ঐতিহাসিক তথ্য থেকে বর্তমান পরিসংখ্যান, যুগে যুগে বিশ্ব জুড়ে নারী অবদমনের সাক্ষ্যপ্রমাণ। স্ব-অভিভাবকত্ব, সম্পত্তি, ভোটাধিকার থেকে উচ্চশিক্ষার অধিকারের অসম লড়াইয়ে বিশ্ব জুড়েই মেয়েদের শামিল হতে হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের মেয়েদের জন্মের অধিকারের যে লড়াই, তা সার্বিক ভাবে পৃথিবী জুড়ে পরিলক্ষিত হয় না।
এশিয়া মানবাধিকার কমিশনের ২০১৬-র কন্যাভ্রূণহত্যা বিষয়ক প্রতিবেদনে, ভারতের অবস্থান লিয়েচিস্তান ও আর্মেনিয়ার মতো অতি ক্ষুদ্র দু’টি দেশ বাদ দিলে চিনের পরেই। গবেষণা বলছে, ভারতে কন্যাভ্রূণহত্যার মূল কারণগুলি সামাজিক, কেবল অর্থনৈতিক নয়। মুশকিল হল, যে বিপন্নতা মূলত অর্থনৈতিক কারণে, অর্থনীতির উন্নতি সাধনের মাধ্যমে তার নিরাময়ের আশা থাকে। কিন্তু যে সমস্যার মূলে আজন্মলালিত সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন, ঐতিহ্যের মর্যাদা নিয়ে তা এমন ভাবে সমাজবিশ্বাসে পরিণত হয়, তা থেকে মুক্তি দুরূহ।
এ দেশে কন্যাভ্রূণহত্যা বিষয়ক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলি পুত্রসন্তানকে সম্পদ ও কন্যাসন্তানকে দায় হিসেবে গণ্য করার মানসিকতা দেখিয়ে দেয়। যার কারণ লুকিয়ে আছে এ দেশে চলে আসা নানা সমাজব্যবস্থায়। এমন একটি ব্যবস্থা হল বিয়ের পর ‘বাধ্যতামূলক ভাবে’ মেয়েদের স্বামীর পরিবারে বা প্রচলিত কথায় শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার রীতি। ‘বাধ্যতামূলক’ শব্দটি উল্লেখের কারণ, আজ কর্মসূত্রে, উচ্চশিক্ষার্থে বা নানা কারণে বিপুল সংখ্যক দম্পতি ভিন্রাজ্যে বা দেশে বাস করলেও বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে ওঠার রীতি বা বছরে এক বার বাড়ি ফিরলেও বিবাহিত মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে থাকাই প্রচলিত। এমনকি একলা অশীতিপর, বিধবা বা বিপত্নীক মা-বাবার একমাত্র সন্তান হলেও মেয়েদের শ্বশুরবাড়ির সংসারেই থাকতে হয়। নিতান্ত আধুনিক শ্বশুরবাড়িতে উপরের বা নীচের তলার ফ্ল্যাটে বা পাশের পাড়ায় ঘর বাঁধতে হয়, সপ্তাহান্তে হাজিরা দিতে হয়।
বিয়ের পর মেয়েদের এই বাধ্যতামূলক স্থানান্তরকরণের সমাজব্যবস্থা এক দিকে যেমন সংসারে মেয়েদের সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার পথে বাধা, অন্য দিকে তা মেয়েদের যথাযোগ্য আর্থ-সামাজিক মর্যাদা রক্ষারও অন্তরায়। কন্যাসন্তানের বিয়ের পর তার শ্বশুরবাড়িতে স্থানান্তরকরণ ঘটলে, পদবি ও গোত্র পরিবর্তন হলে, সে অন্য পরিবারেরই অংশে পরিণত হয়। তার সন্তানও সেই পরিবারেরই সদস্য, ধারক ও বাহক হয়। একই ভাবে সামাজিক রীতিনীতি, পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান সবই সে পালন করতে থাকে শ্বশুরবাড়ির প্রতিনিধি হিসেবে। ফলত, পিতৃপরিবারের বংশরক্ষায় মেয়েদের ভূমিকা থাকে না। তাই বংশরক্ষার তাগিদে পুত্রসন্তান-আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়। এই স্থানান্তরকরণ বৃদ্ধাবস্থায় মেয়েদের নিজেদের মা-বাবার দেখাশোনার বা দায়িত্ব নেওয়ারও পরিপন্থী। শ্বশুরবাড়িতে থাকার ও সেই পরিবারেরই সদস্য হওয়ার ফলে, তাদের দেখাশোনা করাই মেয়েদের প্রাথমিক দায়িত্ব হয়ে ওঠে, অবস্থানজনিত নৈকট্য তা সহজতর করে। ঠিক বিপরীত মেরুতে বিবাহিত পুরুষ বৃদ্ধাবস্থায় তার পরিবারের সহায় হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। তাই বয়সকালের নিরাপত্তাজনিত কারণ ও সন্তানকে সারা জীবন কাছে পাওয়ার বাসনা, পুত্রসন্তান-আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে তোলে।
তৃতীয় বিষয়টি যৌতুক প্রথা। বিয়ের পর মেয়ে যাতে শ্বশুরবাড়িতে সুখে থাকে ও শ্বশুরবাড়ির বোঝা না হয়, সে জন্য শুরু হওয়া এই যৌতুক ব্যবস্থা কী ভাবে কন্যাভ্রূণহত্যার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সে প্রসঙ্গে গত শতাব্দীর শেষে মহারাষ্ট্রের এক ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন মনে পড়ে— ‘বরং এখন ৫০০ দিন, পরে ৫০ হাজারের চেয়ে’। শহুরে শিক্ষিত মানুষ, যাঁরা যৌতুকের বাহারি নাম দিয়েছেন ‘উপহার’, তাঁরা খেয়াল রাখেন না, এ দেশে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় এক জন মহিলা যৌতুকজনিত নিপীড়নের বলি হন। যৌতুকজনিত ব্যয় ও পীড়নের ভার কন্যাসন্তান-আকাঙ্ক্ষার দ্বার রুদ্ধ করে।
বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়িরই সদস্য পরিগণিত হওয়ার ফলে, এক দিকে যেমন কর্মরতা মেয়েটির উপার্জন তার শ্বশুরবাড়িরই অংশ হয়ে দাঁড়ায়, তেমনই গৃহবধূ হলে তার অবৈতনিক গার্হস্থশ্রমও শ্বশুরবাড়িরই কাজে আসে। ব্যাপারটা এমন, কন্যাসন্তান লালন-পালনের দায়িত্বটুকু তার পিতামাতার, কিন্তু তার বিনিময়ে যতটুকু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য, সামাজিক সুরক্ষা ও সার্বিক সুখ, সবটাই তার শ্বশুরবাড়ির। স্বাভাবিক ভাবেই যে জিনিস আপনার নয়, যা থেকে প্রতিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং যা বংশরক্ষারও সহায়ক নয়, তা যে সস্তা ও অনাদরের হবে, সম্পদের বদলে দায় হিসেবেই গণ্য হবে, বলে বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না। এই বাস্তবতার নিয়ম মেনেই কন্যাসন্তানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রতি ঔদাসীন্য, বাল্যবিবাহের মতো ঘটনাও বাড়ে। নারীজীবন গার্হস্থ হিংসার শিকার হয়।
মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে স্থানান্তরকরণের বিষয়টি পুরোপুরি সামাজিক। পৃথিবীর কোনও আইন কোনও দিন বিবাহিতা নারীর শ্বশুরবাড়িতে থাকা বাধ্যতামূলক করেনি। প্রশ্ন জাগে, এই ব্যবস্থার সৃষ্টি কী ভাবে হল? কেনই বা তা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠল? বেশির ভাগ সামাজিক রীতির মতোই এ ব্যবস্থারও প্রারম্ভিক সূচনা ছিল প্রয়োজনভিত্তিক। মানুষ যত দিন বনে বাস করত, পশু শিকার করে পেট ভরাত ও যাযাবর জীবন যাপন করত, তত দিন নারী-পুরুষের সামগ্রিক অবস্থানে কোনও ভেদ ছিল না। পাথর ও আগুনের ব্যবহার শিখে, চাষাবাদ ও পশুপালনকে প্রধান জীবিকা হিসেবে বেছে নিলে, যাযাবর মানুষ স্থায়ী বসতি স্থাপনে উদ্যত হয়। স্থায়ী বসতি অর্থাৎ পরিবার, সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ব্যবস্থা। সমস্যা হল, পরিবার ও সম্পত্তি থাকলেই তাকে অন্যের হাত থেকে রক্ষার প্রয়োজন পড়ে; ফলে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ পেশিশক্তিভিত্তিক। প্রাকৃতিক ভাবেই নারী পুরুষের তুলনায় শারীরিক ভাবে কম শক্তিশালী, তাই যুদ্ধে পুরুষ একচ্ছত্র হয়ে ওঠে।
যুদ্ধের ফল হিসেবে সম্পত্তি অর্জন ও তার রক্ষক হিসেবে সম্পত্তির মালিকানা পুরুষের কুক্ষিগত হয়। সে যুগে সম্পত্তির সিংহভাগ জুড়ে থাকত স্থাবর সম্পত্তি, তাই তার উত্তরাধিকারী পুরুষ বিবাহোত্তর কালে স্থানান্তরিত হলে, তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা। নারীর সম্পত্তি নেই, তাই তার স্থানান্তরকরণ সহজ। এই প্রয়োজনভিত্তিক ব্যবস্থা ক্রমে সামাজিক রীতির রূপ নেয়। বিষয়টি সুবিধারও, কারণ বিবাহিতা কন্যা পিতৃগৃহে না থাকলে, পিতার সম্পত্তির অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা সহজ। এই সুবিধা নিতে পরবর্তী কালে একের পর এক এমন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয় যা নারীর মর্যাদা রক্ষার পরিপন্থী। নানা সামাজিক অনুশাসন তৈরি করে নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে, অভিভাবকত্বের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। তার বিদ্যাচর্চার, পৌরোহিত্যের অধিকার— সতীদাহ প্রথার প্রবর্তন করে স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার বেঁচে থাকার অধিকারও— কেড়ে নেওয়া হয়।
মানবসভ্যতার সার্বিক উত্তরণে উন্নত দেশগুলি এই পাকচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু দেশ সমাজব্যবস্থার ঐতিহ্যের তকমা এঁটে বয়ে চলে। এ দেশে শ্বশুরবাড়িকেই বিবাহিতা নারীর প্রকৃত বাসস্থান হিসেবে গণ্য করার বিষয়টিও তেমন। সময় ও অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভেবেই দেখিনি, বিবাহের পর নবদম্পতি হয়তো বা এই গতানুগতিকের বাইরে বেরিয়ে, যে পক্ষের পরিবারে প্রয়োজন বেশি সেই স্থানটিকে বেছে নিতে পারে। অথবা আজকের দিনের উন্নত দেশগুলির মতো গড়ে তুলতে পারে নিজের ঘর, নিজস্ব সংসার। তবে নিজস্ব সংসার গড়তে গেলে চাই অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, যার নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমা হয় না এবং ব্যক্তিবিশেষে যা ভিন্ন। সে ক্ষেত্রে স্বনির্ভর না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিকে সময় দিতে হবে। ত্রিশ বছর বয়স হলেই আত্মীয় বা প্রতিবেশীর মেয়েটির কেন এখনও বিয়ে হল না, সেই পরচর্চা থেকে বিরত হতে হবে। তড়িঘড়ি করে শুধু সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের প্রতি আনুগত্যে নয়, বিয়ের ভিত্তি হতে হবে সখ্যের, প্রেমের। এতে তরুণ-তরুণীর স্বনির্ভর হওয়ার তাগিদ তৈরি হবে, বেকার ছেলেদের শুধু সম্পত্তির লোভে পিতৃগৃহে বাস করে, বৃদ্ধ পিতামাতার উপর অত্যাচারের ঘনঘটা কমবে।
এই পরিবর্তনের জন্য ব্যক্তিগত ও সরকারি প্রচেষ্টা, দুই-ই প্রয়োজন। এক দিকে যেমন ব্যক্তি-মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি, অন্য দিকে সরকারি উদ্যোগকে শুধু নারীর সম অধিকার আইন বা ‘বেটি বচাও, বেটি পঢ়াও’ নীতিতে আটকে রাখলে চলবে না। নারীর অবক্ষয়ের সামাজিক কারণগুলিকে মূল স্তর থেকে বুঝতে হবে, ভোটবাক্সের অঙ্ক ভুলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও সামাজিক রীতির বিরোধিতা করার মতো কঠিন কাজটি দেশের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকেই শুরু করতে হবে।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy