স্বামী বিবেকানন্দ।
কোন্ পরিচয়ে বিবেকানন্দ তাঁর অন্য সব বিশেষণগুলি ছাপিয়ে গিয়েছেন তা বলা মুশকিল। তিনি বৈদান্তিক সন্ন্যাসী, কর্মযোগী পুরুষ। তিনি সাহিত্যিক, বিশ্বসভায় সনাতন ভারতীয়ত্বের পতাকাবাহী, তিনি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা। এমনই বহুর মধ্যে সম্ভবত তাঁর শিক্ষা ভাবনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মাস্টারি করেছিলেন মাত্র কয়েক মাস, কিন্তু জীবনভর শিক্ষক। গতানুগতিক টুলো পণ্ডিতি নয়। এক দিকে, দেশ-কাল, জাতীয়-আন্তর্জাতিক বাস্তবতা, অন্য দিকে, চিরন্তন মূল্যবোধের জাগরণ— এমনই দুই কূল ছুঁয়ে রয়েছে তাঁর শিক্ষাভাবনা। যেমন, মানুষের অন্তরের চিরন্তন পূর্ণতার বিকাশ-সাধনকেই শিক্ষা বলে মানতেন, তেমনি বলেছেন, “Positive কিছু শেখা চাই। খালি বইপড়া শিক্ষা হলে হবে না। যাতে character form হয়, মনের শক্তি বাড়ে, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারে, এই রকম শিক্ষা চাই।”
তাঁর এইসব ভাবনা, নির্দেশ, আলোচনা, তর্ক, সিদ্ধান্ত ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক বাংলা-ইংরেজি সংকলন, ভাষণ, চিঠিপত্র, আলাপচারিতায়। সবই যে মৌলিক, এমন নয়, কিছু পূর্বসূত্রও রয়েছে; তারই সন্ধান আমাদের।
উনিশ শতকে শিক্ষা-দর্শন নিয়ে লেখা যে বইটি সমগ্র বিশ্বের ভাবুক সমাজে আলোড়ন তুলেছিল, তার নাম ‘এডুকেশন: ইন্টালেকচ্যুয়াল, মরাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল’। অত্যন্ত প্রভাবশালী এ গ্রন্থের রচয়িতা দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সার। গ্রন্থের প্রথম প্রকাশ আমেরিকায় (ডি. অ্যাপলেটন অ্যান্ড কোম্পানি. ১, ২, ৫— বন্ড স্ট্রিট. নিউ ইয়র্ক. ১৮৬০), পরে ইংল্যান্ডে ১৮৬১ এ (উইলিয়ামস অ্যান্ড নোগরাট, লন্ডন)। চারটি দীর্ঘ প্রবন্ধের সবগুলিই পূর্ব-প্রকাশিত— ১. হোয়াট নলেজ ইজ় মোস্ট ওয়ার্থ? (ওয়েস্টমিনস্টার রিভিউ, জুলাই ১৮৫৯) ২. ইন্টালেকচ্যুয়াল এডুকেশন (নর্থ ব্রিটিশ রিভিভ, মে ১৮৫৪), ৩. মরাল এডুকেশন (ব্রিটিশ কোয়াটার্লি রিভিউ, এপ্রিল ১৯৫৮), ৪. ফিজিক্যাল এডুকেশন (ব্রিটিশ কোয়াটার্লি রিভিউ, এপ্রিল ১৯৫৯)
এরই সংক্ষিপ্ত বঙ্গানুবাদ বিবেকানন্দের ‘শিক্ষা’ নামক গ্রন্থটি। (প্রথম প্রকাশ ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির- ১৮৮৫, উদ্বোধন সংস্করণ- ১৯৮১)। পিতার অকালমৃত্যুর পরে আর্থিক প্রয়োজনে নানা কাজ করতে হয়েছিল নরেন্দ্রকে। অনুবাদকর্ম তার একটি। সহায় ছিলেন ‘বসুমতী’ সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। (শ্রীরামকৃষ্ণেরও খানিক ভূমিকা ছিল)। তবে এ জন্য বসুমতী সম্পাদক তাঁকে কত টাকা দিয়েছিলেন বা তা দিয়ে পারিবারিক সমস্যার কতটা সুরাহা হয়েছিল, তার কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই, কিন্তু এটুকু বিশ্বাস করা যায় যে, কেবল অর্থ উপার্জন বা সম্পাদকের অনুরোধে ‘শিক্ষা’ লেখা হয়নি। স্পেন্সারের শিক্ষা ভাবনা নিশ্চয়ই কোনও না কোনও ভাবে নরেন্দ্রনাথের চেতনায় ঘা দিয়েছিল। না-হলে অনুবাদের অনুমতির জন্য লন্ডনে স্বয়ং স্পেন্সারের কাছে লেখা চিঠিতে তাঁর নিজের মতামতের কথাও লিখে পাঠাতেন না। পরবর্তীকালে সময় ও অভিজ্ঞতার ঊধ্বর্তনে বিবেকানন্দের শিক্ষা-চেতনায় নানা বাঁক, নানা পরিবর্তন এসেছে সত্য— কিন্তু যদি সময়ের উজান ঠেলে উৎসের কাছে পৌঁছতে চাই তবে মনে হয় শেষ পর্যন্ত সেখানে খুঁজে পাব স্পেন্সারকেই।
দীর্ঘ এ গ্রন্থ অনুবাদ করতে গিয়ে তাঁর ভাবনার ছায়া যে নরেন্দ্রনাথের বিবেকানন্দ-জীবনে পড়েনি, এমন কথা বুক ঠুকে বলা যায় না। বরং মনে হয়, সে চিন্তা অনেকটাই পোশাক বদল করে ভারতীয় জল-হাওয়ায় নিজেকে থিতু করে নিয়েছে। নিতান্ত অসময়ে স্বামী বিবেকানন্দের তিরোধানের পর তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “কিছুদিন পূর্বে বাংলা দেশে যে মহাত্মার মৃত্যু হইয়াছে তিনি পূর্ব-পশ্চিমকে একসূত্রে মিলাইতে পারিয়াছিলেন।” বিবেকানন্দের শিক্ষা ভাবনায় শিক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ব-পশ্চিম মিলনের এই কথাটি বোধহয় সবচেয়ে বেশি সত্য। তাঁর জীবনব্যাপী শিক্ষা-ভাবনার সূত্রপাত এখান থেকেই। বিচিত্র বিষয়ে বিপুল পাঠের জগৎ গড়ে উঠতে শুরু করেছিল এই সময় থেকে। স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনশাস্ত্র ছিল মুখ্য পাঠ্য বিষয়। ঈশ্বর সন্ধানী বা আত্মসন্ধানী নরেন্দ্রনাথ যে অবিশ্বাস আর কৌতূহল মিশিয়ে শেষপর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে, সেই নরেন্দ্র উনিশ শতকের কলেজীয় শিক্ষার ফসল। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, নরেন লোকশিক্ষা দেবে। কলেজ জীবনে কিন্তু তা মনে হয়নি, বরং তাঁর এই পর্বের শিক্ষা ভাবনা অনেকটাই আন্তর্জাতিক দার্শনিক জ্ঞান ও বিশ্বাস থেকে জাত।
বিবেকানন্দ লোকশিক্ষক কিন্তু রামকৃষ্ণদেব যে অর্থে লোকশিক্ষক, সে অর্থে নন, বরং বলা ভাল বিবেকানন্দ একইসঙ্গে লোকায়ত ও লোকোত্তর— উভয় ক্ষেত্রের শিক্ষাগুরু। পাশ্চাত্য দর্শন, ভারতীয় বেদান্ত— এগুলিকে যদি বলি লোকোত্তর জ্ঞান, তবে বিজ্ঞান-শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, কর্মশিক্ষা, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার শিক্ষাই হল লোকশিক্ষা। আবার গণশিক্ষাও লোকশিক্ষা। কখনও কখনও তাঁর বোধে এ দুই-এর মেশামেশি ঘটে গিয়েছে এমন ভাবে যে আলাদা করা মুশকিল।
সংক্ষিপ্ততর সূত্রে সেই সব ভাবনা অনেকটা এই রকম: (ক) শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক। (খ) এ জন্য যোগ্য শিক্ষক চাই (আগুন থেকেই আগুন জ্বলে)। (গ) আকর্ষণীয় বইপত্র বা পাঠোপকরণ চাই। (ঘ) শিক্ষার মাধ্যম হবে প্রমিত নয়, চলিত মাতৃভাষা। (ঙ) গণশিক্ষা চাই, শিক্ষা মুষ্টিমেয়র হতে পারে না। (চ) নারীশিক্ষা অত্যন্ত জরুরি, বাল্যবিবাহ রোধে নারীশিক্ষা কার্যকরী। (ছ) প্রথাসিদ্ধ ও প্রথামুক্ত উভয় শিক্ষাই চাই। (জ) জীবিকার জন্য শিক্ষা। (ঝ) আপাত-বিপরীত বিদ্যা— যেমন, কলার পাশে বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতার পাশে বস্তুবাদী শিক্ষা, জ্ঞানশিক্ষার পাশে কর্মশিক্ষা— এমন সহাবস্থান কাম্য। (সাম্প্রতিক মিশ্র পাঠ)। (ঞ) ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ইত্যাদির শিক্ষা দরকার। (ট) মৌলিক চিন্তায় উৎসাহ দিতে পারলে বহু সংখ্যক মধ্যমানের মধ্য থেকে বিশেষকে খুঁজে পাওয়া যাবে। (ঠ) লড়াই করার শিক্ষা, আত্মবিশ্বাস জাগানোর শিক্ষা। (ড) শিক্ষার্থীর মনের একাগ্রতা বৃদ্ধির জন্য ব্রহ্মচর্য-শিক্ষা। (ঢ) “...স্বাধীনভাবে স্বদেশী বিদ্যার সঙ্গে ইংরেজি আর Science পড়ানো, চাই technical education, চাই যাতে industry বাড়ে, লোকে চাকরি না করে দু পয়সা করে খেতে পারে।”
এমনি আশ্চর্য বাস্তবতা রয়ে গিয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা ভাবনায়। তাঁর উক্তি আজ আপ্তবাক্য; যেমন, গীতা পাঠ আর ফুটবল খেলার প্রসঙ্গ, খালি পেটে ধর্ম হয় না, আমিষ আহারে সমর্থন ইত্যাদি। খুঁজলে দেখব, এখানেও ছায়া মেলেছেন সেই স্পেন্সার। আশ্চর্য আত্তীকরণ! একেই বলা যায় প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সফলতম মিলনসাধনা!
লেখক নিস্তারিণী কলেজের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy