রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংহের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন সুধা রায়। —নিজস্ব চিত্র।
সুধা রায়ের জন্ম ১৯১১ সালের ১৫ মার্চ, শিমলায়। বাবা মনমোহন বসু ছিলেন বড়লাটের দফতরের আমলা। খুব কম বয়সে সুধার বিয়ে হয় জলপাইগুড়ির অরুণোদয় রায়ের সঙ্গে। অকালমৃত্যু হয় স্বামীর। তখন তাঁদের ছেলে অমিতাভ কয়েক মাসের। অমিতাভের মাত্র ১২ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। সব হারিয়ে সুধা ফেরেন জলপাইগুড়ির শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুরমশাই ছিলেন চা বাগানের মালিক। স্বামী-সন্তান হারিয়ে সুধার তখন পাগল-পাগল অবস্থা। দেওর অতুলের বন্ধু মনোবিদ পরামর্শ দিলেন, লড়াই করে যাঁরা বাঁচছেন, তাঁদের কাছে নিয়ে যাও।
অতুল বৌদিকে দার্জিলিংয়ে নিয়ে গেলেন। দরিদ্র নেপালি মহিলাদের হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে সুধার সঙ্গে পরিচয় হল বৈজয়ন্তী, সুব্বু, বিনসাদের সঙ্গে। কারও স্বামী মৃত। কেউ স্বামী পরিত্যক্তা। কেউ নির্যাতিতা। সুধা উল বোনা ও সেলাইয়ের সিদ্ধহস্ত। কাজী নজরুল ইসলামের কাছে এক সময়ে গানও শিখেছিলেন। চোখ বুজেও উল বোনার কৌশল সুধার কাছে রপ্ত করতে পাহাড়ি-তনয়াদের কী উৎসাহ! ধীরে ধীরে সমাজসেবার কাজে জড়িয়ে পড়লেন। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হল। পরিচিতি বাড়ল। আর একজনও তখন কলকাতায় এসে আর্তজনের সেবা করছেন। দূর থেকে দেখেছিলেন সেবাময়ী মাদার টেরিজাকে। তারপরই ঠিক করলেন, যেতে হবে বাংলার গ্রামে।
নিবেদিতা গ্রামীণ কর্মমন্দিরের চারকর্মী চায়না পাল, কল্পনা দাম, বেবি সরকার ও কাজল চক্রবর্তী সুধাকে দীর্ঘদিন ধরে দেখেছেন। তাঁরা জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শিশু ও মহিলাদের জন্য ঢাকায় কিছুদিন ‘খেলাঘর’ নামে হোম চালিয়েছিলেন সুধা। ব্যারাকপুরের মণিরামপুরে দরিদ্র মহিলাদের একটি তাঁত বোনার সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সত্তরের দশকে রাজ্য সমাজ কল্যাণ পর্ষদের কর্মকর্ত্রী ফুলরেণু গুহ ও সাহিত্যিক প্রতিভা বসু সুধাকে নির্বাচন করলেন দু:স্থ মেয়েদের হস্তশিল্পের প্রশিক্ষক হিসেবে। ঝাড়গ্রামের সরডিহায় পর্ষদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৯৭৪ সালে প্রশিক্ষক পদে যোগ দিলেন সুধা। কেন্দ্রটি ছিল একটি ব্রিটিশ বাংলোয়। সেখানেই থাকতেন সুধা। চায়না, কল্পনা, বেবি, কৃষ্ণা ছাড়াও শ্যামলী ভট্টাচার্য, প্রতিমা দেওয়ানজি-র মতো বালোয়াড়ি সহায়িকার প্রশিক্ষণ নেওয়া মেেয়দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হল। সুধা ততদিনে আশুতোষ চক্রবর্তীর বাড়িতে থাকছেন। খেতেন একবেলা আতপচালের ভাত, ডাল আর নিরামিষ তরকারি।
ভোলাগিরি আশ্রমের স্বেচ্ছাসেবক সত্য সেনগুপ্তকে দত্তক পুত্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন সুধা। তাঁর সহযোগিতায় ১৯৭৬ সালে মানিকপাড়ায় একটি অনাথ বালিকা আশ্রম গড়ার উদ্যোগ করেন সুধা। পাশে দাঁড়ান ব্যারাকপুরের তুলসীদাস চট্টোপাধ্যায়, অমরকেশর বাণীর মতো অনেকেই। ছিলেন মানিকপাড়ার নিমাই দত্ত, মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ চক্রবর্তী, মহেশ শর্মা। ১৯৭৬ সালের মার্চে নিবেদিতা গ্রামীণ কর্মমন্দিরের সরকারি রেজিস্ট্রেশন হল। পরিচালন কমিটিতে মানিকপাড়ার হিরণ্ময়ী ঘোষ, রেণুকা ঘোষ, বিভা চক্রবর্তী। কৃষ্ণবাঁধ এলাকায় একটি জানালা দরজাহীন বাড়িতেই শুরু হল আর্তজনের জন্য সুধার সংসার। অভাবী শিশুদের সেখানে ব্রতচারী, লেখাপড়ার সহজপাঠ শেখানো হত। দুপুরে খিচুড়ি খাওয়ানোও হতো। অনুরাগীরা বলছেন, সরকারি মিড ডে মিলের ভাবনা তো চার দশক আগেই সুধা বাস্তবায়িত করেছিলেন। চায়না, কল্পনা, শ্যামলী, কৃষ্ণা, প্রতিমা, স্মৃতিকণা দেওয়ানজি, শঙ্করী ভক্তারা সেখানে শিশুদের পড়াতেন, খিচুড়ি রান্না করতেন। হাতের কাজ শেখাতেন। পুরোটাই স্বেচ্ছাশ্রমে।
পোড়ো বাড়ির জন্য সরকারি অনুদান পাননি। মানিকপাড়ার নেতাজি মাঠের পিছনে জামশেদপুরের বাসিন্দা মথুরচন্দ্র দাসের বাগান বাড়ি ১৯৭৭ সালে মাসিক পঞ্চাশ টাকা ভাড়া নিলেন। পুরোদস্তুর হোম চালু করলেন সুধা। দু’টি ঘরে শিশুদের রাখার ব্যবস্থা, বাকি দু’টি ঘরে থাকতেন সুধার ‘সৈনিক’রা। আর ছিলেন বাগান বাড়ির কেয়ারটেকার সর্বেশ্বর মাহাতো। শুরুতে পাঁচজন অনাথ-আদিবাসী বালিকাকে আবাসিক রাখা হল। জনা ১৫ বালিকা বাড়ি থেকে এসে পড়াশোনা করত, দুপুরে খাবার খেত, হাতের কাজ শিখত। ১৯৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর সমাজকল্যাণ দফতর ২০টি আদিবাসী মেয়ের জন্য হোমের অনুমোদন দিল। প্রতি আবাসিক মেয়ে পিছু মাসে ৫০ টাকা। একমাস বাদে ঝাড়গ্রাম ট্রেজারি থেকে অনুদানের একহাজার টাকা পেলেন সুধা। গোটা ইলিশ মাছ কিনে এনেছিলেন।
১৯৭৯ সালে আবাসিকের সংখ্যা দেড়শোর বেশি। ক্রমে তাঁত বোনা, টেলারিং, বাতিল জিনিস দিয়ে পুতুল তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হল। জেলাশাসক সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষ সুধাকে বললেন, হোমকে সার্থকভাবে চালাতে হলে কী-কী করতে হবে। বিভিন্ন দফতরে চায়না, কাজল, কল্পনাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন সুধা। বরাদ্দ মেলায় পাঁচিল হল। বিদ্যুৎ সংযোগ এল। সুধার চেষ্টায় পাড়ার বাসিন্দারাও বিদ্যুতের সংযোগ পেলেন। কাগজ কলের ম্যানেজার বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী হোমে টেলিফোনের ব্যবস্থা করে দিলেন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে আশ্রমের তিনটি ভবন হল। রাস্তা তৈরি হল। স্বাধীনতা সংগ্রামী অরুণকুমার সেনের সহযোগিতায় তৈরি হল তাঁত কেন্দ্র ভবন। ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রক ও রাজ্যের যৌথ বরাদ্দে সুধার হোমে কটেজ স্কিমের অনুমোদন দেওয়া হল। ২২৫ জন মেয়ের থাকতে পারবে। মেয়েদের সামগ্রী বিক্রির জন্য মেলার আয়োজন করলেন সুধা।
১৯৮৬ সালে শিশুকল্যাণে অবদানের জন্য জাতীয় পুরস্কার প্রাপক হিসেবে সুধার নাম ঘোষিত হল। সুধা চায়নাদের ডেকে একদিন বললেন, ‘তোরা না থাকলে কী আমি এত বড় কাজ করতে পারতাম। এ পুরস্কার তো সকলের’। ১৯৮৭ সালের মার্চে রাষ্ট্রপতি ভবনে জ্ঞানী জৈল সিংহ সুধার হাতে তুলে দিলেন মানপত্র ও আর্থিক পুরস্কার। পুরস্কারের টাকায় মেয়েদের ঘরে সিলিং ফ্যান, পোশাক কিনে দিয়েছিলেন। কর্মীদের উত্তরভারত বেড়ানোর খরচ দেন। পরে পান মাইকেল মধুসূদন অ্যাকাডেমি পুরস্কার। অসুস্থতার কারণে ১৯৯৩ সালে ভোলানন্দ গিরি আশ্রমের চলে গেলেন সুধা। শোনা যায়, পরিচালন কমিটির কয়েকজনের সঙ্গে মতান্তরের কারণে নিজের সাধের প্রতিষ্ঠান ছাড়েন। তবে চায়নাদের অনুরোধে বছরে দু’বার মানিকপাড়ায় আসতেন।
২০০৬ সালের নভেম্বরে মানিকপাড়ায় বেড়াতে আসেন সুধা। ডিসেম্বরে সুধাকে ঝাড়গ্রাম মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ৯৬ বছরের সুধা শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি আশ্রমেই মৃত্যু হল মানিকপাড়ার মায়ের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy