অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুতে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যেন কুনাট্যের হট্টমেলা বসে গিয়েছে। কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হচ্ছে, ষাট বা সত্তর দশকের সিনেমা চলছে। যেখানে ধর্ষিতা মেয়েটি হয় আত্মহত্যা করবে, নয়তো তার ঠাঁই হবে পতিতালয়ে। সেটাই তাদের ‘ধর্ষিতা’ হওয়ার পাপের ফল বইকি। কিংবা মৃত পুত্রের মা আছাড়িপিছাড়ি খেতে খেতে তার স্ত্রী বা প্রেমিকার দিকে আঙুল তুলে সেই অমোঘ সংলাপটি আউড়ে উঠবে, ‘ও-ই আমার ছেলেকে খেয়েছে!’ সুশান্ত-রিয়া ঘটনাবর্তে, ভারতীয় গণমাধ্যমের কিয়দংশ সাংবাদিকতার নামে ঠিক এই ধাঁচেরই দোষারোপ আর কথাবার্তা চলিয়ে যাচ্ছে। শুধু দোষারোপই নয়, নিজেদের বক্তব্য একেবারে হাতেকলমে প্রমাণ করে দিতেও তারা খেপে উঠেছে।
লক্ষ্মীসোনা ছেলেকে মোহিনী মায়ায় জড়িয়ে কালনাগিনীতে গিলে নিল— এই বিশ্বাসটা বোধ হয় মধ্যযুগের ডাইনি পোড়ানোর প্রথার থেকেও পুরনো। খাপ পঞ্চায়েত এই ভাষাতেই (এখনও) খবরদারি করে। সম্মানরক্ষার নামে প্রণয়ীদের মৃত্যুর আদেশ দেয়। যে মেয়েটা সমাজের নিয়মের শেকল ভাঙে বা যৌন চাহিদা নিয়ে সরব, প্রহসনের বিচারসভার মাতব্বররা তার বিরুদ্ধে ঠিক এই সুরেই ‘পাপ, পাপ’ বলে গর্জে ওঠে, গণধর্ষণের সাজা শোনায়। সুশান্ত সিংহ রাজপুত কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত রিয়া চক্রবর্তীও কতকটা সেই মেয়েদেরই মতো। কারণ, তিনি প্রয়াতের সঙ্গে লিভ-ইন রিলেশনশিপে ছিলেন। তাই, তাঁকেও এ ভাবে কাঠগড়ায় কোণঠাসা করা হচ্ছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো এখনও সব সাক্ষ্যপ্রমাণই জড়ো করে উঠতে পারেনি! তার আগেই ভারতীয় মিডিয়ার একাংশ রিয়াকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করেছে। গলা ফাটিয়ে তাঁর গ্রেফতারি চাইছে, এমনকি ফাঁসি চাইতেও পিছপা হচ্ছে না। তাদের এই প্রলাপের সঙ্গে খাপের উচ্চারণের কী ভয়াবহ মিল!
প্রয়াত অভিনেতার পরিবার রিয়া চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে। বাদী পক্ষের দাবি, এই বান্ধবীটি সুশান্তকে চালনা করতেন। তাঁর টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার পর অবসাদের গহ্বরে ঠেলে দিয়ে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছেন। এই সব ভাবনাচিন্তার সুতো ধরে এগোলে অভিযুক্ত মেয়েটিকে অভিনব রূপে আবিষ্কার করা যায়। মনে হয়, তাঁর অতিলৌকিক ক্ষমতা আছে। সেই বলেই মাত্র মাস কয়েকেই এক পুরুষের বোধবুদ্ধিকে এ ভাবে টলিয়ে দিতে পেরেছেন। তাঁর ক্ষমতা সাঙ্ঘাতিক, কারণ এ কথা স্বীকৃত যে, অভিনেতাটি যেমন-তেমন লোক ছিলেন না। তিনি মেধাবী, দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তি। সুশিক্ষিত এবং পণ্ডিত। অর্থাৎ, রিয়াই হলেন রূপকথায় পড়া সেই রাক্ষসী রানি! কিংবা ‘বিষকন্যা’। মিডিয়ায় তাঁর বিচার ও দণ্ডবিধানের সময় সরাসরি এই বিশেষণই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার উপরে তাঁর জীবনযাপন-গতিবিধি দেখতে গিয়ে বিশ্বাস জন্মেছে যে, অভিযুক্ত তরুণী উচ্চাকাঙ্ক্ষী, যৌনতা নিয়ে তাঁর অন্য মাত্রার ধারণা রয়েছে। পৃথিবীতে এগিয়ে চলার রাস্তাটা নিজেই গড়ে নিতে জানেন। এ সব কানে যেতেই ডাইনি নিধন যজ্ঞে ভাল করে ঘি পড়েছে। ভার্চুয়াল পৃথিবীতে লাঠি হাতে রে রে করে ছুটে এসেছে মারমুখী জনতা। ডাইনিই যে এ কালের শূর্পণখা। তাকে ধুলোয় গড়াগড়ি যেতে দেখতে কে না চায়?
মাদক নিয়ে অভিযোগের মুখে রিয়া স্বীকার করেছেন তাঁর পুরুষসঙ্গীটি সত্যিই ড্রাগের নেশা করতেন। তখন বলা হল, তিনিই সুশান্তকে ওই মাদক খাইয়েছেন। সুশান্ত সেটা জানতেন না। জানলে, সম্মতি দিতেন না। মিডিয়ার বিচারসভা গলা ফাটিয়ে তার কারণ দর্শিয়েছে। বলেছে, সুশান্ত সিংহ রাজপুত এক জন মেধাবী পুরুষ। তাই তিনি নিশ্চয়ই ড্রাগের নেশার পরিণাম জানতেন। খামকা নিজে নিজে ড্রাগ তিনি নেবেন কেন! অথচ, এই একই মানুষ নিপাট সরল বটে! তাঁর সাদা মনে কাদা নেই বলেই তো এই মেয়েটা তাঁকে এমন কাঠপুতুলের মতো নাচাল। এই রিয়াই এখন কাহিনির মধ্যমণি। এমন কাণ্ড বাধিয়েছেন যে, গোটা বাঙালি রমণীসমাজই অনলাইন-আক্রমণের নিশানায়। তাঁর জন্যই বাঙালি মেয়েদের এত উদারমনা ও আত্মবিশ্বাসী রূপে দেখা হচ্ছে। সে মোটেও ভাল কথা নয়। এতখানি মুক্তমনে অন্তত নিজের যে কোনও ভাল হয় না, সে তো এখন বোঝাই যাচ্ছে। অবশ্যই, এই ভাবমূর্তির ঠিক বিপ্রতীপে অধিষ্ঠান করছেন সতীলক্ষ্মীর ছাঁচে ঢালা আদর্শ ভারতীয় নারী। তিনি সুশান্তের জীবনের এক প্রাক্তনী। প্রচলিত ধারণা, তিনি সুশান্তকে অনেক যত্ন করতেন, তাঁর জীবনপাত্র ভরিয়ে রাখতেন। তাঁদের বন্ধনটি ছিল টিভির প্রাইমটাইম স্লটের বিখ্যাত ‘পবিত্র রিস্তা’। মিডিয়ার বিচারসভার ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট, সুশান্তের এত কষ্ট পাওয়ার কারণ, দেবীসুলভ এক নারীর সঙ্গে ‘পবিত্র’ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। তার পরই তো এই মেয়েটির ফাঁদে পা দিলেন। সে তাঁকে জালে জড়িয়ে মৃত্যুর হাতে সঁপে দিল।
মিডিয়ার খাড়া করা এই তত্ত্বের প্রকৃতি অদ্ভুত। এক দিকে তা হাস্যকর রকম শিশুসুলভ। অন্য দিকে ভয়ঙ্কর রকম মধ্যযুগীয়, তার ক্রুদ্ধ গরগরানি থেকে নারীবিদ্বেষের বিষ ঝরছে। দেখা যাচ্ছে, অর্ধেক দেশ বিশ্বাস করে যে, ধীমান ব্যক্তিরা, এ ক্ষেত্রে সুশান্তের মতো গুণী অভিনেতা অবসাদ বা মনের অসুখে ভুগতে পারেন না। কোনও ভাবেই, কখনওই পারেন না। কেন? কেননা, তাঁর চার বছর আগের বান্ধবী ‘এখন’ জানিয়েছেন, বেশ নির্ঝঞ্ঝাট মনের ছেলে ছিলেন। চকলেট খেতেও ভালবাসতেন। আর তা ছাড়া, তাঁর মতো বুদ্ধিমান ও চিত্তাকর্ষক যুবক কী ভাবেই বা মনের আঁধার-দুনিয়ার নিবাসী হতে পারেন! এই সব তত্ত্ব-নির্মাণ, চুলচেরা বিশ্লেষণের অন্তরালে ঘাপটি মেরে বসে আছে মূল কুশীলব। সেখানেই আমজনতার আর একটি অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা মেলে। তা হল, আমাদের দেশের মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টা মেনে নিতে এখনও কেন এত ভয় পায়? উপলব্ধি হয়, মনের অসুখের বিষয়টাকে স্বাভাবিকের সীমারেখাটার নীচে দমিয়ে রাখা হয়েছে। ‘অবসাদ-কিন্তু-অসম্ভব’ এই যু্ক্তিটিকে সামনে এগিয়ে দিচ্ছে অভিনেতারই পরিবার।
অথচ, সেই পরিবারেই মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যার ইতিহাস আছে বলেই বোধ হচ্ছে। এর থেকে বোঝা যায়, মনের ক্লৈব্যতা নিয়ে এই লজ্জার দাগ আমাদের চেতনার কত গভীরে ছায়া ফেলেছে। আপনজনেরা পর্যন্ত বিষয়টি স্বীকার করতে রাজি নন! মনের অসুখকে লাগাতার উড়িয়ে দেওয়ার এই প্রবণতাই আত্মহত্যাকে অপরাধের পর্যায়ভুক্ত করতে প্ররোচনা দেয়। সুশান্তের মৃত্যুর জন্য তাঁর মানসিক অবস্থাটি নিয়ে চিন্তাভাবনার বদলে, দায়ভারটি চাপিয়ে দেওয়া হয় সুশান্ত-সঙ্গিনী রিয়া চক্রবর্তী ও অন্য কয়েক জনের ঘাড়ে। বা তাঁদের কুমতলবের উপরে।
মেধাবী, অসাধারণ এই অভিনেতার জীবনের দুঃখজনক পরিণতি এখন এক ঝড়ে পরিণত হয়েছে। বলিউডের সিনে-জগতের বহু হর্ম্যমর্মর, সুশোভিত ইমারত তছনছ খানখান হয়ে গিয়েছে। ঝড় বিপদবার্তা দিচ্ছে, মায়ানগরীর অন্দরমহলের আবর্জনা টেনে বার করবে। এই উপাখ্যানে রাজ্য-রাজনীতির আঁচ বাড়ছে। দুই বিরোধী দলের রাজনৈতিক দড়ি টানাটানির মাঝেও প্রয়াত অভিনেতার নাম ঘুরছে। ‘খুন হয়ে যাওয়া হতভাগ্য এক বিহারি যুবক’— এই পরিচয়েই স্বার্থের খেলায় তুরুপের তাস হিসেবে উঠে আসছেন সুশান্ত সিংহ রাজপুত। তাঁর সম্ভাব্য বিষাদ, তাঁর শেষ দিনগুলির যন্ত্রণার মূল্যের বিনিময়ে।
সম্পাদক, সাউথ এশিয়ান হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy