সৈয়দ আবদুল রহমান গিলানি। —ফাইল ছবি
হোটেলের ঘরের আলো কিছুটা বা ম্লান। বিছানায় বসে কথা বলে চলেছেন, কিছুটা যেন স্বগতোক্তির ঢঙে, কিছুটা বা গভীর বোধ থেকে... মৃদু অথচ দৃঢ়। ভারতীয় সংসদ ভবনে হানাদারির ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতারি, পুলিশি হেফাজতে থাকা, নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট হয়ে অবশেষে মুক্তি— সুদীর্ঘ সেই নরক-সুড়ঙ্গের অবসান শেষে আলো দেখে কী উপলব্ধি হয়েছিল সৈয়দ আবদুল রহমান গিলানির? বিষণ্ণ হেসে গিলানি বলেছিলেন, ‘‘কোনও রাষ্ট্র যে তার কোনও নাগরিকের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে পারে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।’’ আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে সে দিন আরও অনেক কিছু বলেছিলেন গিলানি। রাষ্ট্রশক্তির মুখোশ, বিচারব্যবস্থা, হেফাজতে নারকীয় অত্যাচার— অনেক কিছু। সঙ্গত কারণেই সব কিছু লেখা যায়নি।
গত ২৪ অক্টোবর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষার প্রাক্তন অধ্যাপকের মৃত্যুর খবর পেয়ে এ সব মনে পড়ে গেল। বিশেষত বিদায়বেলার শেষ কথাটি, ‘‘আবার দেখা হবে, মুক্ত ও অবাধ গণতন্ত্রের কাশ্মীরে।’’ স্মিত হেসে গিলানি বলেছিলেন, ‘‘মানবাধিকারের লড়াই জারি থাকবে।’’
সংসদ ভবন আক্রমণের ঘটনায় অভিযুক্ত আফজল গুরুর ফাঁসি হয়েছে। ফাঁসির দড়ির স্পর্শ নিতে নিতে বেঁচে ফিরেছেন গিলানি। নিছক বেঁচেই ফেরেননি, সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল। এই ঘটনায় তাঁর জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ দেশের সর্বোচ্চ আদালত পায়নি। বস্তুত, যে দিন জেল থেকে বেরোলেন গিলানি, সে দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলে আটক রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য কাজ শুরু করে দেন তিনি। ‘কমিটি ফর রিলিজ় অব পলিটিক্যাল প্রিজ়নার্স’ (সিআরপিপি)-এর দেশজোড়া আন্দোলন শুরু হয়। পাশাপাশি, কাশ্মীরিদের অধিকার রক্ষায় সরব হন তিনি।
সংসদ ভবনে হামলা চালানো হয় ২০০১-এর ১৩ ডিসেম্বর। গিলানি গ্রেফতার হন ১৫ ডিসেম্বর। দিল্লির আইনজীবী নিত্যা রামকৃষ্ণান ‘ইন কাস্টডি/ল, ইমপিউনিটি অ্যান্ড প্রিজ়নার অ্যাবিউজ় ইন সাউথ এশিয়া’ বইতে গিলানির সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক প্রতিবেদনে পুলিশি হেফাজতে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন।
হেফাজতে জেরা চলাকালীন অধিকাংশ সময়েই তাঁকে রাখা হত সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়, হাতে ও পায়ে শিকল পরিয়ে। এমনকি, শৌচাগারে গেলেও কমান্ডোরা বন্দুক উঁচিয়ে ভিতরে ঢুকত। গিলানি বলতেন, ‘‘এটা কী হচ্ছে? আমাকে অন্তত স্নান করতে দিন, বাথরুম ব্যবহার করতে দিন!’’ তার পরেও দু’জন পুলিশকর্মী বাথরুমে থাকেন বলে গিলানি অভিযোগ করেছেন। গিলানিকে শুইয়ে দিয়ে গোড়ালির উপরে বুট পরে দাঁড়িয়ে পড়তেন পুলিশ অফিসার। পা থেকে রক্ত পড়ত। নগ্ন অবস্থায় তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হত বরফের উপর। লাগাতার অত্যাচার চালানোর জন্য পুলিশের একটি দল থাকত। সঙ্গে চলত ধর্ম তুলে অকথ্য গালিগালাজ। লাগাতার নির্যাতনে দুই সন্তানের পিতা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতেন না।
গিলানি বলেছেন, সেই সময়ে পুলিশের যে ‘অতি জাতীয়তাবাদী’ অংশ, তারা মনে করত, তারা যা করছে দেশের জন্য করছে। গিলানির স্ত্রী ও সন্তানদেরও পুলিশ তুলে আনে। গিলানি পুলিশকে অনুরোধ করেন তাঁর এই অবস্থা তাঁদের না দেখানোর জন্য। গিলানির কথায়: নয়তো আমার ছেলে এই রাষ্ট্রকে ভুল বুঝবে।
এখানেই রাষ্ট্রশক্তির জয়। ব্যক্তিকে তছনছ করে, মানসিক শক্তিকে চুরমার করে তাকে নিজের পথে আনা। আগে থেকে ঠিক করে রাখা ‘অপরাধী’কে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেওয়া, হ্যাঁ, এ কাজ আমিই করেছি। গিলানির মতো ‘একগুঁয়ে’ মানুষ পেলে রাষ্ট্র তাঁকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। যুগে যুগে দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রশক্তি এটাই করেছে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ছাড় পেলেও কি অবাধে বেঁচে থাকার অধিকার আছে গিলানিদের? সমাজ, জাতির বিবেক তো তাকে আগেই দোষী ঠাহরে ফেলেছে! তাই গিলানিদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে বুলেট! ২০০৫-এর ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে তাঁর আইনজীবী নন্দিতা হাকসারের দক্ষিণ দিল্লির বাড়ির বাইরে গিলানিকে লক্ষ্য করে ছুটে আসে এক ঝাঁক বুলেট। গুরুতর আহত হন তিনি।
প্রমাণ থাক বা না থাক, রাষ্ট্র এক বার যাঁকে দেগে দিয়েছে সন্ত্রাসবাদী বলে, যাঁর মুণ্ডু কেটে ফুটবল খেলতে চায় দেশের মানুষ, ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এ তাঁর ‘সাত দিনের ফাঁসি’ হয়ে যায়। সিআরপিপি-র অন্য সদস্যেরা, যেমন রোনা উইলসন, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং ছাড়াও মানবাধিকার কর্মী সোমা সেন, মহেশ রাউত, সুধীর ধাওয়ালে, সুধা ভরদ্বাজ, অরুণ ফেরেরা, ভারনন গঞ্জালভেস, ভারাভারা রাও আজও জেলে বন্দি। ভীমা-কোরেগাঁও ঘটনার জেরে গ্রেফতার তাঁরা। কয়েক জনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আনা হয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, যে মানবাধিকার কর্মীরা রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকার রক্ষায় ও তাঁদের হেনস্থার হাত থেকে রেহাই দিতে লাগাতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদেরই কারাগারের অন্তরালে আটকে রেখে দেওয়ার সর্বাত্মক প্রয়াস চলছে। একের পর এক মামলায় এমন ভােব জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে তাঁদের, যাতে নির্দিষ্ট কোনও একটি মামলায় জামিন পেলেও বাকি মামলাগুলির জালে জড়িয়ে রাখা যায়।
কাশ্মীরের বাইরে থেকে কাশ্মীরিদের স্বাধিকারের লড়াই যাঁরা লড়তেন গিলানি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। রাষ্ট্রের দমননীতির বিরুদ্ধে লড়তে অনেকেই ভয় পান। গিলানি পেতেন না। আজ কাশ্মীরের যা পরিস্থিতি, সেখানকার সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার কথা বলার জন্য তাঁর মতো মানুষের বেঁচে থাকাটা বড্ড জরুরি ছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy