইতে পারে, খেলাটি কয়েক বার খেলা হইলেও কোনও দুর্ভাগ্যজনক পরিণাম হইল না। কিন্তু আজ নয় কাল সকলে অনুভব করিবেই, পারমাণবিক যুদ্ধে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাওয়া অপেক্ষা, সম্মানহানি হওয়া অধিক ভয়ঙ্কর। একটি মুহূর্ত আসিবে, যখন উভয় পক্ষই, অন্য পক্ষ হইতে ‘মুরগি!’ বিদ্রুপ-চিৎকারটি সহ্য করিতে পারিবে না। তখন উভয়পক্ষের অধিনায়কগণ পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে ঠেলিয়া দিবেন। রাসেলের কথাটি সাম্প্রতিক পৃথিবীতে অধিক প্রাসঙ্গিক মনে হইতে পারে, যখন আমাদের চতুর্ষ্পার্শ্বেও যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব করিলে লোককে ‘বীর’, আর যুদ্ধবিরোধিতা করিলে ‘ভীরু’ বলিয়া দাগিয়া দেওয়া হইতেছে।
বাংলায় অবশ্য, সামান্য অশিষ্ট ভাষায়, মুরগি বলিতে বুঝানো হয় ‘পরাজিত’। বা, যে ডাহা ঠকিয়া গিয়া পরাজিত হইয়াছে। খাঁচাবন্দি বা সাইকেল হইতে ঝুলন্ত মুরগি দেখিলে মনে হইতে বাধ্য, ইহারা সতত পরাজিত ও অদৃষ্ট উহাদের ঠকাইয়াছে। সেই ক্ষেত্রে, ইংরাজি ‘চিকেন’ ও বাংলা ‘মুরগি’ বিশেষণগুলি মিলাইয়া বলা যায়, গাড়ি লইয়া খেলাটিতেই হউক, আর যুদ্ধের ক্ষেত্রে অস্ত্র শানাইবার খেলাটিতেই হউক, যাঁহারা সাধারণ্যে মহাবীর বলিয়া বিবেচিত, অর্থাৎ ‘চিকেন হইব না, হুহু করিয়া সম্মুখে ধাইব, যাহা হয় দেখা যাইবে’ ভাবিতেছেন, সেই মাভৈঃ-যাবইঃ রাষ্ট্রপ্রধানেরাই বোধ হয় প্রকৃত ‘মুরগি’, কারণ ‘চিকেন’ হইবার লজ্জা তাঁহাদের স্বাভাবিক শুভবোধ হইতে চ্যুত করিয়া, হঠকারী বানাইয়াছে।
যৎকিঞ্চিৎ
ইয়েতি, ভূত, দাম্পত্য সুখ— এদের অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই বলেই এরা মানুষের ফ্যান্টাসির চির-আদরের ধন। পক্ষিরাজ ঘোড়া বা এল ডোরাডো নেই বলেই তা নিয়ে ‘এমন কেন সত্যি হয় না আহা’ গল্প রচিত হয়। কিন্তু সে সব দিবাস্বপ্ন ও কল্পনালতা যদি সামরিক বাহিনীর কেজো টুইটেও ডালপালা মেলে, মুশকিল, কারণ আর্মির সত্যঝোঁকা হিসেবে নাম আছে। অবশ্য নিন্দুকে বলতে পারে, ভারত যদি বিশ্বাস করে নির্বাচনের ফলে জনদরদি সরকার গজাবে, ইয়েতিতে বিশ্বাস কী এমন অলীক?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy