সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় দেশ জুড়েই পথে নেমেছেন প্রতিবাদীরা। পিটিিআই
নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে, বইছে প্রতিবাদের ঝড়। আজকের এই অশান্ত পরিবেশে বিসমিল আজিমাবাদীর একটা কবিতা মনে পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে। 'সরফরোশি কি তামান্না'। স্বভাবতই একটি স্বদেশপ্রেমী কবিতা। ইংরেজ রাজত্ব চলার সময় বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী রামপ্রাসাদ বিসমিল এই কবিতাকে রণহুঙ্কার হিসেবে বিখ্যাত করেছিলেন। এ ছাড়াও আশফাকুল্লাহ খান, ভগত সিংহ এবং চন্দ্রশেখর আজাদের মতো নবীন প্রজন্মের স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও এই কবিতার বহুল ব্যবহার করেছেন।
এখানে রামপ্রাসাদ বিসমিলের (১১ জুন, ১৮৯৭ -১৯ ডিসেম্বর, ১৯২৭) পরিচয় দেওয়াটা জরুরি। ১৯১৮ সালের মইনপুরি চক্রান্তে এবং ১৯২৫ সালের কাকরী চক্রান্তে রামপ্রাসাদ অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বহুবার গর্জে উঠেছিলেন। এ ছাড়াও রামপ্রাসাদ একজন উঁচুদরের কবি ছিলেন। হিন্দি ও উর্দুতে সাহিত্যচর্চা করেছেন। তিনি 'বিসমিল' নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এখানে বলে রাখা ভাল যে 'বিসমিল' হিন্দুস্থান প্রজাতান্ত্রিক সংঘের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
এই নিরিখে আরেকজন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিচয় দেওয়া প্রয়োজনীয়। আশফাকুল্লাহ খান (২২ অক্টোবর, ১৯০০– ১৯ ডিসেম্বর, ১৯২৭) ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অবিসংবাদী পুরোধা। হিন্দুস্থান প্রজাতান্ত্রিক সঙ্ঘের কাজকে নতুন দিশা দেওয়া এবং অস্ত্র কেনার জন্য আন্দোলনকারীরা লখনউয়ের কাছে কাকড়িতে একটি ব্রিটিশ ট্রেনে সরকারি টাকা লুন্ঠন করে। পরে ফৈজাবাদ জেলে ১৯২৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর আশফাকুল্লাহকে ফাঁসি দেওয়া হয়। শহীদ আশফাকুল্লাহ এলাকার এবং দেশের মানুষের কাছে এখনও কিংবদন্তীসম। তাঁর অসম সাহস, তুলনাহীন দেশভক্তি, পরিষ্কার চিন্তাধারা এবং আনুগত্যের জন্য।
আরও পড়ুন:ফুঁসছে দেশ, নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে রাজ্যে রাজ্যে বিক্ষোভ
১৯ ডিসেম্বর দিনটি তখন থেকেই শাহাদাত দিবস (শহিদ দিবস) হিসেবে পালন করা হয়। বছরের আরেকটি দিন শহিদ দিবস রূপে উদযাপিত হয়। মার্চ ২৩। ওই দিনেই ভগৎ সিংহ, সুখদেব এবং রাজগুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
বিসমিল এবং আশফাকুল্লাহ অগণ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রাণিত করেন এবং 'সরফরোশি কি তামান্না' বাড়িতে বাড়িতে পারিবারিক গানে পরিবর্তিত হয়। মনোজ কুমার অভিনীত ভাগত সিংহের জীবন ভিত্তিক ছায়াছবি 'শহিদ'-এ এই গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এ ছাড়াও আরও অনেক সিনেমাতে এই গানটি ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৯৯ সনের আমির খান অভিনীত ছবি সরফরোশ-এর একটি গানে এই রণহুঙ্কার ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০০২ সনের হিন্দি ছায়াছবি 'দি লিজেন্ড অফ ভগৎ সিং'এও এই কবিতা ব্যবহার করা হয়। ২০০৬ সনে নির্মিত জনপ্রিয় ছায়াছবি রং দে বসন্তিতে এই কবিতা আবার ব্যবহার করা হয়। ২০০৯ সনে নির্মিত এবং অনুরাগ কাশ্যপ পরিচালিত ছায়াছবি গুলালেও আমরা এই কবিতার ব্যবহার দেখতে পাই।
আরও পড়ুন:অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি করেই যুবসমাজকে খেপানো হচ্ছে না তো?
আজকের পরিবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের একশোটার বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে পড়েছে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করতে। সুশীল সমাজ, বামপন্থী এবং বিরোধী দলগুলো এই আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ ভাবে সমর্থন করছে। তাঁদের মতে এই আইন ভারতবর্ষের সংবিধানবিরোধী, অগণতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক। এই আইন দ্বিজাতি তত্ত্বকে বৈধতা দিচ্ছে এবং ভারতের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করছে।
এখানে আমাদের বুঝতে হবে নয়া নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী কি হতে চলেছে। এই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্থান থেকে আগত ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর লোকেদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ মুসলমান সম্প্রদায় ছাড়া সবাই ভারতে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে সক্ষম। এখানে বোঝা খুব কঠিন নয় যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেওয়া আইনটির লক্ষ্য নয়। তাহলে শ্রীলঙ্কার তামিলদের, নেপালের মাধেসিদের, মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের এবং পাকিস্তানের আহমেদিয়াদেরও এই আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হতো। এই আইন বৈষম্যমূলক এবং সংবিধানের ধারা ১৪, ১৬ এবং ২৫এর পরিপন্থী।
এখানে আসামের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) সম্বন্ধেও বলে রাখা ভাল। অসাংবিধানিক এই প্রক্রিয়ায় ১৯ লক্ষ্ মানুষ আজ পরিচয়হীন এবং রাষ্ট্রহীন ভাবে বাঁচতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন দেশজুড়ে এনআরসি হবে। তখন মুসলমান ছাড়া কাউকেই কোনও দলিল পেশ করতে হবে না। নয়া নাগরিকত্ব আইন আসলে দেশজুড়ে এনআরসি করার প্রথম সোপান। এবার শুরু হবে মুসলমান তাড়ানো। অসমে নাগরিকত্ব প্রমাণ করার শেষ তারিখ ছিল ২৪ মার্চ, ১৯৭১। দেশজুড়ে এনআরসি হলে এই তারিখ কি হবে সে বিষয়ে এখনও কোনও স্বচ্ছতা নেই। এই অস্বচ্ছতার সাহায্য নিয়ে মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করার জঘন্য চক্রান্ত চলছে। এই জন্যেই দেশজুড়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা এই আইনের বিরোধিতা করছে। উত্তরপূর্বাঞ্চলের লোকেরা এই আইনের বিরোধিতা করছে কারণ তারা মনে করে যে বাংলাদেশ থেকে আগত লোকেরা স্থানীয় ভাষা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এখানে বলে রাখা ভাল যে পাকিস্তানের হিন্দুরা এই আইনকে নাকচ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী তির্যক মন্তব্য করেছেন যে বাংলাদেশের লোকেদের ভারতে আসার কোনো কারণ নেই যখন বাংলাদেশের জিডিপি ৮ শতাংশ এবং ভারতের শুধুমাত্র ৪ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে শুধুমাত্র ৩৩,০০০ দীর্ঘমেয়াদি ভিসার দরখাস্ত রয়েছে ভারতে, সেখানে ১ লক্ষ থেকে বেশি শ্রীলঙ্কার তামিলরা ভারতের নাগরিকত্বের প্রত্যাশী।
আরও পড়ুন:বেঙ্গালুরুতে হেনস্থা রামচন্দ্র গুহকে, দিল্লিতে আটক যোগেন্দ্র যাদব, প্রতিবাদ মমতার
আজকের এই পরিস্থিতিতে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের উচিত এই আন্দোলনকে অহিংস রাখা। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই আন্দোলনের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখা।
আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে এই আন্দোলন ভারতের সংবিধান রক্ষার, কোনও বিশেষ সম্প্রদায়কে রক্ষার নয়। এই আন্দোলন হোক ভারতের মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিকে নতুন দিশা দেওয়ার, হোক দারিদ্র এবং বেকারত্বের বিরুদ্ধে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে কোনও ভাবেই যেন গণতন্ত্রের উপরে আঘাত না আসে।
আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই এইসব আইনের প্রণয়ন করছে। আমরা যদি পরিস্থিতির চাপে দেশের সম্পদ ধ্বংস করতে শুরু করি, তাহলে এই আন্দোলন জন্ম নেওয়ার আগেই নিহত হবে।
আজকে যখন আমাদের পিঠ দেওয়ালে থেকে গিয়েছে তখন আমাদের এই বাঁচার লড়াইতে সবাইকে শামিল হতে হবে – আজকে, কালকে এবং আরও বহুদিন। ভারতের হাজার বছরের ইতিহাসে এই আন্দোলন হয়তো সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের পথ দুর্গম। কিন্তু আমাদের এই পথ অতিক্রম করতেই হবে আজকের প্রজন্মের জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তাই আজকে আমাদের হৃদয়েও 'সরফরোশি কি তামান্না'।
(লেখকদ্বয় শিক্ষাবিদ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy