ছবি: সংগৃহীত
তাঁরা সংখ্যায় গুটিকতক। ৩.৮৯ শতাংশ মহিলা সেনাকর্মী। মাত্র ৬.৭ শতাংশ নৌবিভাগে। ১৩.২৮ শতাংশ বায়ু সেনায়। লিঙ্গ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি এ এক নজরকাড়া অবহেলা। এখন ঘর-দোর–কর্মক্ষেত্র ফেলে আইনের চক্করে জেরবার হচ্ছে স্বপ্ন দেখার মন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থায়ী সেনাবাহিনীর দেশে নিজেদের অধিকার কায়েম করতে হয়রান হচ্ছেন মহিলা সেনা অফিসার। উড়ান নিয়ামক মিনতি আগরওয়াল পাকিস্থানি এফ ১৬-কে গুলি করে নামাতে উইং কমান্ডারকে নির্দেশে দেওয়ার কাজ করেছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিতালি মধুমিতা ভারতীয় দূতাবাস থেকে সন্ত্রাস আক্রমণকালীন উদ্ধার করেছিলেন আহতদের। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট গুঞ্জন সাক্সেনা কারগিল যুদ্ধের সময় আহত সেনাদের বাঁচিয়েছিলেন। তারপরেও মহিলা আর্মি অফিসারদের কমান্ডার পদের দাবি প্রতিষ্ঠায় এসে পড়ল দৈহিক- মানসিক মান, গর্ভাবস্থা, মাতৃত্ব এবং ঘরোয়া বাধ্যবাধকতার প্রশ্ন !
ভাওয়ানা কন্থ দেশের প্রথম মহিলা জঙ্গি বিমান চালক দক্ষতার সঙ্গে কাজ চালিয়েছেন। লেফটেন্যান্ট শিবাঙ্গি নৌ-অপারেশনে যোগ দিয়েছেন। ক্যাপ্টেন তানিয়া সেরগিল প্রথম মহিলা কুচকাওয়াজ সহায়ক হিসেবে সেনাদিবসে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভারতীয় সেনাদলকে। গ্রহণযোগ্যতার ভ্রূকুটিকে মহিলারা সহজ ভাবেই অতিক্রম করেছে। তবে কেন বদলে গেল না না আজও সমাজ মানসিকতা। নাকি তা কালের বিবর্তনে ছেড়ে দেওয়া শ্রেয়? কিন্তু ঠিক কতকাল পেরিয়ে গেলে মেয়েদের পথের সাজানো কাঁটা ফুল হয়ে নজির গড়বে তা জানা-বোঝার অগোচরে থেকে যাচ্ছে।
মহিলা অফিসারদের পদের দাবির প্রশ্নে সাজনো হয়েছে নানা অবৈজ্ঞানিক অনুমান ও ভাবনা। মেয়েদের কমান্ডার পদে মানায় না। কারণ পুরুষ অফিসাররা নাকি তাঁদের দেখতে চান না! এমনকি গাঁ-গঞ্জ থেকে আসা দেশকর্মীরা নাকি মানসিক ভাবে প্রস্তুত নন ওই পদে মহিলাদের দেখতে। যদি মেনে নেওয়া হয় যে, এই পুরুষতান্ত্রিকতাই সামাজিক ধাঁচা তবে তার খোলনলচে বদলের দায় কার? শাসকের অভিভাবকত্বেই দেশ –সমাজের দর্শন বদলাবে, সে জন্যই তো কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ভোটযজ্ঞ। মেয়েদের সমান সুযোগ ও উচ্চপদে বহাল রাখার পক্ষে সওয়াল করবে সরকার এটাই প্রত্যাশিত।
কমান্ডার পদে মহিলা অফিসারদের দাবি নাকচ করতে দু’টি স্পষ্ট বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। এক দৈহিক-মানসিক ও অন্যটি গার্হস্থ্য। শারীরিক মানের ভিন্নতার কারণেই নাকি মহিলা ও পুরুষ এই পদের দাবির ক্ষেত্রে সমানাধিকার পেতে পারে না। মহিলাদের সহজাত মানসিক পার্থক্য সমান দৈহিক দক্ষতা প্রদর্শনের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে কম্যান্ড ইউনিটে মহিলা সেনার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। মনোবিজ্ঞানী ডায়ান হালপারেন প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, শারীরিক মানের ভিন্নতা মানে অভাব বা দুর্বলতা নয়। জৈবিক ও পরিবেশগত পারস্পরিক প্রভাবে এই মান আকার ও দিক বদলাতে পারে। যুদ্ধে যাওয়ার মান পূরন করতে পারলে মেয়েদের সুযোগ নষ্ট হওয়া ঠিক নয়।
মহিলা সেনা অফিসারদের বৈষম্যের ইতিহাস পুরনো। ১৯৯২ সালের পর চালু হয় মেয়েদের অ- যুদ্ধ (নন কমব্যাট) ভুমিকায় নিয়োগ। সেই নিয়োগের ভিত্তি ছিল স্বল্পদিনের (শর্ট সার্ভিস কমিশন)। প্রারম্ভিক মেয়াদ ছিল পাঁচ বছরের। তারপর তা সাত ও চোদ্দ বছর বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে স্বল্প দিনে নিযুক্তরা স্থায়ীত্বের (স্থায়ী সার্ভিস কমিশন) জন্য আবেদন করলেও সেই সুযোগ পাননি। যদিও শর্ট সার্ভিসে থাকা পুরুষ সহকর্মীদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়। চোদ্দ বছর কাজ করেছেন এমন মহিলা অফিসারদের কুড়ি বছরের এক্সটেনশন দেওয়া হয়। কিন্তু স্থায়ীকরণের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মহিলা অফিসারদের কুড়ি বছর চাকরি হয়ে গেলে পেনসন দিয়ে অবসর দেওয়া হয়। বেকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকরির প্রাপ্য অন্য সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হন। স্বল্পদিন (শর্ট সার্ভিস) নিযুক্ত মহিলারা মাত্র চব্বিশ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ পান। অথচ ওই একই সার্ভিসে থাকা পুরুষ সেনা অফিসারদের ঊনপঞ্চাশ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ মেলে। বায়ুসেনা দপ্তর স্থায়ী কমিশনের পথে হাঁটলেও নৌ ও সেনা বিভাগে মহিলারা প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে। ২০১৫ সালে মহিলাদের সামরিক পুলিশ হিসেবে নিয়োগের ঘোষণার তিন বছর পর শুরু হয় নিয়োগের পদ্ধতিগত কাজ ।
পদ পাওয়ার পথে অন্তরায় হিসেবে এসেছে পরিবারের পূর্ন সহযোগিতার অভাব ও ছুটি-বদলি নিয়ে অহেতুক টানাপড়েন। মানুষ আর কবে ভাবতে শিখবে যে প্রত্যেক শিক্ষিত ও যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষের দু’টি পরিবার। এক ব্যক্তিগত ও অন্যটি কর্মক্ষেত্র। দু’টি দিকেই সমান মনোযোগ ও নিষ্ঠা প্রয়োজন। একজন পুরুষ যদি পরিবারের সহায়তায় দেশ সেবা ও পদ অর্জন করতে পারে, তবে এক মহিলা কেন নয়? মেয়েরাই পারিবারিক দায়িত্বে চ্যাম্পিয়ন, এই কথার ভিত্তি কী? এই জেন্ডার আরোপিত ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেশকেই দেখাতে হবে। মহিলা অফিসারদের কম্যান্ড পদে আনার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ-নিরাপত্তা ও সহযোগিতার বদলে তাদের নিরাশ করা কোনও কাজের কথা নয়।
বদলাচ্ছে যুদ্ধের ধারণা ও সশস্ত্র বাহিনীর ধাঁচা। নানা অজুহাত তুলে তাঁদের পদ না দেওয়া কি নেহাতই অজুহাত নয়? সেনাবিভাগে ‘পুরুষ মানসিকতা’ প্রশ্নটি তুলে ধরা অবান্তর। এটি কিন্তু কোনও অলৌকিক শক্তি নয়। একে বদলের প্রয়াসও জটিল কিছু নয়। সমাজের মুলস্রোতের একাংশকে স্থবির করে রাখার মধ্যে যে মানসিকতাই থাকুক না কেন প্রগতির ছাপ নেই।
‘উওম্যান অ্যাট ওয়ার’ বইটিতে গবেষণামূলক ভাবে ক্যামেরুন রিচি দেখিয়েছেন নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা অর্থপূর্ণভাবে মোকাবিলা করা হয় না সামরিক বাহিনীতে। তারপরেও মেয়েদের আকাঙ্ক্ষা মরে না। পিছু হটতে তাঁরা নারাজ। যুদ্ধ পরিচয়কে পুরুষের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া এক ঐতিহাসিক কুসংস্কার। বিশ্বের সব দেশই এর থেকে নিজেদের মতো করে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। বিশ্ব জুড়ে জেন্ডার বিনির্মাণের প্রয়াস জারি হয়েছে। মানবসম্পদের পূর্ণ বিকাশেই লুকিয়ে উন্নতির চাবিকাঠি। পাল্লা দিয়ে আমেরিকায় বাড়ছে মহিলাদের গ্রন্থাগার যাওয়ার ধুম। মেয়েরা কী পারে বা পারে না সেই ধারনার তালিকায় বদল আনা হচ্ছে। ফ্রান্স, কানাডা, আমেরিকা, ইজরায়েল মহিলা কমান্ডার নিয়োগ করেছে। এক পুরুষ ও এক মহিলার মান সমান করে তৈরি করার দায়িত্ব থেকে রাষ্ট্র কখনও অব্যাহতি পেতে পারে না। মেয়েদের এগিয়ে দিতে তাই সুসংহত পরিকল্পনা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা গড়তে রাষ্ট্রের অতিসক্রিয়তা দরকার। সাহসের জন্য পদক। তবে পদ নয় কেন?
শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy