রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্য দল থেকে নেতা ভাঙানোর প্রতিযোগিতা ততই মনে করাচ্ছে আইপিএল বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে। সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। মাঝের এই সময়টুকুতে কে কাকে ভাঙিয়ে আনতে পারে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে টান টান উত্তেজনা। বাণিজ্যিক ক্রিকেট দল গঠনের সময় ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, এমনকি চোরাগোপ্তা স্লেজিং-দক্ষতার নিরিখেও খেলোয়াড়দের দাম নির্ধারিত হয়, রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রেও যেন অনুরূপ গুণাবলিই প্রত্যাশিত। আইপিএল-এ দেশ বা জাতিসত্তার প্রতি খেলোয়াড়দের আনুগত্যকে উড়িয়ে সর্বোচ্চ দরই হয়ে ওঠে পাখির চোখ। ভারতীয় তথা বঙ্গীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের পরিযায়ী নেতা-নেত্রীদের আচরণ দেখে তেমন ধারণার উদয় অস্বাভাবিক নয়।
কয়েক বছর আগেও সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত জনৈক রাজনীতিক তথা সাংসদ পুলিশ হেফাজতে আদালতে যাতায়াতের পথে বর্তমান শাসক দলের নেতানেত্রীদের নামে নানা অভিযোগ এনে তাঁদেরও জেলে পাঠানোর দাবি জানাতেন। তাঁর সেই দাবি শাসক দলকে এতই বিড়ম্বনায় ফেলেছিল যে পরের দিকে পুলিশকে সেই বিদ্রোহী স্বর চাপা দিতে দেখা গিয়েছিল। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, সেই রাজনীতিকই এখন শাসক দলের ঘোষিত প্রবক্তা। একই দলের আর এক হেভিওয়েট নেতা সারদা-নারদায় অভিযুক্ত হওয়ার পর এখন বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা? ক্ষণে ক্ষণে রং-বদলানো রাজনীতির ময়দানে অনেকেই বিশ্বাস করেন, নীতি ও আদর্শের ফাঁকা বুলিতে আজ আর পেট ভরে না। যেন তেন প্রকারেণ জয়ই একমাত্র লক্ষ্য। সে ক্ষেত্রে প্রতি বলে ছক্কা হাঁকাতে বা বিপক্ষ দলের উইকেট ভাঙতে দক্ষ রাজনীতির ক্রিস গেল বা কাগিসো রাবাদাদের উপযুক্ত মূল্য দেওয়াটা নিন্দার্হ হবে কেন?
উল্টো ছবিটাও বিরল নয়। যে সব রাজনীতিকের পারফরম্যান্স পড়তির দিকে, বা যাঁরা বর্তমান দলে উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না বলে মনে করছেন, তাঁরা দর বাড়াবার জন্যে আগাম ঘোষণা করছেন, ‘দলের হয়ে আর ভোটে লড়ব না’, বা ‘এ বার দল ছাড়ার কথা ভাবতে হবে’। নিজেরই দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে দল বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, এই অভিমানে এক বিধায়ক পদত্যাগপত্র নিয়ে সোজা বিধানসভায় গেলেন। তার পর মনের মতো দরের আশ্বাস পেয়ে পাল্টি খেয়ে পুরো রটনাটাই মিডিয়ার ঘাড়ে চাপালেন।
আবার ক্রিকেটের সঙ্গে খানিক তফাতও আছে। আইপিএল-এ দল গড়ার সময় নিলামে খ্যাতকীর্তি খেলোয়াড়রা কে কত দামে বিকোলেন, তাতে কোনও লুকোছাপা থাকে না। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে নেতাদের দর সচরাচর প্রকাশ্যে আসে না। তা সত্ত্বেও এই গোপন বিকিকিনি এখন নগ্ন হয়ে উঠছে বিভিন্ন দলের কর্তাব্যক্তিদের সদম্ভ ঘোষণায়। কেউ সকলের জন্যে সর্বদা দরজা খোলা রাখার বিজ্ঞাপন করছেন, কেউ আর এক ধাপ এগিয়ে বিরোধী দলের ক্ষুব্ধ বা অবহেলিত, অথচ সম্ভাবনাময় যোদ্ধাকে সম্মানজনক পুনর্বাসনের আগাম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
বাণিজ্যিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দলের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির সাযুজ্য প্রকট করে তুলছে দলের ব্যক্তি-নির্ভরতা। গত দুই লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি নানা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে লড়লেও, দু’টি নির্বাচনেই নির্বাচনের মুখ ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা থেকে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত পর্যন্ত সর্ব স্তরের নির্বাচনে প্রাদেশিক নেতাদের অপ্রধান করে তাঁকে সামনে রেখে লড়েছে বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেসের দলনেত্রী ২০১৬-র বিধানসভার নির্বাচনী প্রচারে রাজ্যের ২৯৪টি আসনে তাঁকে প্রার্থী বিবেচনা করে ভোট দেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন। কংগ্রেস কখনও সনিয়া, কখনও রাহুল গাঁধীকে সামনে রেখে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। বাম আমলেও নির্বাচনের সময় জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের ভরাডুবির অন্যতম কারণ একটা গ্রহণযোগ্য মুখের অনুপস্থিতি।
তবে ক্রিকেটের মতো রাজনীতিও অনিশ্চয়তার খেলা। কখন কার উইকেট পড়ে যাবে, কে জানে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy