Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

নীল আকাশে রঙিন ঘুড়ি উড়ছে কই!

স্মার্টফোন, স্মার্ট টেলিভিশনের উন্নততর পৃথিবীতে ছোট ছেলেমেয়েরা কি ঘুড়ি ওড়াতে ভুলে যাচ্ছে? না কি, ঘুড়ি ওড়াতে শেখানোর মতো অভিভাবকেরই অভাব পড়ছে? বিশ্বকর্মা পুজোর দিনেও আকাশে থেকে যায় হাতেগোনা ঘুড়ি। লিখছেন দীপঙ্কর বক্সীআমাদের কিশোরবেলার ছোটরা মাঞ্জা দেওয়া সুতো তৈরি করত ঘরেই। দোকানে থেকে কোনও রেডিমেড সুতো কেনা হত না। তখন বাজারে ছিল না চাইনিজ় মাঞ্জা নামক কোনও ‘মারণ’ সুতো।

ঘুড়ি ওড়ানো আনন্দে। নিজস্ব চিত্র

ঘুড়ি ওড়ানো আনন্দে। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

এক ফোটোগ্রাফার বন্ধু এক বার বলেছিলেন, রঙিন আকাশ দেখার জন্য দুর্গাপুজোর আগের এই মাসখানেক সময় হল আদর্শ। আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষা শেষে তখন ধুলো মোছা ঝকঝকে আকাশ। তাতে গাভীর মতো মেঘ চরে বেড়াচ্ছে। সেই মেঘে ঠিকরে পড়ছে শেষ বিকেলের আলো। বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে বিভিন্ন রঙে। আমাদের কিশোরবেলায় অবশ্য সেই মেঘেদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ ছিল। মেঘ ছুঁতে যাওয়ার উপকরণ ছিল কাগজে তৈরি একটা ফিনফিনে ঘুড়ি আর কাচের গুঁড়ো জড়ানো সুতো।

সেই রঙিন আকাশে ছোট ছোট অসংখ্য চতুর্ভুজ ভেসে বেড়াত বিভিন্ন দিকে। কখনও সুতোয় সুতো জড়িয়ে ভেসে ভেসে মাটির দিকে নেমে এলে গলি জুড়ে ‘শোর’ উঠত ‘ভোক্কাট্টাআআ..’। বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর। অলস দুপুরে মা-দিদিমারা যখন ঘুমোচ্ছেন, তখন স্কুল পালানো একদল কিশোর বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে বা মাঠে মাঠে দৌড়চ্ছে। আর কী উল্লাসে বিশাল নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে এই জয়ধ্বনি তুলছে— ভোকাট্টা।

আমাদের কিশোরবেলার ছোটরা মাঞ্জা দেওয়া সুতো তৈরি করত ঘরেই। দোকানে থেকে কোনও রেডিমেড সুতো কেনা হত না। তখন বাজারে ছিল না চাইনিজ় মাঞ্জা নামক কোনও ‘মারণ’ সুতো। ঘরের কাকা-দাদারাই দুই খুঁটিতে সুতো জড়িয়ে তাতে একে একে আঠা আর কাচের গুঁড়ো দিয়ে মাঞ্জা দিতে শেখাত। সেই সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার দিনও ছিল উৎসব। ভাঙা টিউবলাইট থেকে কাচের গুঁড়ো তৈরি করতে গিয়ে কতবার যে বাবা-কাকাদের হাত কেটে গিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রাথমিক ভাবে আঠায় রঙ মিশিয়ে সুতোয় লাগানোর দায়িত্ব ছোটদের উপরেই থাকত। কচ্চিৎ কাচের গুঁড়োর ব্যবহার হলে বড়রা সেই ঝুঁকির কাজ সামলাতেন। বিশ্বকর্মা পুজোর প্রায় দিন পনেরো আগে থেকে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত মাঠে-ঘাটে। ছাদে ছাদে। সে যেন একটা ব্যাপার!

তার পরে পুজোর দিন বিকেলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুড়ির লড়াই। কখনও সখনও সেই লড়াই শত্রুতাতেও গড়িয়েছে। অলিতে-গলিতে ছেলেদের দৌড়। আর ভোকাট্টা রব। আমগাছ, নিমগাছে আটকে যাওয়া ঘুড়ি টেনে নামানোর তোড়জোড়। বিশ্বকর্মা পুজো হয়ে যাওয়ার পরেও সেই সব রেশ থেকে যেত। থামত দুর্গাপুজো-লক্ষ্মীপুজো পেরিয়ে।

ঘুড়ি ওড়ানোর বিনোদন যে খুব পুরনো এমনটা অবশ্য বলা যায় না। তবে শুনেছি, পড়েছি কলকাতার বাবুদের ঘুড়ি উড়িয়ে অবসর সময়ে আনন্দ নেওয়ার অভ্যাস ছিল। এই বাবুরা ঘুড়ির লেজে টাকা লাগিয়ে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তির বিজ্ঞাপন করতেন। যে যত বড়লোক, তার টাকার অঙ্ক তত ভারী। এই কলকাতার বাবুরা তাঁদের বাড়ির ছাদ থেকে ঘুড়ি ওড়াতেন। তাঁদের প্রতিপক্ষের ঘুড়ির সুতো কাটতে পারলে লড়াইয়ের জয়ধ্বনি ঘোষণা করতেন রণভেরি বাজিয়ে। জানা যায়, আশুতোষ দেব (অর্থাৎ, লাটুবাবু), ছাতুবাবু তাঁদের আত্মীয় পরিজনেরা ওঁদের সময় ঘুড়ি ওড়াতে খুবই পছন্দ করতেন। এমনকি, অবিভক্ত বাংলায় ঘুড়ি ওড়ানোর ধূম ছিল বড় রকমের। মকর সংক্রান্তির সময় পূর্ব এবং উত্তর বাংলায় এই ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব চলত। পরে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে এই খেলার আনন্দ ছোট ছেলেমেয়েরা তুলে নেয় বিশ্বকর্মার পুজোর সময় ও শরৎকালে।

এ বার ছোট ছোট কয়েকটা মজার কথা বলি। উত্তর কলকাতায় থাকতেন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে। উনিও ছোটবেলা থেকে ঘুড়ি ওড়াতে পছন্দ করতেন। শোনা যায়, পরে যখন উনি কর্মসূত্রে মুম্বই গেলে, সেখানেও নাকি প্রতি রবিবার মহম্মদ রফির সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতেন।

ঘুড়ির অনেক নাম, অনেক ধরন। ছবি ও নকশাও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, চৌরঙ্গি (চার রঙের), পেটকাটি (দুই রঙের), চাঁদিয়াল (যে ঘুড়ি পেটের মাঝে আঁকা থাকে চাঁদ)। সবচেয়ে ছোট্ট ঘুড়ি হল সিক-তেল। আর অন্যগুলো আধ-তেল, এক-তেল, দুই-তেল। এমনও বড় ঘুড়ি আছে যার নাম অক্টোপাস, বিগ ব্লু বিস্ট, যা ইউরোপের বেলজিয়ামে পাওয়া যায়।

ঘুড়ি বানানোর শিল্প কিন্তু খুবই সুক্ষ্ম। তৈরি করা হয় পাতলা কাগজে বাঁশের কাঠি দিয়ে। সবচেয়ে দামী ঘুড়ি বানানো হয় অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি কাগজে। তবে আমাদের দেশে ঘুড়ির কাগজ সাধারণত আনা হয় উত্তরপ্রদেশ থেকে, বাঁশের কাঠ ত্রিপুরা থেকে।

এই ঘুড়ি খেলার বিনোদন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে জনপ্রিয় হয় অবশ্য নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের লখনউ থেকে আগমনের পরে। এই নবাবেরও অবসর কাটানোর বিশেষ বিনোদন ছিল ঘুড়ি ওড়ানো। নবাবদের ঘুড়িগুলি হত পাতলা সুন্দর কাগজের নানান রঙের জরির পাড় দেওয়া। লাটাইগুলি হত চমৎকার বাঁশের তৈরি। নকশায় ভরা।

কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সব সরু সুতোর উপর মাঞ্জা দেওয়া হয়। মোটা সুতোর মাঞ্জা হয় হুগলি-হাওড়ার দিকে। ঘুড়ি, লাটাই, সুতো ইত্যাদির খুব নামকরা দোকানের মধ্যে হল, কালীঘাটের ‘দেবালয়’, উত্তর কলকাতার ‘ঘুড়ি ঘর’, ক্রিক রো’র ‘ঘুড়ি’। কলকাতায় তৈরি ঘুড়ি হুগলি, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ায় বেশি বিক্রি হয়।

সবশেষে বলি, এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার আবিষ্কার ও অসাধারণ উন্নতির যুগে শিশু-কিশোরেরা বড় হচ্ছে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে। সেই ছটফটে প্রাণচঞ্চল পা’গুলি ছুটছে না বন্ধুদের সঙ্গে। সোনাঝরা রোদ্দুরের অপরাহ্নে অনেক ঘুড়ির মাঝে একটা ঘুড়ির পিছে তারা ছুটছে না সরল, বিহ্বল আনন্দে। মুক্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠছে না ভো-কা-ট্টাআআআ...

সার্কেল ইনস্পেক্টর অব পুলিশ, মানবাজার সার্কেল, পুরুলিয়া

অন্য বিষয়গুলি:

Flying Kites Vishwakarma Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy