Advertisement
০৮ নভেম্বর ২০২৪
Chandramukhi Basu

প্রথমারও আগে যাঁর লড়াই

ইতিহাস এখানে থেকেই ভিন্ন বাঁক নেয়। চন্দ্রমুখী বেথুন স্কুলে ভর্তি হতে পারলেন না। কারণ সেই সময় বেথুন স্কুলের কার্যনির্বাহী সমিতির কিছু নিয়ম, যার ফলে মিশনারি সম্প্রদায়ের ছাত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল সেই স্কুলে।

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২০ ০০:৫৪
Share: Save:

মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। নতুন করে সংশোধন করতে হয় ইতিহাসের পাতা। প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েটের নামে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে জায়গা করে নেয় অন্য একটি নাম, চন্দ্রমুখী বসু। মহিলাদের কৃতিত্বকে খাটো করে দেখার বদ অভ্যাস ইতিহাসের। কাদম্বিনীকে ইতিহাস মনে রেখেছিল— চন্দ্রমুখীকে নয়।

১৮৬০ সালে অধুনা বাংলাদেশে জন্ম চন্দ্রমুখীর। প্রায় এই সময়ই জন্ম কাদম্বিনীরও, ১৮৬১ সালে, ভাগলপুরে। কাদম্বিনীর পিতা ব্রাহ্মধর্মে প্রভাবিত হন। প্রায় একই ভাবে চন্দ্রমুখীর পিতা ভুবনমোহন বসু, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ব্রহ্মদেব উপাধ্যায়ের প্রভাবে, হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি থেকে মুখ ফিরিয়ে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হন। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ থেকে সুদূর দেহরাদূনে সপরিবার যাত্রা করেন। চন্দ্রমুখীর প্রাথমিক পড়াশুনো দেহরাদূনে মিশনারিদের তত্ত্বাবধানে। এই অবধি কোনও সংঘাত নেই। সংঘাত শুরু হয় ঠিক এর পরেই, তৎকালীন এফএ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বেথুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য চন্দ্রমুখী বাবার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। এর কয়েক বছর আগেই, কাদম্বিনী বাবার সঙ্গে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় আসেন শিক্ষার উদ্দেশ্যে। বঙ্গীয় হিন্দু বিদ্যালয়ে কিছু দিন পড়ার পর, বেথুন স্কুলে ভর্তি হন। অর্থাৎ কাদম্বিনী আর চন্দ্রমুখীর সহপাঠিনী হওয়ার কথা।

ইতিহাস এখানে থেকেই ভিন্ন বাঁক নেয়। চন্দ্রমুখী বেথুন স্কুলে ভর্তি হতে পারলেন না। কারণ সেই সময় বেথুন স্কুলের কার্যনির্বাহী সমিতির কিছু নিয়ম, যার ফলে মিশনারি সম্প্রদায়ের ছাত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল সেই স্কুলে। চন্দ্রমুখী, শুধুমাত্র পিতার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের কারণে বেথুন স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। মেয়েদের পড়াশোনার জন্য তৈরি করা প্রবাদপ্রতিম প্রতিষ্ঠান থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হন বিদুষী ছাত্রীটি। পড়তে হয় দেহরাদূনে মিশনারি ছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট ফ্রি নর্মাল স্কুলে। আর সেই বেথুন স্কুলেই পড়াশোনা করতে থাকেন কাদম্বিনী, সরলা, অবলা দাশেরা।

দেহরাদূন থেকেই পড়াশোনা করেন চন্দ্রমুখী, এফএ পরীক্ষাও দেন সফল ভাবে। আইএ পরীক্ষা দেওয়ার সময় অনুমতি চেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি লেখেন চন্দ্রমুখী। চিঠিটি শোরগোল ফেলে দেয়। ২৫ নভেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে পড়া হয় সেই চিঠি। টানা দু’দিন ধরে আলোচনা চলে। রেজিস্টার্ড পরীক্ষার্থীদের যে বিজ্ঞপ্তি তখন প্রকাশিত হত, তার মধ্যে মহিলাদের নাম থাকার রেওয়াজ ছিল না। তাই কারণ থাকলেও চন্দ্রমুখী বসুর নাম তালিকাভুক্ত হওয়ারও উপায় থাকল না। পুরো আবেদনই বাতিল হয়ে যাচ্ছিল, তাও চন্দ্রমুখী বসুর উৎসাহ ও বার বার আবেদনের ফলে সিদ্ধান্ত হয়, চন্দ্রমুখী বসু চাইলে তাঁর তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা দিতে পারেন।

পরীক্ষায় চন্দ্রমুখী। প্রতিটি বিষয়ে, ইংরেজি, লজিক, ল্যাটিন, কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। অত নম্বর নিয়ে, বা প্রতিটি বিষয়ে উত্তীর্ণ হওয়া পুরুষ পরীক্ষার্থীও ছিল বিরল। তবু উত্তীর্ণের তালিকাতে চন্দ্রমুখী বসুর নাম থাকে না। সেই নিয়মের ফাঁক। পরীক্ষার্থীদের নামের বিজ্ঞপ্তিতে ‘অল পার্সনস’ উল্লেখ ছিল। তার মধ্যে মহিলারা অবশ্যই পড়েন না।

সেটা ১৮৭৯ সালের কথা। আর তিন বছর পরে, ১৮৮২ সালে, ১৮৮৩-র পরীক্ষা সম্পর্কে বদলায় বিজ্ঞপ্তির ধরন। কাদম্বিনী, অবলা দাশ প্রমুখের অনেক দিনের প্রতিবাদ, আন্দোলনের ফলে মহিলা পরীক্ষার্থীরাও পরীক্ষায় বসার সুযোগ পান। বিজ্ঞপ্তির ধরন বদলে দাঁড়ায় ‘অল পার্সনস অ্যান্ড উইমেন আর অ্যালাউড…’।

১৮৮৩ সালে, সাফল্যের সঙ্গে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হন কাদম্বিনী। ১৮৭৯ সালে, চার বছর আগেকার প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট চন্দ্রমুখী বসু আবার আবেদন করেন। আর্জি মঞ্জুর হয়, তিনি কাদম্বিনীর সঙ্গে পরবর্তী স্তরে অগ্রসর হতে পারেন, কিন্তু প্রথম গ্র্যাজুয়েশনের স্বীকৃতি পান না চন্দ্রমুখী।

এর পর কাদম্বিনী মেডিক্যাল পড়বেন, চন্দ্রমুখী পড়বেন এমএ। এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ভারতের এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা হন চন্দ্রমুখী। বেথুন কলেজে শিক্ষকতাও করেন। তিনি পরবর্তী কালে বেথুন কলেজের প্রিন্সিপাল হন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম মহিলা প্রিন্সিপাল। কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে কিছু দিন পরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ফিরে যান দেহরাদূন। সেখানে কাটে পরবর্তী জীবন।

দেহরাদূন থেকে এসে গ্র্যাজুয়েট হওয়া মেয়েটির নাম ইতিহাস ভুলে যায়। অনেক দিন পর অধ্যাপিকা সুনন্দা ঘোষ প্রত্নতত্ত্বের ধুলো সরাতে উদ্যোগী হতেন। বেথুন কলেজের লাইব্রেরির পুরনো নথি ঘাঁটেন, দেহরাদূনে যান চন্দ্রমুখীর বংশজদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার জন্য। চন্দ্রমুখী বসুকে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েটের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য লড়তে থাকেন সুনন্দা। ২০১৩ সালে, শেষ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মরণোত্তর প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েটের স্বীকৃতি দেয় চন্দ্রমুখীকে। সার্টিফিকেট তুলে দেওয়া হয় চন্দ্রমুখীর বংশজদের হাতে।

ইতিহাস নিজেকে সংশোধন করে। নিজেরই স্বার্থে। আমাদের স্বার্থেও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE