আলোর মালায় অযোধ্যা। ছবি: পিটিআই।
সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল। আর তার পরই বোধ হয় এই রামমন্দির। মাঝখানটায় শিল্প সংস্কৃতির যে বিশাল একটা অন্তর তৈরি হয়ে রইল, তারও হয়তো একটা প্রতিপূরণ তৈরি হবে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠায়। তবে কি না, এই মন্দির প্রতিষ্ঠার দ্বারা কীসের প্রতিপত্তি হইল? কয়জন অভদ্র ভদ্র হইল অথবা কয়জন অশিষ্ট শিষ্ট হইল? ভদ্রতা-শিষ্টতার কথা বাদ দিলেও স্বয়ং রামচন্দ্র রাবণ বধের পর মহামতি বিভীষণকে ক্রোধভাবিত দেখে বলেছিলেন “মরণান্তানি বৈরাণি”— সমস্ত বৈরিতার সমাপ্তি ঘটে গিয়েছে রাবণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, এখন সমস্ত বৈরিতা ভুলে সৎকার করো। এমন তো নয় যে, এই মন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কোনও সৎ ক্রিয়ার সূচনা হচ্ছে, যদিও আরও কোনও বৈরতার জায়গা থাকল না, আর কোনও ভাঙাভাঙি, মারামারি করতে হবে না, আর কোনও তর্কযুদ্ধ করতে হবে না, প্রত্নশেষ রামচন্দ্র স্থানে স্থিত হলেন বুদ্ধ, মোঘল এবং আধুনিক প্রগতিবাদিতার মাথায় বাম পদ স্থাপন করে?
তবু প্রশ্ন ওঠে, ইহার দ্বারা কীসের প্রতিপত্তি হইল, হিন্দু রাজ্যের? নাকি রাম রাজ্যের? নাকি আত্মকল্পিত এক অহংকারের প্রতিষ্ঠা? প্রথম কল্পে জানাই, রামচন্দ্র কিন্তু কোনও দিনই ‘হিন্দু’ ছিলেন না। তিনি অবশ্যই ভারতীয় ছিলেন। কেন না, ‘হিন্দু’ শব্দটি বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত এমনকী কোনও অর্বাচীন পুরাণেও পাওয়া যাবে না। প্রধানত বৈদেশিক জনগোষ্ঠী, যারা এই ভারতবর্ষের বুকে শাসন করে গেছে, তারা নিজেদের এবং আরও অন্যদের পৃথক করার জন্যই এদেশীয় মানুষদের ‘হিন্দু’ বলে সংজ্ঞায়িত করেছে।
‘হিন্দু’ শব্দটির মাধ্যমে পারস্য সম্রাট প্রথম দারায়ুস সিন্ধু নদীর এপারে-ওপারে থাকা সমস্ত ভৌগোলিক অঞ্চলটিকে পারসিক উচ্চারণে নামকরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই সংজ্ঞার মধ্যে বা হিন্দু-নামাঙ্কিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনকার ভারতবর্ষ ছিল না এবং দারায়ুসের এই সংকীর্ণ নামকরণ ভারতীয় প্রাচীনদের গাত্রস্পর্শও করেনি কোনও দিন। ‘হিন্দু’ নামের সমস্যা সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় ১২০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, যখন ৩০০ বছর ধরে ভারতের প্রাদেশিক রাজ্যগুলির মুসলমানদের রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলে এবং সেই দ্বন্দ্বে মুসলমান রাজশক্তি ভারতীয়দের উপর সেই দারায়ুসের শব্দটাই কিন্তু চাপিয়ে দেয় এবং বলে— এরা হিন্দু। ভারতবর্ষের প্রাদেশিক রাজারা— তাঁরা একত্বের সংস্কৃতিতে ভারতীয় হলেও নিজেদের কিন্তু প্রাদেশিক নামেই চিহ্নিত করতেন গর্বভরে। আমি রাজপুত, আমি গুর্জর, আমি দ্রাবিড়, এই ভাবে মাগধ, বঙ্গ, মহারাষ্ট্র— এখনও চলে। মুসলমানরা এই সমস্ত প্রাদেশিকদের এক করেছেন হিন্দুর নামেই এবং সেই মুসলমান-বিদ্বিষ্ট শব্দটাই আত্মসাৎ করে যাঁরা বিস্ময়মুকুলিত নেত্রে নিজেদের ‘হিন্দু’ ‘হিন্দু’ বলে এক অপভ্রষ্ট জাতীয়তাবাদের বিজ্ঞাপন রচনা করছেন, তাঁর আর যা কিছুই জানেন, কিন্তু আপন ইতিহাসটাই জানেন না।
ছবি: পিটিআই।
সম্ভবত ব্রিটিশ আমলে ১৮২০ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা ভারতীয়দের ‘হিন্দু’ নামে চিহ্নিত করতে থাকে মুসলমানদের বিপ্রতীপে এবং তা নিতান্তই প্রশাসনিক এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনে। হয়তো আরও আগে ‘হিন্দু’ কথাটা বৈদেশিক ব্রিটিশদের মৌখিক প্রচারের মধ্যে চলে এসেছিল বলেই রামমোহন রায়ের মতো প্রগতিশীল বিদ্বানও ‘হিন্দু’ নামটি ব্যবহার করেছেন ১৮১৫ এবং ১৮১৭ সালে। যদিও সেই ‘হিন্দু’ একটা জাতিবোধক শব্দ হলেও কোনও ভাবে তা জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের অর্থ পরিগ্রহ করে না, ঠিক যেমন তা করে না বিবেকানন্দের ব্যবহৃত ‘হিন্দু’-শব্দেও। কৌশলী রাজনৈতিক দুর্জনেরা মূলত মূর্খ অথচ অতিচালাক বলেই রামমোহন-বিবেকানন্দের প্রাসঙ্গিক শব্দশক্তি গ্রহণ না করে স্বকল্পিত হিন্দুত্বের স্বার্থসাধন করেন।
আরও পড়ুন: ‘ফাঁকা’ মাঠে তিনি এবং তিনিই
ঠিক এইখানেই রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ‘অন্তঃশাক্ত বহিঃশৈব’ আচরণটি প্রকট হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য পর্যায় থেকে যাঁরা হিন্দুত্ববাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের অভিসন্ধি মিশিয়ে কাজ করছিলেন, তাঁরা যতখানি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি লড়াই করেছেন অবচেতনে থাকা মুসলমান শাসন এবং তখনকার ভারতবর্ষে মুসলমানদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে। রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও কিন্তু ওই একই ভূত কাজ করেছে। এটা যতখানি অযোধ্যার রামলালার প্রতিষ্ঠা, তার চেয়েও অনেক বেশি এটা পুরাতন মসজিদের উপর হিন্দু মন্দিরের প্রতিষ্ঠা। ভাঙা দেউলের দেবতা এখানে কোর্টকাছারিতে মামলা করে মর্ত্য-ভক্তের কাছ থেকে রায় আদায় করেছেন এবং সেই ভক্তের প্রতি তাঁর কৃপা প্রচুর। একটা গণতান্ত্রিক আদালতের ধর্মাধ্যক্ষের মধ্যেও রামচন্দ্রের যে লীলাস্ফূর্তি ঘটেছিল, তার পূর্ণ পরিণতি ঘটেছে দেশের রাজার মাধ্যমে— তিনি এবার রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। সম্ভবত ২০২৪ সালের মধ্যেই।
ছবি: পিটিআই।
আমরা অবশ্য রাম নরচন্দ্রমাকে এমন মামলাবাজ এবং এত প্রখর এক পাটোয়ারি বুদ্ধিসম্পন্ন দেবতা হিসাবে চিনি না এবং তথাকথিত হিন্দুদের তিনি একমাত্র দেবতাও নন। উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশ ছাড়া কোথায় রামচন্দ্র? আর এই পোড়া বঙ্গদেশের কথা বলি— দেবতার ব্যাপারে বাংলা চিরকালই বড় হেনোথিইস্টিক-- ‘আমাদের ফুলের বনে যারেই দেখি, তারেই লাগে ভাল’। আমাদের এই বঙ্গদেশে প্রাচীন কালে বেদও ছিল না, ব্রাহ্মণও ছিল না। ফলে বাংলায় উত্তর ভারতের সংস্কৃতি এবং দেবতার প্রবেশ ঘটতে খানিক সময় লেগেছে; এমনকি, বঙ্গদেশে আর্যায়ণী প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ হয়ে গেলেও বৈদিক যাগযজ্ঞের পথটা খানিক পরিষ্কার হল বটে, কিন্তু রাম, কৃষ্ণ এমনকি শিবও আমাদের এই বঙ্গদেশে পদসংক্রমণ করেছেন অত্যন্ত ধীরে, সন্তর্পণে এবং অনেক দেরিতে। তবে যে যখন এসেছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের আচরণ ছিল রবীন্দ্রনাথের অতিবাদিনী ক্ষণিকার মতো- "থাকো হৃদয় পদ্মটিতে/ এক দেবতা আমার চিতে/ চাইনে তোমায় খবর দিতে/ আরও আছেন তিরিশ কোটি।"
আরও পড়ুন: মন্দির রাজনীতিতে কেবল বিজেপির একারই লাভ হয়নি
তাই বলছিলাম, ভারতবর্ষের প্রাচীন অবস্থানেও যে ফেডারাল স্ট্রাকচার ছিল, তাতেও কেন্দ্রীয় সরকারের মতো কোনও কেন্দ্রীয় দেবতা ভারতবর্ষে ছিল না; এ কথা যেমন বঙ্গদেশের সম্পর্কে সত্যি, তেমনি সত্যি দাক্ষিণাত্য এবং পশ্চিম ভারত সম্পর্কেও। সবার উপরে, ভারতবর্ষের প্রাচীনকালে তো কোনও ইম্পেরিয়াল ইউনিটি ছিল না যে এক জন কেন্দ্রীয় রাজা সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে এক জন কেন্দ্রীয় একক দেবতার ঘোষণা করবেন।
ছবি: পিটিআই।
সবচেয়ে বড় কথা, স্বয়ং রামরাজ্যের শাসক স্বয়ং রামচন্দ্রেরও এমন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনী প্রবৃত্তি ছিল না যে, তিনি রাজা হয়েই সব রাজ্যগুলি দখল করে সেখানে নিজের মূর্তি স্থাপন করবেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন, রাবণ বধ করে রামচন্দ্র সীতা উদ্ধার করেছেন বটে, কিন্তু সোনার লঙ্কায় তিনি নিজের অধিকার কায়েম করেননি। তিনি রাজ্য দিয়েছেন রাক্ষস বিভীষণকে এবং রাক্ষস সভ্যতাকে তিনি রাক্ষসদের মতোই চলতে দিয়েছেন, তিনি সেখানে রামের কোনও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে আসেননি। একই কথা, সুগ্রীবের কপিরাজ্য সম্পর্কেও। বালি বধ করে রামচন্দ্র সুগ্রীবকে শাসন করতে দিয়েছেন বানর রাজ্যে। সেখানেও তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেননি। আর লঙ্কা থেকে ফিরে এসে সেই যে তিনি অযোধ্যায় রাজা হয়ে বসলেন, তার পর ভারতবর্ষের কোন প্রদেশে তিনি গেছেন আপন অযোধ্যার সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওযার জন্য! অথবা কাশী, কাঞ্চী, অবন্তী অথবা অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ কোন রাজ্যে আপন দেবায়ন ঘটিয়ে রামচন্দ্র যুক্তি-তর্ক-মহত্ত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন? কোথাও নয়।
রামচন্দ্র স্বয়ং যেখানে ভারতবর্ষের প্রতিটি রাষ্ট্রের (তৎকালীন ভারতে কাশী-কাঞ্চী-অবন্তী ‘রাষ্ট্র’-ই ছিল) স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাস করতেন, সেখানে কেন আজ এই ঘোষণা শুনছি যে, এই রামজন্মভূমি পূজনের দিনটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে তুলনীয় এবং এখন থেকে রামরাজ্যের আদর্শ অনুসারেই ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র চলবে। আসল কথাটা তো আপনারা বলতে পারছেন না। বলতে তো পারছেন না যে, সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের অতিপ্রিয় যে রাম-অবতারের কথা, যা বাল্মীকি রামায়ণের সূত্রে আমাদের মনে আজ প্রতিষ্ঠিত, সেই রামচন্দ্রকে শিখণ্ডী খাড়া করে আপনারা যে একটা অখণ্ড হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, সেখানে আপনারা শুধুমাত্র রামচন্দ্রকে অপ্রিয় করে তুলতে চাইছেন, তাই শুধু নয়, ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্কারে সেই বিখ্যাত তর্কও কিন্তু এ বার উঠবে যে, ‘হোয়াই আই অ্যাম নট আ হিন্দু’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy