নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র
কোন কথায় যে কোন কথা বাহির হইয়া পড়ে! প্রধানমন্ত্রী এক দিনের জন্য নিজের সোশ্যাল মিডিয়ার মালিকানা মহিলাদের হাতে তুলিয়া দিতে চাহিলেন, আর জানা গেল যে দেশের অধিকাংশ মহিলার হাতে এখনও ইন্টারনেটই পৌঁছায় নাই। ২০১৯ সালের সর্বশেষ সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে, সর্বভারতীয় স্তরে যত মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁহাদের ৬৭ শতাংশ পুরুষ, ৩৩ শতাংশ মহিলা। অর্থাৎ, পুরুষের সংখ্যা মহিলার দ্বিগুণ। গ্রামাঞ্চলে, অর্থাৎ ভারতের সিংহভাগ মানুষ যেখানে বাস করেন, সেখানে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক— ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাত্র ২৮ শতাংশ মহিলা। এই বৈষম্য কেন, তাহা বোঝা সহজ— ইন্টারনেট ব্যবহার করিতে গেলে হয় কম্পিউটার নয় স্মার্টফোন-ট্যাবলেট গোত্রের কোনও একটি যন্ত্রের প্রয়োজন। যে গৃহস্থালিতে এই যন্ত্র পৌঁছাইয়াছে, সেখানে যন্ত্রের উপর প্রথম ও প্রধান অধিকার পুরুষের। ইহাই পিতৃতন্ত্রের নিয়ম। বস্তুত, কেন পরিবার বা গৃহস্থালির স্তরে পরিসংখ্যান গ্রহণ করিলে বৈষম্যের ছবি স্পষ্ট ধরা পড়ে না, কেন ব্যক্তিস্তরের পরিসংখ্যান প্রয়োজন, এই বৈষম্য তাহাকে স্পষ্ট দেখাইয়া দেয়। এবং বলিয়া দেয়, নারী দিবসের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় উপহার সত্ত্বেও মহিলাদের ক্ষমতায়ন এখনও বিশ বাঁও জলে। মাছের টুকরার আয়তন হইতে দুধের ভাগ, অথবা স্মার্টফোন ব্যবহারের সুযোগ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মহিলারা পরিবারের পরিসরে পিছাইয়া আছেন। তাঁহাদের হাতে উপহারস্বরূপ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট তুলিয়া দিতে চাওয়ার মধ্যে একটি নিষ্ঠুর রসিকতা আছে। সেই নিষ্ঠুরতা গণহত্যার প্রেক্ষিতে কুকুরছানার গাড়িচাপা পড়িবার কথা তুলিবার ন্যায়।
বর্তমান ভারতে উন্নয়নরাষ্ট্রের যে কঙ্কালটুকু পড়িয়া আছে, তাহার মূল চালিকাশক্তি এখন অনলাইন। তথ্যও অনলাইন আসে, পরিষেবার জন্যও অনলাইন দুনিয়ায় যাতায়াতের অভ্যাস থাকা প্রয়োজন। তাহা যে মূলগত ভাবে ক্ষতিকর, বলিবার কারণ নাই। প্রযুক্তি হইতে মুখ ফিরাইয়া থাকিলে কী হয়, ভারতে কম্পিউটারের আদি যুগে বামফ্রন্ট তাহা বহু মূল্যে শিখিয়াছিল। কিন্তু, দেশের অর্ধেকের অধিক মানুষের যে প্রযুক্তিতে অধিকার নাই, উন্নয়নের হাল তাহার হাতে ছাড়িয়া দেওয়ার অর্থ, সেই জনগোষ্ঠীকে আরও এক ধাপ পিছাইয়া দেওয়া। একবিংশ শতকে তথ্যের মাহাত্ম্য প্রশ্নাতীত। সেই তথ্যের মূল বাহন যদি অনলাইন হয়, তবে যে মহিলারা পিতৃতন্ত্রের জাঁতাকলে পড়িয়া এই প্রযুক্তি হইতে বঞ্চিত, তাঁহারা আরও এক দফা বঞ্চিত হইবেন। রাষ্ট্রের সহিত সম্পর্ক রচিত হইবে শুধু পুরুষের। মহিলাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্বে রাষ্ট্রীয় সিলমোহর পড়িবে।
অতএব, মহিলাদের কথা যদি ভাবিতেই হয়, তাঁহাদের এক দিনের সুলতান বানাইয়া লাভ নাই। তাঁহাদের প্রকৃত ক্ষমতায়নের কথা ভাবিতে হইবে। কী ভাবে মহিলাদের নিকট ইন্টারনেট পৌঁছাইয়া দেওয়া যায়, সেই পরিকল্পনা করিতে হইবে। তাহার জন্য যদি সরকারি টাকা খরচ হয়, করিতে হইবে বইকি। তাহার জন্য প্রথম ধাপ হইল মহিলাদের সহিত রাষ্ট্রের সংলাপের একটি পরিসর গড়িয়া তোলা। পুরুষতন্ত্রের দাপটহীন পরিসর, যেখানে মহিলারা নিজেদের প্রয়োজনের কথা রাষ্ট্রকে জানাইতে পারিবেন। তাহার জন্য বুঝি আরও অনেক নারী দিবস পার করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy