সংযোগ: বিশ্বভারতী আশ্রম প্রাঙ্গণে উপাসনা-গৃহে নববর্ষের অনুষ্ঠান, শান্তিনিকেতন, ২০১৯
সাল ১৯৬২। শমীন্দ্রকুটিরে জোর কদমে মহড়া চলছে। পূজার ছুটির আগে সব ভবনের নাটক হবে। পাঠভবনের মধ্য ও আদ্য বিভাগের পড়ুয়া আমরা করব ‘অচলায়তন’ নাটকের সংক্ষিপ্ত রূপটি, ‘গুরু’ নাটক। আমি পঞ্চকের ভূমিকায়। পরিচালক, তরুণ অধ্যাপক সুপ্রিয় ঠাকুর। ‘অচলায়তন’-এর পাঁচিল পেরিয়ে লুকিয়ে পঞ্চক যায় শোনপাংশু আর দর্ভকদের সঙ্গে দেখা করতে, তাদের সঙ্গে গল্প নাচ গান করে সে শেখে যে, সব কাজ করাতেই আনন্দ আছে। ‘সব কাজে হাত লাগাই মোরা সব কাজেই’— ১৯০১ সাল থেকেই ‘আপন হাতের জোরে’ সৃজন করার মজাটা শান্তিনিকেতনে সবাই জানতেন। ১৯১২ সালে শিক্ষক-কবি রবীন্দ্রনাথ ‘আশ্রমসম্মিলনী’র সূচনা করলেন, যার মূল কথা ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে দৈনিক সমস্ত কাজ করবে, গ্রাম পরিদর্শন, সেবাবিভাগের জন্য দান সংগ্রহের মাধ্যমে সমাজকে চিনবে।
পঞ্চক যেমন কর্মচঞ্চল আনন্দময় গ্রামজীবনে প্রাণের স্পন্দন পেয়েছিল, রবীন্দ্রনাথও তেমনই সেই প্রাণ সঞ্চারের জন্য ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সুরুল সমিতি গঠন করেন। ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারিতেই সুরুল কেন্দ্রের কাজ শুরু এলম্হার্স্টের পরিচালনায়। ১৯২৩ সালে সুরুল সমিতি, ‘শ্রীনিকেতন সমিতি’ নামে উল্লিখিত হয়। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনকে একসঙ্গে যুক্ত করা হয়।
সমবায় প্রণালী অবলম্বন করার স্বপ্ন দেখছেন রবীন্দ্রনাথ সেই ১৯০৪ সাল থেকে, পতিসরের গ্রামীণ ব্যাঙ্কে তা প্রয়োগ করা হয়েছে। এ বার গ্রামের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার বিপক্ষে কাজ শুরু করলেন এলম্হার্স্টরা। ‘ব্রতীবালক সংঘ’ গড়া হল। গ্রামের রাস্তাঘাট মেরামত, জঙ্গল পরিষ্কার, কুইনাইন বিলি, রোগীর সেবা, নিয়মিত খেলাধুলার চর্চাও হল প্রশিক্ষণ পদ্ধতির অঙ্গ।
১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ মিসেস স্যাংগারকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে চিঠি লেখেন। তাঁর দূরদৃষ্টির ফলই হয়তো এখনও শ্রীনিকেতনের ধাত্রীরা গ্রামে গিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করেন। শ্রীনিকেতনের মেলায় শিশু উৎসবে সুস্থ সবল শিশু-কোলে জন্মনিয়ন্ত্রণ, সন্তানপালন নিয়ে ওয়াকিবহাল মায়েদের দেখা যায়।
তবে প্রশ্নও ওঠে— আজকের দিনে এই কাজ কি সব রকম সামাজিক পরিবেশ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে হচ্ছে? বালিপাড়ার শিউলি কিস্কু যখন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে গেটে দাঁড়িয়ে বলেন ‘আমি ভিক্ষা করতে এসেছি’, বুঝতে পারি এখনও স্বামী-পরিত্যক্তা বা মদ্যপ স্বামীর স্ত্রী ও তাঁর শিশু কোনও নিরাপত্তা পান না। এই মহামারিতে বহু আদিবাসী পরিবার ভোটার কার্ড ইত্যাদি দেখাতে না পেরে রেশন পাননি।
এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের বুনিয়াদ সেই সমবায় নীতির কথা মনে পড়ে। সত্যদাস চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণ থেকে জানতে পারি, ১৯২৭ সালে বিশ্বভারতীর চরম অর্থসঙ্কটে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের অধ্যাপক ও কর্মীরা স্বেচ্ছায় তাঁদের স্বল্প বেতনেরও শতকরা দশ ভাগ কম গ্রহণ করেছেন। ভাবি, এই আত্মনির্ভরশীলতা, যৌথ ভাবে কাজ করার ইচ্ছা, সমস্যার মীমাংসা করার ক্ষমতা, সর্বোপরি সাধারণ সভায় মতামত দেওয়ার অমূল্য অধিকার, যা এত সহজে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রে অর্জন করা যায়, সে সব কেন আগের মতো বিশ্বভারতীর উচ্চশিক্ষার স্তরেও রক্ষা করা যায় না! কেন সত্য কথা বললে, প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হলে আজ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়! এ-ই কি সেই মহাপঞ্চকের তর্জনী?
নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধকে দূরে রেখে শান্তিনিকেতন আশ্রম জীবনে গড়ে তোলা হয়েছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক, স্নেহ-ভালবাসার সম্পর্ক। সেই ধারাটি আমরা রক্ষা করতে পারলাম না কেন? গুণী মানুষরা আজ তাঁদের বাড়ির সামনে উঁচু পাঁচিল উঠতে দেখে অসহায়, নিরুপায় বোধ করছেন। অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাড়ি ঘিরে পাঁচিল ওঠার পর বলেছিলেন, “এখন নিজের বাড়ি চিনে ফিরে আসতে পারছি না।” এই পাঁচিল না দিয়ে কি গাছ দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে ঘেরা যেত না?
ইংরেজ যুবক পিয়ার্সন প্রথম আশ্রমে এসেছিলেন ১৯১২ সালে। ১৯১৫ থেকে স্থায়ী ভাবে থেকে শিক্ষকতা শুরু করেন। আদিবাসী সমাজের মানুষজন ভালবাসতেন। গরিবদের জন্য একটি ছোট চিকিৎসালয় খোলেন। ১৯২৩-এ ইটালিতে হঠাৎ মৃত্যু হলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নামে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তিন পুরুষ ধরে এই হাসপাতালের ডাক্তারদের কাছে ঋণী। এখন এর কলেবর বৃদ্ধি হলেও অনেক ব্যবস্থাই এখনও করা হয়নি। চিকিৎসার আধুনিক সুযোগসুবিধা পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে বিশ্বভারতী সম্প্রতি স্থির করেছে, অবসরপ্রাপ্ত কর্মী বা অধ্যাপকরা আর বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ পাবেন না। সমৃদ্ধি কি সত্যিই স্বস্তি আনে? না কি যখন অর্থ ছিল কম, তখনই হৃদয় ছিল মুক্ত ও উদার?
১৮৯০ সালে যে দিন প্রথম উপাসনা গৃহটির (যাকে আমরা মন্দির বলি) উদ্বোধন হয়, সে দিন আমাদের কর্তাদাদামশাই অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত বর্ণনায় পাই, “এস্থান সাধনার অতীব অনুকূল, যেমন নির্জন, তেমনি শান্তিময়, পবিত্র ও রমণীয়। এখানে আসিলে সংসার-কোলাহল আপনিই অন্তর্হিত হয়।” সে দিনের উপাসনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “রবীন্দ্রবাবুর প্রাণস্পর্শী সুমধুর সঙ্গীতে সকলেই বিশেষ মুগ্ধ হইয়াছিলেন।”
মনে পড়ে, ছোটবেলায় মন্দিরে কত ধরনের উপাসনা শুনেছি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’ ভাষণগুলিতে পড়েছি, প্রাত্যহিক জীবনের কত মানসিক গ্লানি, কত মনের বাধা, প্রশ্ন, দুঃখবোধ তিনি সেখানে প্রকাশ করেছেন। সে সব আত্মজিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে যেন এক বোধের ব্যাপ্তি প্রকাশ পেত।
১৯৪০ সালের জুলাই মাস, ৮ শ্রাবণ ১৩৪৭। রবীন্দ্রনাথ তখন অসুস্থ, বুধবারের উপাসনায় আসতে পারেন না। জানতে পারলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী এবং কিছু অধ্যাপক মন্দিরের সাপ্তাহিক উপাসনায় যোগদান বন্ধ করেছেন। ২৪ জুলাই বুধবারের বর্ণনা দিয়েছেন শান্তিদেব ঘোষ। ভোরবেলা গিয়ে দেখেন রবীন্দ্রনাথ নিজে এসেছেন, ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও। বললেন তিনি, “যে কারণেই হোক তোমাদের মন এখন আর প্রস্তুত নেই আশ্রমের সকল অনুষ্ঠানের সকল কর্তব্যকর্মের অন্তরের উদ্দেশ্যটি গ্রহণ করতে, এ কথা অস্বীকার করে লাভ নেই। এর জন্য শুধু তোমরা নও, আমরা সকলেই দায়ী। এখানে একাগ্রচিত্তে সর্বদা আকাঙ্ক্ষা করেছি, বর্তমান কালের তুচ্ছতা, ইতরতা, প্রগলভতা সমস্ত দূর করতে হবে। যাদের শিক্ষাদানের ভার গ্রহণ করেছি, ভারতের যুগান্তকারী সাধনার অমৃত-উৎসে তাদের পৌঁছে দিতে পারব, এই আশাই ছিল অন্তরের গভীরে। কোনোদিনই খণ্ডভাবে আমি শিক্ষা দিতে চাইনি। ক্লাসের বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাদের শিক্ষার সমগ্রতাকে আমি কখনও বিপর্যস্ত করিনি।... আজ বার্ধক্যের ভাটার টানে তোমাদের জীবন থেকে দূরে পড়ে গেছি। প্রথম যে আদর্শ বহন করে এখানে এসেছিলুম, আমার জীর্ণ শক্তির অপটুতা থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে নিজের হাতে বহন করবার আনন্দিত উদ্যম কোথাও দেখতে পাচ্ছিনে। মনে হয় এ যেন বর্তমান কালেরই বৈশিষ্ট্য। সব কিছুকেই সন্দেহ করা, অপমান করা, এতেই যেন স্পর্ধা। আধুনিক যুগের শ্রদ্ধাহীন স্পর্ধা দ্বারা এই তপস্যাকে মন থেকে প্রত্যাখ্যান করো না।... সেই আশা-পথের পথিক আমরা, নূতন প্রভাতের উদবোধন মন্ত্র শ্রদ্ধার সঙ্গে গান করবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি, যে শ্রদ্ধায় আছে অপরাজেয় বীর্য, নাস্তিবাদের অন্ধকারে যার দৃষ্টি পরাহত হবে না।...” এক বছর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের ভাষায় অন্তরে মহা-অজানার নির্ভয়পরিচয় লাভ করেন।
বাইশে শ্রাবণ দিনটি আশ্রমিকদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আশ্রমপ্রধান ও আচার্যের উপস্থিতি সে দিনটিতে একটি শ্রদ্ধাময় গাম্ভীর্যে বাঁধা থাকে, সমস্ত আশ্রমিক অন্তরে তা অনুভব করেন। অথচ এই বছর এর এমন ব্যতিক্রম ঘটল যা আকস্মিক এবং বেদনাদায়ক। এক মজলিশি মেজাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ও আচার্য কথোপকথন শুরু করলেন। হাস্যরসিকতার সঙ্গে ‘আর্য ও অনার্য’-এর সংঘাতের কথা বলা হল। দুই পৃথিবীর দ্বৈততা স্পষ্ট হয়ে গেল। মনে করিয়ে দিল যে, এ হল প্রগল্ভতা ও গাম্ভীর্যের দ্বৈততা, অজ্ঞতা ও যথার্থ ইতিহাসবোধের দ্বৈততা। সর্বোপরি, অশ্রদ্ধা ও আন্তরিক নম্রতার সংঘাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy