সম্প্রতি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রধান ড. সরস্বতী কেরকেট্টাকে তাঁর জাত, গায়ের রং, জন্মস্থান ও লিঙ্গ উল্লেখ করে মানসিক ও শারীরিক হেনস্থা নিয়ে বেশ হইচই হল। ঘটনায় চড়ল রাজনৈতিক রং। যেন এমনটা আগে হয়নি এই রাজ্যে। যে হেতু রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে উচ্চবর্ণেরই আগ্রাসী আধিপত্য, তাই জ্ঞানগর্ভ তর্কে এবং রাজনৈতিক আলোচনায় এটাই দাবি করা হয় যে, পশ্চিমবঙ্গে জাতপাতজনিত বিভেদ অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন সূচকমাত্র। জাতবৈষম্যজনিত কোনও সমস্যাই পশ্চিমবঙ্গে নেই, এমন ধারণাকে যাঁরা সযত্নে জিইয়ে রাখতে চান, তাঁদের গর্বিত কল্পকথা ও সদম্ভ নির্ঘোষ নস্যাৎ করে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষ হিসেবে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এ রাজ্যে জাতপাতের প্রশ্ন মোটেই অবান্তর নয়।
কিছু দিন আগে কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আদিবাসী অধ্যাপিকা জানিয়েছিলেন কী ভাবে শৈশব থেকেই সামাজিক বৈষম্যের প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছে। তাঁর বাড়ির লোকেরা যখন বাবুদের গোলায় ধান তুলে দিয়ে আসে, তখন কী ভাবে বাসস্থান শুদ্ধিকরণের জন্য গোবর জলের ছিটে দেওয়া হয়। জাতগরিমার এমনই মাহাত্ম্য যে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন ব্রাহ্মণ সহপাঠীর গায়ে পা লাগায় সে অনায়াসেই আদিবাসী সহপাঠীকে প্রণাম করতে বলে। স্কুলে পড়াকালীন তিনি যে হস্টেলে থাকতেন, সেখানে দেখেন যে শুধুমাত্র আদিবাসী ছাত্রীদের দিয়েই বাথরুম পরিষ্কার করানো হয়। প্রতিবাদ করলে কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসা করে, ছোট জাতের মেয়ে হয়ে এই ঔদ্ধত্য আসে কোথা থেকে?
সত্যিই তো! আদিবাসীর আবার মান, অপমান, আত্মমর্যাদাবোধ, অসম্মান থাকতে হয় নাকি? উচ্চবর্ণের জন্য যুগ যুগ ধরে সযত্নে সংরক্ষিত এই সব অনুভূতি। তফসিলি জনজাতির পড়ুয়া হওয়ার দরুন তিনি পরে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান এবং রোল নম্বর পিছনের দিকে হয়। এক উচ্চবর্ণের সহপাঠী নিজের মহানুভবতা, উদারতা ও প্রগতিশীলতার তারিফ করে তাঁকে জানায় যে পিছনের রোল নম্বরের সহপাঠীর সঙ্গে সে কেমন বন্ধুত্ব পাতিয়ে এক টেবিলে বসে খায়। গর্ব করার বিষয়ই বটে! কলেজের হস্টেলে থাকাকালীন সহপাঠীর জলের বালতি উপচে পড়তে দেখে তৎপর হয়ে কল বন্ধ করে দিলে সেই সহপাঠী এসে জলভর্তি বালতি উল্টে দেয়। জল যে জীবন, সেটা তো সরকারি প্রচার। সেই জীবনে অস্পৃশ্যের ছোঁয়া লাগাটা কি কম কথা? তিনি সম্প্রতি যে মেসবাড়িতে থাকতেন সেখানকার রুমমেটের মা তাঁকে নাম ধরে না ডেকে, ডাকতেন ‘সাঁওতাল মেয়ে’ বলে। তিনি যখন পাসপোর্ট তৈরি করেন, তখন বিস্মিত হয়ে এই রুমমেট শুধায়, “তুইও আবার বিদেশ যাবি নাকি?”
তাঁর আবার অনন্য এক সমস্যা। আদিবাসী হয়েও তাঁর গায়ের রং ফর্সা। এ হেন কাঁঠালের আমসত্ত্বের দেখা মিলতে দেঁতো হেসে ভদ্রসমাজের সম্ভাষণ: “ওমা, তুমি তো দেখছি আমাদের মতোই দেখতে!” তিনি জানান, এই স্তুতি তাঁর কাছে কতটা অপমানজনক, তা বোঝার ক্ষমতা ভদ্রলোকের নেই। তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেলেন, তখন বিভাগীয় প্রধান জানালেন— আদিবাসী অধ্যাপিকার কাছে নাকি ব্যাকরণ ও তত্ত্বভিত্তিক পেপার পড়তে নারাজ ছাত্ররা। জানি, ও সব শিক্ষিত ভদ্রলোক বাবুদের বংশানুক্রমিক পেশাদারি সম্পত্তি।
অতীতে ফিরি। আমার মা শেলী মুর্মু হিন্দু বাঙালি মহিলা, যিনি ভালবেসে স্নাতকোত্তর স্তরের আদিবাসী সহপাঠীকে বিয়ে করেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা বাঙালি সমাজ, কেউই এই অসম বিবাহের সামাজিক স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে আত্মীয়হীন ছোটবেলায় নিরাপত্তাহীনতাই ছিল আমার সঙ্গী। সঙ্গে যোগ হয় অস্তিত্ব-সঙ্কট। চলতি কথায় ‘ছেলেমানুষ’ থাকার সময়ই আমায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়, আমি ‘প্রান্তিক মানুষ’ মাত্র। শুধুই ‘মানুষ’ হিসেবে বাঁচার অধিকার বা অনুমতি, কোনওটাই আমাকে দেয়নি হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক সমাজ।
যাঁরা মনে করেন জাতভিত্তিক আত্মপরিচয় গঠন এক ধরনের বিভক্তিকরণের রাজনীতির জন্ম দেয়, তাঁদের জানাই যে আমার জন্মগত, জাতভিত্তিক পরিচয় আমাকে সামাজিক দৃষ্টিতে চিরকালীন ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, তখন এই অপরায়ণের বোধের জন্ম হয়। হঠাৎই ক্লাসের মাঝে আমাকে দাঁড় করিয়ে ক্লাসটিচার জিজ্ঞাসা করলেন, আমি ‘এস টি’ কি না। হতভম্ব আমি। আমি যে এমন দু’টি অক্ষরের ধারক-বাহক, এমন কোনও কথাই তো জানায়নি মা-বাবা। ক্লাসে চটপট সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারা আমি এই উত্তরটা জানি না শুনে টিচার বিস্মিত হলেন, না বিরক্ত— ঠিক বুঝলাম না। যেটা বুঝলাম সেটা হল যে আমি এমন একটা কিছু, যেটা ক্লাসের আর কেউ নয়। আমি যেন সবার থেকে আলাদা।
তখন আমি অষ্টম শ্রেণি। ‘এস টি’ অক্ষর দু’টি জীবনে প্রত্যাগমন। বাড়িতে তুমুল অশান্তি, ‘এস টি’ সার্টিফিকেট পেতে হলে ছবি তুলতে হবে। মা বলছেন, আমি যে হেতু পড়াশোনায় ভাল তাই আমার এই সার্টিফিকেট নিষ্প্রয়োজন। বাবা বলছেন, ওটি আমার জাতিগত পরিচয়ের প্রমাণ। আমার আদিবাসী অস্তিত্বের সরকারি স্বীকৃতি। মতানৈক্যের শেষে আমার সরকারি ‘এস টি’ হয়ে ওঠা হল।
পারিবারিক সচ্ছলতার জন্য মোটামুটি ভাল শিক্ষালাভের ফলে রাজ্যের এক ঐতিহ্যশালী কলেজে ভর্তির সুযোগ পাই। স্নাতক স্তরে ইতিহাস (সাম্মানিক) বেছে নিই। তবে এ ক্ষেত্রে আমার সাংস্কৃতিক পুঁজির অভাবটাই লক্ষণীয়। ভারতবর্ষের সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দিল্লির যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জগৎজোড়া, তার নাম আমি কস্মিনকালেও শুনিনি। কলেজের সহপাঠী ভুলবশত দু’টি ফর্ম আনিয়ে ফেলেছিল বলেই সেখানকার প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসা আর নির্বাচিত হওয়া। আঘাত পাই, যখন বুঝি যে আমার ‘এস টি’ পরিচয় এই বন্ধুর পরিবারের কাছেও সর্বশেষ মাপকাঠি। এক দিন এই ব্রাহ্মণ সহপাঠীর বাবা আমার মাকে ফোন করে এক আইএএস পাত্রের সন্ধান দিলেন। হঠাৎ? জানা গেল পাত্রটি তফসিলি জাতিভুক্ত। ব্রাহ্মণ মেয়ের জন্য অচল, তাই আমাকে অকাতরে দান। ফর্মের মতো, পাত্রও বাড়তি পড়েছিল।
দিল্লির সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরের পর গবেষণা করব স্থির করি। আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মতো, দেড় দশকের ওপরে আমার সঙ্গীতচর্চা। সেই ভালবাসা থেকে, আঠারো শতাব্দীর শেষার্ধে বিষ্ণুপুর ঘরানার উত্থান ও বিস্তার নিয়ে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা করব ঠিক করি। আমি যে ইতিহাসকেন্দ্রে পড়াশোনা করি তার চেয়ারপার্সন ভর্ৎসনা করলেন, আমি ভাবলাম কী করে যে আদিবাসী হয়ে মার্গীয় সঙ্গীতের ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে পারব? আমার পক্ষে কাজটা অসম্ভব, কারণ আমি সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল-বহির্ভূত, প্রান্তিক মানুষ। স্তম্ভিত, ব্যথিত হয়ে নতুন বিষয় চয়ন করি।
কলকাতার বুকে এক পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। সমাজে প্রগতিশীল নামে খ্যাত, নানা প্রতিবাদ আন্দোলনের আখড়া এই চাকরিক্ষেত্রে এসেও বর্ণবিদ্বেষের নানা নজির চোখে পড়ে। অতীতে বিভাগীয় মিটিংয়ে ‘সোনার চাঁদ’, ‘সোনার টুকরো’ শব্দগুলো যেমন অবলীলায় ব্যবহৃত হত, তেমনই দেখেছি কী ভাবে উচ্চবর্ণের একাধিক বিভাগীয় প্রধান বিশেষ কিছু পদবি দেখলেই ধরে নিতেন যে তারা লেখাপড়ায় খারাপ হতে বাধ্য। পরীক্ষা নিষ্প্রয়োজন। একদা এ-ও কানে এসেছিল যে, আমার কিছু ছাত্রছাত্রী মনে করে যে আমার থেকে শেখার কিছু নেই, কারণ আমি কেমন ‘আফ্রিকানদের মতো দেখতে’। আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রচিন্তা পড়াতে গিয়ে ক্লাসে-বসা ছাত্রীদের স্বীকারোক্তিও শুনি: ‘ছোট জাত’ আর ‘মুসলিম’ পাত্রকে কখনও বিয়ে করবে না তারা। চিন্তার কথা হল, এখন তারা স্কুলে পড়ায়। বর্ণবিদ্বেষের পরম্পরা জারি থাকবে এদের মাধ্যমে, সেটা ভেবেই আতঙ্কিত হই। শুনেছি তারা এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও মনে করে যে দলিত ও আদিবাসীদের জন্য পৃথক শ্মশান হওয়া উচিত। এই মঙ্গল জয় করা যুগেও তা হলে ‘অস্পৃশ্য, অশুচি’ মানুষরা মরেও তাদের দূষণক্ষমতা হারায় না! তা হবে। ঢেঁকি তো স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে!
ভদ্রলোক সমাজ কী করে সূক্ষ্ম ভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে নামে, বলি। এক সহকর্মী জানিয়েছিলেন যে আমি ‘ঠিক সাঁওতালদের’ মতো দেখতে নই। কৌতূহলবশত ‘ঠিক সাঁওতালদের’ কেমন দেখতে হয়, জানতে গিয়ে বুঝলাম উনি যে চেহারাটার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র দুলির সঙ্গে মিলে যায়। খুঁটিনাটিতে বিশ্বাস রাখা রায়বাবু বোধ হয় ‘সাঁওতাল’ চরিত্র বলেই প্রায়-নির্বাক দুলির ভূমিকায় টিকলো নাক, টানা চোখের অভিনেত্রী সিমি গারেওয়ালকে কালো রং মাখিয়েই চরিত্রায়ণের দায় সেরেছেন।
সদ্যই ইউনিক বুক সেন্টার থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘অভিনব বাংলা অভিধান’। অভিনবই বটে! সম্পাদক ‘অধ্যাপক দেবাশিস দত্ত’ তাতে ‘সাঁওতাল’ শব্দের মানে লিখেছেন “সাঁওতাল পরগনার আদিম অধিবাসী, অসভ্য জাতিবিশেষ।” হ্যাঁ, আমরা অসভ্যই তো। যে নাগরিক সমাজ আমাদের জীবনযাত্রা, জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে জড়িয়ে থাকা অনন্য সংস্কৃতির প্রতি অনাগ্রহ দেখিয়ে সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার নামে সরকারি অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন রিসর্টে, পারিবারিক আনন্দানুষ্ঠানে আমাদের ধরে নিয়ে গিয়ে শুধুই নাচ করায়, সেই ‘সভ্য’ সমাজের প্রতি আমার সুতীব্র ধিক্কার রইল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy