কোন্নগরের নবগ্রাম হীরালাল কলেজের সাম্প্রতিক ঘটনা আবার কঠিন বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিল সমগ্র শিক্ষক সমাজকে। মুখ্যমন্ত্রী, নেতাদের দুঃখ প্রকাশ বা কোনও রাজনৈতিক কটাক্ষের মলমে এ ক্ষত সারার নয়। বছরের পর বছর শিক্ষক নিগ্রহ চলে এসেছে।
একে রোধ করবার দায় শধুই কি সরকারের? ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত যাঁদের নাম অভিযুক্তদের তালিকায় উঠে এসেছে, জানা যায়, তাঁরা সকলেই নেতা এবং এদের একটি বড় অংশ প্রশাসক দলের মদতপুষ্ট। রাজনৈতিক কারণ বিশ্লেষণে না গিয়ে এটা সহজেই বলা যায়, আজ ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এ বদল স্বস্তিদায়ক মোটেই নয়। গুরু-শিষ্যের পরম্পরা আজ কলুষিত। ‘ছাত্রদের অধ্যয়নই তপস্যা’ বা ‘বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’। কথাগুলি এ যুগে আমরা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি ছাত্রদের। সমস্ত শিক্ষাবিদ এবং বিশিষ্ট জনের কাছে একটাই প্রশ্ন— স্বাধীনতার ৭২ বছর পেরিয়ে ভারতের সুনাগরিক সমাজে এ কাদের এনে যুক্ত করলেন? এ শুধু শিক্ষক সমাজের ব্যর্থতা নয়, এর জন্য আমরা অভিভাবকেরা সকলেই দায়ী। তবু শিক্ষকসমাজের বিশাল দায়িত্বের কথা ভেবে প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়— ছাত্র তৈরিতে আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন। ‘বিদ্যা বিনয় দান করে’ তারা শিখতে পারেনি। বদলে তৈরি হয়েছে কিছু ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, যাদের মস্তিষ্কে লঘু-গুরুর জ্ঞানটুকুই নেই।
কলেজ শিক্ষকদের সরাসরি দায়বদ্ধ না করেও বলা চলে, আপনাদের চালচলন, আপনাদের ব্যক্তিত্ব যেন ছাত্রসমাজের কাছে আদর্শ হয়ে থাকে, সে মর্যাদা কখনও নষ্ট হতে দেবেন না। বহু শিক্ষাব্রতীর কর্মজীবন সম্পর্কে আপনারা জানেন। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে ভারতের প্রাক্তণ রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, ড. এ পি জে আব্দুল কালাম সকলেই আজ প্রতিটি ভারতবাসীর প্রণম্য। ভারতবাসী তাঁদের মতোই অন্য শিক্ষাবিদদেরও যথেষ্ট সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
আপনাদের এক বার কি ইচ্ছে হয় না সে আপনি যে দলের বা যে রঙের হোন না কেন, তাঁদের মতো আদর্শ হয়ে ছাত্রদের মনের মণিকোঠায় স্থায়ী ভাবে থেকে যেতে?
মনে পড়ে, কটকের শ্রদ্ধেয় বেণীমাধব বাবুর (নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্কুলের শিক্ষক তথা হেডমাস্টারমশাই) কথা? যাঁকে দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে রাজনীতি করার দায়ে নদিয়ার কলেজিয়েট স্কুলে বদলি হতে হল। তাঁর ছাত্রেরা সে দিন সারা স্কুল উজাড় করে তাঁর গাড়ির পিছনে কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বিদায় জানিয়েছিল। ছাত্র-শিক্ষকের এমন আত্মিক সম্পর্কই তো হওয়া বাঞ্ছনীয়।
খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে হীরালাল কলেজের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করতে হল! কলেজে গিয়ে হাত জোর করে ক্ষমা চাইলেন স্থানীয় বিধায়ক। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির আশ্বাসও দেওয়া হল।
তা হলে কি ধরে নিতে হবে রাজনীতি ছাত্রসমাজকে আজ দুষ্কৃতীতে পরিণত করেছে অথবা শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রদের আত্মিক সম্পর্ক নেই? না হলে শিক্ষকের জামার কলার ধরে তাঁর মুখে পর পর কয়েকটি ঘুসি মারা হল, যিনি কিনা দু’দলের ছাত্রীদের মধ্যে গোলমাল ঠেকাতে গিয়েছিলেন! ছাত্রদের এমন স্পর্ধা, এমন ঔদ্ধত্য হয় কী করে! লাগামটা আগেই দেওয়া দরকার ছিল। যাঁরা তা না করে ‘ছোট ছেলের কাজ’, ‘দুষ্টু ছেলের কাজ’ বলে ‘ভুবনের’ মাসী সেজেছেন, আজ তাঁদের বিপাকে পড়তেই হবে।
এই অবক্ষয়ের শুরু সত্তরের দশক থেকে। নকশাল আন্দোলনে সারা বঙ্গের শিক্ষা জেরবার। শিক্ষকদের তোয়াক্কা না করে কলেজের বার্ষিক পরীক্ষায় গণটোকাটুকি শুরু হয়। কোনও শিক্ষক অন্যায় জেনেও তাতে বাধা দেননি। বরং সরকারি কলেজে বহিরাগত কিছু অশিক্ষক যুবকদের সামান্য অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষার হলে গার্ড দিতে দেওয়া হয়। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা হলে নিজের বই খাতাপত্র খুলে প্রশ্নপত্রের উত্তর টুকে দেয়। তখন ‘এই পথে খুন, ওই পথে খুন’, কারফিউ জারি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্যত বন্ধ থাকত প্রায়শই। রেজাল্ট বেরতে বিলম্ব হত বছর তিন-চার। এ ভাবে বহু শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের। অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় কলেজ ছাত্র হলেই তাকে নকশাল তকমা এঁটে জেলে পাঠাতেন নানা আইনের কৌশলে কোর্টে না তুলে। সেই জমানার ভুক্তভোগীরা হয়তো আজ পেনশনভোগী শিক্ষক।
পরবর্তী কালে থিতু সরকার বসলেন শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষাকে গিনিপিগ বানিয়ে শুরু হল এক্সপেরিমেন্ট, যার শেষ আজও হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়ন সম্পর্কে অভিভাবকেরা আজও সন্দিহান। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এই খেলা আরও দূর গড়াল। ছাত্র রাজনীতিতে ঢুকে পড়ল দলীয় রাজনীতি। তত দিনে শিক্ষক-ছাত্রদের আত্মিক সম্পর্ক ফিকে হতে শুরু করেছে। মাস্টারমশাইদের মাইনে বেড়েছে। বেতন কাঠামো ঠিক রাখার জন্য সরকারকে তুষ্ট রাখতে তাঁরাও অ্যাসোসিয়েশন গড়ে রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়লেন। একটা ভোটব্যাঙ্ক বাড়ল। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সুতোটা তখন শুধু ছিঁড়তে বাকি। কলেজে কলেজে নির্বাচনে তখন গরম হওয়া, ঠিক এখনকার মতোই। মারামারি, খুনোখুনি কম হল না। কিন্তু ছাত্র গড়ার কারিগরেরা তখন ঘরে দোর বন্ধ করে প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনসনের হিসেবে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন।
কিছু মানুষ লাভের আশায় নার্সারি স্কুল খুলল, ক্রেশ চালাল। অপটু অশিক্ষকদের হাতে তারা কুশিক্ষায় বেড়ে উঠতে লাগল। সেখানে শিশু-নির্যাতন মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে উঠতে লাগল। আজ তো শিশুর উপর যৌন নির্যাতন চলছে। শিক্ষার আঁতুড়ঘরে যাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে উঠতে হয়, যাদের আদর্শ শিক্ষক-সঙ্গ জীবনে ঘটেনি তারা ভবিষ্যতে কী হবে? আজকের মানসিকতাই এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বয়ং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর মুখের কথা শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। ছাত্র-ছাত্রীরা শিখবে কী! খবরে প্রকাশ, নদিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভায় স্কুলে বদলির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অসুস্থ শিক্ষকদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ঘোষণার পর থেকেই নাকি শিক্ষকেরা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এ কথা বলেই তিনি একটা মন্তব্য করে বসলেন— ‘‘শিক্ষিকারা এত বেশি স্ত্রীরোগে ভুগছেন যে, আমি নিজেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। এটা কী করে হচ্ছে?’’ এক জন শিক্ষামন্ত্রীর মুখে কি এ কথাগুলি রুচিসম্মত? স্কুলে বা স্কুলের বাইরে তাঁদের অস্বাস্থ্যকর শৌচালয়ের এবং তাঁদের অসীম কষ্টের কথা না জেনেই তিনি গোটা নারী জাতিকে অপমান করেছেন। এ শুধু শিক্ষক নয়, সমস্ত শিক্ষিত সমাজের লজ্জা!
অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy