গর্জনের পরে বর্ষণ হয়েছে। যদিও বর্ষণ হলেই তাতে প্লাবন হবে, এমনটা হলফ করে বলা শক্ত। তবে, মঙ্গলবার রাতে তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর মুখোমুখি বৈঠক এবং সেখান থেকে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথার পরে মোড় ঘোরার একটি সম্ভাবনা হয়তো তৈরি হওয়ার ছিল। তা কি আদৌ হবে?
তবে, রাজনীতি সব সময় অনিশ্চিতের খেলা। তাই শুভেন্দুকে ঘিরে সব রকম জল্পনা আপাতত বিদ্যমান। রাজ্যের প্রাক্নির্বাচনী আবহে এই বাস্তব অবস্থাটি এড়ানো কঠিন। এতে পক্ষ-বিপক্ষ থাকতে পারে, কিন্তু নিরাসক্ত থাকার আজ বোধ হয় কোনও উপায় নেই!
ভ্রাতৃপ্রতিম, সুবন্ধু শুভেন্দুর সঙ্গে অন্য অনেকের মতো আমারও ব্যক্তিগত যোগাযোগের একটি পরিসর রয়েছে। যদিও গত কয়েক মাস সেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত। তবু তাঁর জীবনে প্রথম বিধায়ক হওয়ার সময় থেকে রাজনৈতিক উত্থান-পর্বের প্রায় সবটাই আমার চোখে দেখা। কোনও বিচারে না গিয়ে আজ শুধু এটা বলব, সে আত্মবিশ্বাসী এবং এটা থাকা খুব ভাল। তবে অনমনীয় জেদ ভাল নয়।
কাঁথিতে তাঁদের পরিবারের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার উল্লেখও এই সূত্রে কিছুটা প্রাসঙ্গিক। বাংলার রাজনীতিতে, বিশেষত বাম-বিরোধিতার মঞ্চে, অধিকারী পরিবার অতীতের অবিভক্ত মেদিনীপুর থেকেই নিজেদের এলাকায় কর্তৃত্ব কায়েম রাখতে পারতেন। সেই প্রভাব এখনকার পূর্ব মেদিনীপুরেও একেবারে মুছে যায়নি। শুভেন্দু তার প্রাথমিক সুফল পেয়েছেন। হয়তো আজও কিছুটা পেয়ে থাকেন।
তাঁর সাংসদ-পিতা, তৃণমূল নেতা শিশির অধিকারীর ছেড়ে যাওয়া কাঁথি দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ২০০৬ সালে শুভেন্দু প্রথম বিধায়ক হন। সৌজন্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল তখন রাজ্যে বিরোধী শক্তি। তার আগে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবেই ২০০১-এর বিধানসভায় মুগবেড়িয়া থেকে এবং ২০০৪-এর লোকসভায় তমলুক থেকে শুভেন্দু জিততে পারেননি। জিততে পারলেন অধিকারীদের ‘গড়’ বলে পরিচিত কাঁথিতে।
কথাগুলি মনে করানোর অর্থ এটাই যে, নিজের কাঁথি-পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে জিতে আসার মতো জোর বা ‘ক্যারিশমা’ শুভেন্দু কিন্তু দেখাতে পারেননি। বরং তাঁর দল তৃণমূলের সামগ্রিক উত্থান-পতন যেমন ভাবে হয়েছে, তাঁর ভোট-ভাগ্যেও সেটাই বর্তেছে। একই যুক্তিতে ২০০৯-এ নন্দীগ্রাম-পরবর্তী লোকসভা ভোটে তমলুক থেকে শুভেন্দুর জয়কে ব্যাখ্যা করা খুব ভুল হবে না। ২০১৪-তে তাঁর দ্বিতীয় দফা সাংসদ হওয়া এবং ২০১৬-তে সাংসদ পদ ছেড়ে খাস নন্দীগ্রাম থেকে বিপুল ভোটে জিতে বিধানসভায় যাওয়ার কথা তো বলা বাহুল্য।
বলতেই হবে, আজ পর্যন্ত শুভেন্দু অধিকারীর যত উত্থান, যত প্রসার-প্রভাব-পদ-ক্ষমতা, এমনকি সুনাম-দুর্নাম, সবই হয়েছে তৃণমূলের পতাকার তলায়। আর সব দায়িত্বই তিনি পেয়েছেন মমতার কাছ থেকে। পাশাপাশি এটাও অনস্বীকার্য যে, ২০০৬-এর শুভেন্দুর সঙ্গে আজকের শুভেন্দুর বিস্তর তফাত। তিনি সেটাও অর্জন করে নিয়েছেন।
বস্তুত দেড় দশকের ব্যবধানে কাঁথির শুভেন্দু অধিকারী নিজেকে এমন একটি স্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, যেখানে তাঁর একক পদক্ষেপ রাজ্য রাজনীতিতে আপাত ভাবে আলোড়ন ফেলে দিতে পারে। নইলে আজ এত আলোচনার দরকারই হত না! এটা অবশ্যই তাঁর একটি রাজনৈতিক কৃতিত্ব। ভবিষ্যৎ কী হবে, সে প্রসঙ্গ দু’-এক কথায় শেষ হওয়ার নয়। কারণ বিষয়টি বহুমাত্রিক এবং প্রমাণসাপেক্ষ।
যেমন, প্রচলিত ধারণা হল, শুভেন্দু তাঁর নিজের জোরে কর্মী-সমর্থকদের সংগঠিত করতে পারেন। তাঁর ডাকে মানুষের ঢল নামতে পারে। তৃণমূলের পতাকায় তিনি যে এত দিন বিভিন্ন জেলায় এটা করেননি, তা নয়। কিন্তু দলের পতাকার বাইরে গিয়ে একক ভাবে তাঁর পক্ষে কত দূর কী করা সম্ভব, সেটা এখনও পরীক্ষিত হয়নি। কারণ তাঁর চার পাশে ঘিরে থাকা ভিড় কতটা দলের জন্য, আর কতটা ব্যক্তির, তা আলাদা করার কোনও অবকাশ আগে ছিল না।
আর এক অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ বিষয়— দলের মধ্যে প্রতিবাদের ‘মুখ’ হয়ে ওঠা। আমরা জানি, রাজনীতিতে প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ গোছের পদক্ষেপে এক ধরনের সমীহ আদায় করে নেওয়ার সুযোগ থাকে। তার উপর উচ্চ ক্ষমতাধর নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বা কোনও শক্তিশালী দলের ভিতরে কেউ ‘প্রতিবাদী’ ভূমিকা নিলে তাঁর মুখে অনেকটা আলো এসে পড়ে। শুভেন্দুকে নিয়েও অনেকে দলে ভাঙনের অঙ্ক কষছেন। এমনকি তৃণমূলের অন্দরেও এই ভাবনা ঘুরছে।
বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ভেঙে, তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে এবং কালক্রমে চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ বার মমতার দলে শুভেন্দু ‘বাগী’। কিন্তু দুই প্রতিবাদের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম মৌলিক তফাত আছে, যা খেয়াল রাখতেই হবে। সেই আলোচনার আগে শুভেন্দুর প্রতিবাদের বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা উচিত।
তাঁর বিদ্রোহের তির কোন দিকে তাক করা, এখন আর তা গোপন নেই। তৃণমূলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান-পর্ব ঘিরে যেটা দানা বেঁধে ছিল, দলের সাংগঠনিক কাজে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের সক্রিয়তা তাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। যাঁরা নিজেদের দলে কোণঠাসা বলে মনে করেন, শুভেন্দুর পদক্ষেপে তাঁদের একাংশ তাই উৎসাহিত। আর ভোটের আগে এমন একটি ‘মওকা’ পেয়ে বিজেপি যে ঝাঁপাবে, তা-ও স্বাভাবিক। এই বাস্তবতাটুকু স্বীকার না করা ভুল।
কিন্তু প্রশ্ন হল, শুভেন্দুর যে লড়াই তা কি ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার হিসেব, না কি এর নীতিগত কোনও অবস্থান আছে?
মমতা যখন কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন, তখন তাঁর প্রধান অভিযোগ ছিল, তৎকালীন রাজ্য কংগ্রেস শাসক সিপিএমের ‘বি-টিম’ হয়ে গিয়েছে এবং বাম সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে না। তিনি মনে করেছিলেন, তাঁর হাতে প্রদেশ কংগ্রেসের ভার থাকলে এটা হত না। সেই দিক থেকে এটি ছিল নীতিগত লড়াই। তাঁর ওই কথায় বিশ্বাস করে মানুষও কংগ্রেস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। আরও বড় কথা, মমতা তার আগেই নিজের সিপিএম-বিরোধী ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।
সরকারি দলে থেকে শুভেন্দু যে ‘বিদ্রোহ’-এর বার্তা দিয়েছেন, তাতে সরকারের বিরুদ্ধে নীতিগত কোনও অবস্থান কিন্তু স্পষ্ট হচ্ছে না। বস্তুত সরকারের কোনও কাজ, কোনও নীতি, কোনও পদক্ষেপ নিয়ে বিজেপি, বাম বা কংগ্রেসের মতো বিরোধীরা যে ভাবে সরব হয়, শুভেন্দু তা করেননি। কোনও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেও তাঁকে সরব হতে দেখা যায়নি। মন্ত্রীর পদে প্রায় পুরো মেয়াদ কাজ করার পরে এটা বলা তাঁর পক্ষেও সহজ নয়।
প্রতিবাদী শুভেন্দুর লড়াই শুধু তাঁর দলের অভ্যন্তরীণ ওঠা-পড়ার বিরুদ্ধে। তিনি দলের শীর্ষপদে থাকলেও মনে করেছেন, তিনি ‘অমর্যাদা’র শিকার। হতে পারে, তাঁর এই ক্ষোভ খুব সঙ্গত। হতে পারে, এই লড়াইতে তিনি একা নন। কিন্তু তাতে আম-জনতার অর্থাৎ সাধারণ ভোটারের কী আসে-যায়! কোন দলে কে কী পাওয়ার অধিকারী, কার অধিকারের সীমা কত দূর, সে সব সেই দলের নিজস্ব ব্যাপার। মানুষ ভোট দেয় সরকারের কাজ বা বিরোধী দলের বিশ্বাসযোগ্যতার দিকে তাকিয়ে। সেখানে ব্যক্তিস্বার্থের স্থান কোথায়?
তবে হ্যাঁ, বড় দলের বড় নেতা ‘বিদ্রোহী’ হলে তার কিছুটা সাধারণ অভিঘাত অবশ্যই থাকে। তাতে চাপও বাড়ে। তা বলে ব্যক্তিস্বার্থের লড়াই কখনও ‘আদর্শ’-এর লড়াই হয়ে উঠতে পারে না। শুভেন্দু শেষ পর্যন্ত তৃণমূলে থাকুন বা অন্যত্র যান, এই সত্য কিন্তু অপরিবর্তনীয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy