সামাজিক মাধ্যম, মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে চলেছে বিশ্ব জুড়ে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে যে ভাবে যান্ত্রিক যোগাযোগ ও ভার্চুয়াল সম্পর্কের ব্যবহার বাড়ছে, তাতে মানুষের আনন্দিত হওয়ার বিশেষ কোনও কারণ আছে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন অবশ্যই ওঠে। নেট প্রযুক্তির সবকিছুই খারাপ, তা অবশ্যই নয়। সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে মানুষের জানার দুনিয়া অনেকটাই হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে। মুঠোফোনের সাহায্যে জ্ঞানার্জনের পথ সুগম করে ফেলেছে আধুনিক মানুষ।
কিন্তু প্রশ্ন এটাই যে, এই আধুনিক প্রযুক্তি কতটা ব্যবহার করছেন বয়স্ক মানুষেরা? ব্যবহার করছে মূলত আজকের প্রজন্ম। তার বেশির ভাগই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আঠারো ১৮ বছরের নীচে। সমস্যা সেখানেই। যার ফলে বই পড়ার অভ্যাস ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ট্রামে, বাসে, ট্রেনে, বিমানবন্দরে সর্বত্র নতুন প্রজন্ম ব্যস্ত মুঠোফোনে। হয় গান, নয় সিনেমা, নয় তো সামাজিক মাধ্যম। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নিজস্ব ভার্চুয়াল জগতে ঠাঁই নিয়েছে। যে কারণে বাড়ছে যান্ত্রিকতা।
সেই সঙ্গে আরও একটি নেশা মহামারীর মতই ছড়িয়ে পড়ছে দুনিয়া জুড়ে। সেটা অনলাইন শপিংয়ের। প্রলোভন সামলানোর স্বাভাবিক চেতনা অপ্রাপ্তমনস্কদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তাই তার ফলে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি।
আমেরিকার লেখক তথা শিক্ষক ব্র্যাড হ্যাডেলস্টোন সেলফোনের নেট প্রযুক্তিকে নতুন এক ড্রাগ বলে অভিহিত করেছেন। যাকে বলা হচ্ছে ‘ডিজিটাল ড্রাগ’। আবার, আয়ারল্যান্ডের ম্যাক এলাহ্যাটন সোশ্যাল ওয়েবসাইটগুলোকে ‘ডিজিটাল কোকেন’ বলে অভিহিত করেছেন। মাত্রাতিরিক্ত সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের কারণে অতিমাত্রায় প্রভাব পড়ছে নাগরিক জীবনের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পারিবারিক জীবনেও। মানবিক সম্পর্কগুলো হারিয়ে যাচ্ছে এই যান্ত্রিক নেশার কারণে। এটাই সবচেয়ে দুঃখের। নিজেকে ক্রমশ যন্ত্রের কাছে সঁপে দিয়ে আধুনিক প্রজন্মের একাংশ হয়ে উঠেছে ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা। বাস্তব জীবনে মানুষ এখন নিঃসঙ্গ।
সেই কবে গৌতম চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে/ স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে/ ড্রয়িংরুমে রাখা বোকাবাক্সতে বন্দি’। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আজ আর শুধু বোকাবাক্সই নয়, পৃথিবী বন্দি মুঠোফোনে। নতুন প্রজন্মের কতজন আজ কাগজের বই পড়ে? যাবতীয় বিনোদনের উপকরণ এখন হাতের মুঠোয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে আজ মুহূর্তের মধ্যে হয়ে যাচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক। কত সহজে মানুষ কত নির্লিপ্ততা নিয়ে দেখে যাচ্ছে সামাজিক অধঃপতন। আমরা শুধুই কাগজকলমে, সেমিনারে আলোচনার পর আলোচনা করে যাচ্ছি। কিন্তু আধুনিকতার নামে ডিজিটাল জঞ্জাল তথা ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির জগতে গ্রস্ত হয়ে পড়ছে কত নিষ্পাপ মন! তারই ফলে এক প্রবল মানসিক ব্যাধি। পরিবারের পর পরিবার এক নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সন্তানদের এই ডিজিটাল কোকেনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে দেখে। কিন্তু কিছুই কি করার নেই?
ঊনবিংশ শতাব্দীতে আফিমের নেশায় বুঁদ করে ইংরেজরা চিনের জনগণের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ, যেমন, মারিজুয়ানা, হেরোইন, ব্রাউন সুগার, কোকেন, গাঁজা প্রভৃতির কারণে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেরুদণ্ড অনেকাংশে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেই ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের গোড়া পর্যন্ত ভিয়েতনামে শক্তিশালী আমেরিকান সেনাবাহিনীর পতনের অন্যতম কারণ ছিল ড্রাগের নেশা। আর আজ ঠিক একই ভাবে আধুনিক প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে, বিশেষত মুঠোফোনে সোশ্যাল মিডিয়ামের ব্যবহার নতুন প্রজন্মকে মানসিক ভাবে ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছে। এটা কাঙ্ক্ষিত নয়।
মানসিক তথা সামাজিক ব্যাধির বিভিন্ন ক্ষেত্রকে নতুন কাঠামো দিচ্ছে মুঠোফোন-সংস্কৃতি। কাউকে দোষারোপ করার বিষয় নয়। কারণ, প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে প্রয়োজনের ভিত্তিতেই। কিন্তু আমরা তার জরুরি ব্যবহার না করে ক্রমশ ভার্চুয়াল জীবনে নিজেদের না পাওয়ার আনন্দকে উপভোগ করে চলেছি। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতোই যেন এখন সামাজিক মাধ্যম, মুঠোফোন অতি-প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ এখন ভার্চুয়াল নেশায় মগ্ন। মানুষ যে এক সামাজিক প্রাণী, সেই বোধটাই হারিয়ে ফেলছি আমরা। সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চির একটা ছোট যন্ত্র মানুষকে যান্ত্রিক করে তুলছে। কত কিছু হারিয়েছি আমরা! সামাজিক আড্ডা-মুখর মানুষ এখন কতটুকুই-বা আড্ডা দেয়? কতটুকুই-বা বই পড়ে? প্রত্যেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আত্মমগ্ন।
যে কোনও জনবহুল জায়গায় গেলেই দেখা যায়, সমাজের একটা বড় অংশ মুঠোফোনে মগ্ন। সকলের দৃষ্টি শুধু সেখানেই। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে নিজেকে আলাদা করে এক অতীন্দ্রিয় জগতের মানুষে ক্রমশ পরিণত হচ্ছি আমরা। ‘ডিজিটাল কোকেন’ নামক এক সর্বগ্রাসী নেশার মাদকতায় বিলীন হয়ে যাচ্ছি!
(লেখক শিলিগুড়ির বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy