ষাটোর্ধ্বদের মুখে শুনছি, “আগে সবাই টিকা নিক। কাজ হচ্ছে কি না দেখে ভাবব টিকা নেব কি না।” সমাজমাধ্যমে রসিকতা চলছে, “স্বাস্থ্যকর্মীদের আগে প্রতিষেধক দেবেন না। বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে।”
প্রতিষেধক নিয়ে আমজনতার মধ্যে দ্বিধা তৈরি হচ্ছে এই ভাবেই। নভেম্বরের সমীক্ষায় প্রতিষেধক নেওয়া নিয়ে সংশয়ে ছিলেন ৫৯%। এক মাসেই সেই হার বেড়ে ৬৯%। ৫৫% স্বাস্থ্যকর্মীও দোলাচলে। কারণ অনেকগুলি। প্রতিষেধকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে সীমিত তথ্য, কার্যকারিতা নিয়ে ধোঁয়াশা এবং একাংশের ধারণা যে তাঁদের প্রতিষেধকের দরকার নেই। তাঁরা মনে করছেন, কোভিড-আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে ও মানুষের প্রতিরোধের ক্ষমতা বেড়েছে। প্রতিষেধক দ্রুত বাজারে ছাড়া, তার পরীক্ষানিরীক্ষার তথ্যাদি নিয়ে সরকারি ও উৎপাদনকারীদের ধোঁয়াশায় দ্বিধা বাড়ছে। বিরোধী নেতারা ভারতে উপলব্ধ প্রতিষেধক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রতিষেধক নেওয়ার পরে নরওয়েতে বহু বয়স্ক মারা গিয়েছেন। ভারতেও অ্যালার্জি, জ্বর দেখা গিয়েছে। প্রতিষেধকের কারণে কত শতাংশের অ্যালার্জি ও জ্বর হতে পারে, সেই ধারণার অভাব ধন্দ বাড়িয়েছে।
কেবল কোভিড নয়, যে কোনও ক্ষেত্রে টিকা নেওয়ার বিরুদ্ধে এমনিতেই বিশ্ব জুড়ে আন্দোলন চলে, চলে নানা ষড়যন্ত্রের তত্ত্বও। যেমন— প্রতিষেধকে শিশুমৃত্যু ঘটে, বড়দের স্বাস্থ্যহানি হয়! প্রাকৃতিক নিয়মেই তো শরীর সুস্থ থাকে, বাইরের প্রতিষেধকের দরকার নেই, ইত্যাদি। মূলত হাতুড়ে ও ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্যই এমন প্রচার।
বহু ক্ষেত্রে প্রতিষেধক-বিরোধীরা বলে থাকেন, প্রতিষেধকের ১০০% ক্ষেত্রে কার্যকারিতা দেখা দিলে তবেই প্রতিষেধক নিতে চাইবেন মানুষ। কিন্তু কোনও প্রতিষেধকই কি সব ক্ষেত্রে সবার উপরই সমান কাজ করে? ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক ৫০% কাজ করাতেই কিন্তু রোগটি নিয়ন্ত্রণে এসেছিল।
পোলিয়ো টিকা নিয়ে ভারতে পুরুষত্ব হারানোর ও জন্মনিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল। তা নির্মূলে ধর্মনেতাদের সাহায্য নিতে হয় সরকারকে। কর্নাটক ও তামিলনাড়ুতে গুজব ছড়িয়েছিল, হামের প্রতিষেধকে শূকর-নিঃসৃত কিছু রয়েছে। এর ফলে বহু জায়গায় টিকাকরণ থমকে গিয়েছিল।
কোভিডের প্রতিষেধক নিয়েও নানা খবর ছড়াচ্ছে। যেমন, ফাইজ়ারের প্রতিষেধক আসলে চিনে বানানো, তাই ভরসার অযোগ্য। এ দিকে ভারতের ভ্যাকসিনের চাহিদা কিন্তু বাইরেও। বেশ কিছু দেশ আগে থেকেই বায়না দিয়েছে!
ভারতের ভ্যাকসিন নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সঙ্গত কারণ আছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও মনে রাখা ভাল যে, ভ্যাকসিন বিষয়ক সব সংশয়ই সঙ্গত নয়। বহু ক্ষেত্রে সংস্কার, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থও কাজ করে। ভুল তথ্য, অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে যেমন ভ্যাকসিন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, একই ভাবে ভ্যাকসিন সম্পর্কে সন্দেহের পিছনেও অনেক ক্ষেত্রে ভুল তথ্য ঘুরছে। মুশকিল হল, ভ্যাকসিনের পক্ষে বা বিপক্ষে তথ্যের মধ্যে ফারাক করা আমজনতার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ কাজ। কেবল আমজনতা কেন, বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও প্রতিষেধক নিয়ে মতপার্থক্য প্রচুর। সমাজমাধ্যম বলছে, প্রতিষেধক নিয়ে ভুয়ো পোস্ট মুছবে বা লাল পতাকা লাগিয়ে দেবে। কিন্তু ভ্যাকসিন বিষয়ক সঠিক তথ্যও যে সমাজমাধ্যমে পাওয়া যাবে, তাই বা কী করে নিশ্চিত করা যাবে?
এই পরিস্থিতিতে জনগণকে সচেতন করতে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। এটা অন্য কারও দায়িত্ব হতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকারকেই জানাতে হবে, কেন টিকা নির্ভরযোগ্য, টিকা বিষয়ে যে প্রশ্ন বা সংশয় শোনা যাচ্ছে, তার উত্তরই বা কী। ভারত সরকারের তরফে কোভিডের তথ্য যাচাইয়ের পোর্টাল রয়েছে।
প্রতিষেধকের খবরের মোকাবিলায় সেটিরই ব্যবহার হোক। তথ্য না লুকিয়ে, আধা-তথ্য না দিয়ে জনগণের সঙ্গে স্বচ্ছ তথ্য আদানপ্রদান চলুক। কোভিড-সংক্রান্ত কর্মশালায় সরকারি তথ্যের প্রতি অবিশ্বাস দেখা গিয়েছে। যে কারণে এই অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, সেই কারণগুলো দূর করতে কেন্দ্রীয় সরকার কী করছে, সেটা জানাও জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। তার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প বহুলাংশে দায়ী। তাঁর সমর্থকদের পরিচালিত ‘কিউঅ্যানন’ তো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আখড়া। এ দেশে গোমূত্রে করোনা দূর হবে বলে যে নেতারা লাফিয়েছিলেন, তাঁরাও সরকারি তথ্যে অবিশ্বাস তৈরির জন্য দায়ী।
প্রতিষেধক নিয়ে কী ধরনের কথা হচ্ছে, গুজব ছড়াচ্ছে বা ছড়াতে পারে, সেটা বুঝেই সরকারের তরফে জনসচেতনতা বাড়ানো উচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, কী ধরনের ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ছড়াতে পারে আগে থেকেই তার প্রচার করলে মানুষ আগাম সচেতন হবেন। কাজটা কঠিন। কিন্তু প্রতিষেধক নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ-সহ তথ্যের ভান্ডার গড়ে দেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলিতে প্রচার করলে টিকাকরণের অভিযানে সাফল্য আসবে।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিষেধক নিতে শুরু করেছেন। সাফল্য আসার পর তাঁরা প্রচারে অংশ নিলে টিকা-দ্বিধা প্রতিরোধ জোরদার হবে। যে নেতারা স্বাস্থ্যকর্মীদের ডিঙিয়ে গিয়ে টিকা নিয়েছেন, তাঁরাও প্রতিষেধকের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে পারেন। জো বাইডেন, কমলা হ্যারিস, রানি এলিজ়াবেথ টিকা নিয়েছেন, ভয় কাটাতে সাহায্য করেছেন। নেতারা সাহস করে প্রতিষেধক নিচ্ছেন দেখলে মানুষের ভরসা বাড়বে। টিকাকরণের সঙ্গেই প্রতিষেধক নিয়ে তথ্য স্বচ্ছ ভাবে জানানো প্রয়োজন। কঠিন পরিস্থিতি। কঠিন পথেই এগোতে হবে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব মাস কমিউনিকেশনস, ঢেঙ্কানল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy