স্বামী বিবেকানন্দ।
‘সব দিকে প্র্যাকটিক্যাল হতে হবে, থিয়োরিতে থিয়োরিতে দেশটা উচ্ছন্ন গেল।’ এ কথা যিনি বলেন, তিনি মাত্র উনচল্লিশ বছরের জীবনে যে কর্মযজ্ঞ করে গেলেন, তেমনটি সমগ্র বিশ্বে এক অনন্য উদাহরণ। শুধুমাত্র মুখের কথা নয়, জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেলেন— এ জীবন শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় সুখের জন্য নয়। এ জীবন পরহিতার্থে ব্যয় করাই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সে জন্য তাঁর সাবধান বাণী 'Be and make' আগে নিজে তৈরি হও, তারপর অপরকে তৈরি করো।
এ সব কথা যিনি বলেছেন, তিনি কলকাতার সিমলা পাড়ার দত্ত পরিবারের নরেন্দ্রনাথ। যাঁকে সারা বিশ্ব স্বামী বিবেকানন্দ নামে জানে।
শৈশবের দুরন্তপানা, কৈশোরের উৎসুক্য আর যৌবনের তেজদীপ্ত ভঙ্গি ছিল তাঁর জীবনের স্বাভাবিক প্রকাশ। তাই কখনও তাঁকে দেখছি ব্রহ্মদৈত্যের সন্ধানে গাছে চড়তে, কখনও দেখছি ঈশ্বর সন্ধানে ছুটে যাচ্ছেন ব্রাহ্মসমাজে, দক্ষিণেশ্বরে, আবার কখনও সারা ভারতের মাঠে ময়দানে ভারতাত্মার স্বরূপ উপলব্ধির আশায়। ছেলেবেলায় বাড়ির ঘোড়ার গাড়ির চালক, কোচম্যান ছিল নরেনের বিশেষ বন্ধু। সে যেমন করে মাথায় পাগড়ি বেঁধে হাতে চাবুক ঘোরাতে ঘোরাতে দুরন্ত ঘোড়াকে সঠিক পথে চালনা করে, তা জানার অদম্য কৌতুহল তাঁকে পেয়ে বসে। তাই সে কোচম্যানের সঙ্গ করে। তাঁর কাছে এমন একজন মানুষই আদর্শ। তাই বড় হয়ে তাঁর কোচম্যান হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এক দিন ব্যক্ত করেন বাবা বিশ্বনাথ দত্তের কাছে।
সে সব ছেলেমানুষি মনে হলেও এই প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন বলে আজ আমরা মনে করি। কারণ, সারা বিশ্বে মানুষের চলার পথের আদর্শ গাড়িটির তিনি যে কোচম্যান (চালক) হয়ে উঠলেন, তাতে আজ আর কারও সন্দেহ নেই। অসম্ভব মেধা কর্মক্ষমতা এবং হৃদয়বত্তাই ছিল তাঁর নিজস্ব সম্পদ। তাই বারবার বলেছেন— ‘‘নিজেকে কর্ম করার যোগ্য যন্ত্র করে তোলো।... হৃদয় ও মস্তিষ্কের যদি বিরোধ দেখ, তবে হৃদয়কেই অনুসরণ করো।’’ মানুষের এই দু’টি যন্ত্রই তাঁকে মানুষ করেছে। এক মস্তিষ্ক, যা দিয়ে সে বিচার করে আর দ্বিতীয়ত: হৃদয় যা তাঁকে বিবেচনা দেয়। এই দু’টির একটিও বাদ গেলে চলবে না। মস্তিষ্কসর্বস্ব মানুষের কোনও প্রয়োজন নেই। হৃদয়বান মানুষও তাঁর কাছে অপ্রয়োজনীয়। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে— Three H ফর্মুলা। ‘Head, Heart and Hand'— স্বামীজি চেয়েছেন মস্তিষ্ক জোগাবে বুদ্ধি, হৃদয় যোগাবে বোধ আর হাত অর্থাৎ দু’টি হাত কর্মে উদ্বুদ্ধ করবে। শুধুমাত্র বক্তৃতাসর্বস্ব হলে চলবে না। মানবিক বোধ দ্বারা কাজ, করতে হবে। কাজ কাজ আর কাজ। অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা দূর করতে হবে সমাজের পাপ। সেই পাপ, যা মানুষকে পশ্চাদপদ করে রাখে, অন্ধ কুসংস্কারছন্ন করে রাখে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে।
স্বামীজি যুবকদের এই কাজে অগ্রসর হতে আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ যুবকেরাই দেশের মূল চালিকা শক্তি। তাদের সঠিক পথে চালিত করলে কী-ই না হতে পারে! স্বামীজি বিশ্বাস করেন, প্রত্যেকটি মানুষ পরিমাত্মার অংশ, দেবত্ব তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি। সে তার এই অসমান্য শক্তির কথা জানে না। তাই অমন অলস, সংকুচিত। তাকে জানতে হবে তার ভিতরে অসীম শক্তি বিদ্যমান। যখন এই উপলব্ধিতে সে পৌঁছবে যে সে নিজেই অসীম ব্রহ্মশক্তির অধিকারী, তখন সে নিজের শক্তিতেই চারপাশের পাপ, অনাচার, অন্ধবিশ্বাস, অশিক্ষার মতো জঞ্জাল সাফ করতে শুরু করবে। যুবকদের উদ্দেশে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ‘হৃদয়ে ক্রমে ক্রমে বল আনতে হবে। একটা ‘মানুষ’ যদি তৈরি হয়, তো লাখ বক্তৃতার ফল হবে।’
পিতৃহারা নরেন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরহংসদেবের সান্নিধ্য লাভ করে যেন মুক্তির পথ খুঁজে পেলেন। ঈশ্বর দর্শনের অন্তর্নিহিত ভাব অনুধাবন করে বলে উঠলেন— ‘বহুরূপে সন্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/ জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ অর্থাৎ মানুষের সেবা যেন জীবনের মূল মন্ত্র হয়। স্বামীজি দিলেন ত্যাগ ও সেবার মন্ত্র। নিছক কথার কথা হয়, নিজের সমস্ত ভাব তিনি জীবন দিয়ে পালন করে দেখালেন। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে শিকাগো ধর্মমহাসম্মেলনে জগতবাসীর কাছে তুলে ধরলেন ভারতের শাশ্বত আদর্শ ও অধ্যাত্মবাদ। তিনি তপোবনের বেদান্তকে গৃহে নিয়ে এলেন, যাকে নিজেই বলেছেন ‘প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত।’
স্বামীজি ঠাকুরকে ধারণ করেছেন আপন সত্তায়। তাই তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ না করে তাঁর কথাই নির্দ্ধিধায় বলেছেন ধর্মমহাসভায়। আমাদের ধর্মের সারকথা যে সহিষ্ণুতা এবং গ্রহিষ্ণুতা, তা বার বার উল্লেখ করেছেন। বলেছেন— আমি সেই ধর্মের প্রতিনিধি, যে ধর্ম অন্য ধর্মকে শুধু শ্রদ্ধাই করে না, সব ধর্মকে সমান এবং সত্য বলে মনে করে। এ যেন ‘যত মত তত পথ’-এর সরল ব্যাখ্যা। স্বামীজি কুয়োর ব্যাঙের প্রসঙ্গ টেনে সঙ্কীর্ণ ধর্মাচরণের সমালোচনা করেন। সাগরের ব্যাং হওয়ার যে আহ্বান তিনি পাশ্চাত্যে প্রচার করেন, তারই মর্মবাণী রূপে আমাদের জানালেন— প্রসারণই জীবন সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু। অর্থাৎ, আমাদের ধর্ম উদার এবং বিনত হতে শেখায়। উদ্ধত-সঙ্কীর্ণ সংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব ধর্মরক্ষার পরিপন্থী।
এ ভাবেই সমগ্র বিশ্বকে আলোড়িত করে দেশে ফিরলেন স্বামীজি। তাঁর স্বপ্ন সার্থক করতে প্রতিষ্ঠা করলেন রামকৃষ্ণ মিশন। এখানে এক দল সন্ন্যাসী নিরলস ত্যাগ ও সেবা ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সারা বিশ্বে ‘মানুষ’ গড়ার কাজে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। যাঁরা প্রতিনিয়ত স্বামীজির হয়ে যুবকদের বলছেন— ‘Arise awake and stop not till the goal in reacted..।’
লেখক ঘূর্ণী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy