প্রতীকী ছবি।
যাহা হইতে পারিত বৎসরব্যাপী দুঃস্বপ্নের পরিসমাপ্তির সূচনালগ্ন, ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য, সেই মুহূর্তটি নূতনতর দুশ্চিন্তার কারণ হইয়া উঠিল। জরুরি ভিত্তিতে কোভিড-১৯’এর দুইটি টিকাকে ছাড়পত্র দিয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার। এবং, দুইটি টিকা লইয়াই প্রশ্ন উঠিয়াছে। যে ‘কোভ্যাক্সিন’ টিকাটি লইয়া প্রধানমন্ত্রী অতি গর্বিত, এখনও অবধি তাহার কার্যকারিতা বিষয়ে কোনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলে নাই; কোনও ‘পিয়ার রিভিউড জার্নাল’-এ তাহার পদ্ধতিগত আলোচনা প্রকাশিত হয় নাই; তাহার তৃতীয় দফা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয় নাই; কত শতাংশ ক্ষেত্রে টিকাটি কার্যকর হইতেছে, সেই অঙ্কটি পর্যন্ত অজানা। নির্মাতা সংস্থার প্রধান যে ভঙ্গিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়াছেন, তাহাতে ঔদ্ধত্য আছে, বিজ্ঞানমনস্কতা নাই। সেই ঔদ্ধত্যের উপর ভরসা করা দেশবাসীর পক্ষে কঠিন, সন্দেহ নাই। অন্য দিকে, অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারতে যে ‘কোভিশিল্ড’ টিকা তৈরি হইয়াছে, তাহার ক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত প্রশ্ন উঠিয়াছে। এখনও অবধি নিশ্চিত নহে যে, সেই টিকাটি কোভিড-১৯’এর বিপদ বাড়াইয়া তুলিবে না। এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষকে নিশ্চিন্ত করিতে পারে না। বিশেষত, আর এক সপ্তাহের মধ্যেই বাজারে টিকা পৌঁছাইয়া যাইবে, টিকাকরণ প্রক্রিয়াও শুরু হইয়া যাইবে। রোগ অপেক্ষা প্রতিষেধকের বিপদ অধিকতর হইয়া উঠিবে কি না, মানুষকে এই বাড়তি অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষেপ করিবার প্রয়োজন ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে মানুষ কাহার কথা বিশ্বাস করিবে? স্বাভাবিক অবস্থায়, সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর দিকে চাহিয়া থাকিত। তাঁহার নিকট পথনির্দেশিকা প্রত্যাশা করিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই উপায় রাখেন নাই। তাঁহার সাড়ে ছয় বৎসরের শাসনকাল সাক্ষ্য দিবে, তিনি যত কথা বলিয়াছেন, যত কাজ করিয়াছেন, তাহাতে দেশের বিশেষ উপকার হয় নাই, যদিও তাঁহার লাভ হইয়াছে বিলক্ষণ। কাজেই, তিনি যখন দেশজ টিকার গুণগান করিতেছেন, তখন সাধারণ মানুষ কী ভাবে বিশ্বাস করিবে যে, সেই প্রশস্তি ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নামক রাজনৈতিক প্রকল্পের প্রচারমাত্র নহে? যোগী আদিত্যনাথের ন্যায় নেতারা ইতিমধ্যেই টিকা প্রস্তুতির কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীকে অর্পণ করিতে ব্যস্ত। এই প্রচারই যে তড়িঘড়ি টিকার ছাড়পত্র দিবার চালিকাশক্তি নহে, তাহা বিশ্বাস করা কি খুব সহজ হইবে? টিকা নির্মাতা সংস্থার প্রধান যখন টিকার কার্যকারিতার প্রমাণ পেশ করিবার জন্য সাত দিন সময় দাবি করেন— ঘটনাক্রমে, যে সাত দিন অতিক্রান্ত হইবার অব্যবহিত পরেই টিকাকরণ শুরু হইয়া যাইবে— তখন মানুষ কী ভাবে বিশ্বাস করিবে যে, সত্যই সাত দিন পরে প্রমাণ মিলিবে? নোট বাতিলের উপযোগিতা প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী পঞ্চাশ দিন সময় চাহিয়াছিলেন, সেই কথাটিও দেশবাসী ভোলে নাই।
বৃহত্তর অর্থে, টিকা লইয়া এই সংশয়ের প্রধানতম কারণ, বর্তমান শাসনকালে স্বচ্ছতার অভাব সর্বাত্মক ও প্রবল। সরকার যাহা করিতেছে, তাহার পিছনে কী উদ্দেশ্য আছে, এবং তাহা সাধারণ মানুষের স্বার্থের সমানুবর্তী কি না, গত সাড়ে ছয় বৎসরে এই বিষয়ে দেশবাসী কখনও নিশ্চিন্ত হইতে পারে নাই। অতিমারির প্রতিষেধকের ক্ষেত্রেও যদি মানুষকে এই অনিশ্চয়তায় ভুগিতে হয়, তাহার তুল্য দুর্ভাগ্য আর কী হইতে পারে? এক্ষণে মানুষকে আশ্বস্ত করা প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য। বিহার নির্বাচনে যেমন কোভিড-১৯’এর টিকাকে রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার বানাইয়াছিল বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যেন তাহা না হয়। টিকার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাপকাঠি ব্যবহৃত হইতেছে, তাহার প্রমাণ দেশবাসীকে দিতে হইবে। যেখানে প্রশ্ন মানুষের জীবন-মরণের, সেখানে রাজনৈতিক স্বার্থের গুরুত্ব অধিক হইতে পারে না। দলের গণ্ডি ভাঙিয়া প্রধানমন্ত্রী দেশের নেতা হইয়া উঠুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy