লাঠি তুলে তেড়ে এলেন বৃদ্ধ। এত রাগের কারণ সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশ। যে নির্দেশে জঙ্গলের জমিতে বসবাসকারী মানুষদের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে অন্যত্র সরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্দেশ দিলেই তো হবে না। কী ভাবে এত সংখ্যক মানুষকে (গোটা দেশে বনবাসীদের সংখ্যা প্রায় ৮ লক্ষ) জঙ্গল থেকে সরানো যায় তা নিয়ে দারুণ সমস্যায় পড়েছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলি।
বৃদ্ধ জগদীশ যাদবের গ্রাম বড়িয়া পূর্ব মধ্যপ্রদেশের সঞ্জয় ডুবরি জাতীয় উদ্যানের কোর এলাকার মধ্যে। গ্রাম থেকে শোনা যায় বাঘের গর্জন। যখন-তখন গবাদি পশু তুলে নিয়ে যায় বাঘে। বাড়ির চাতালে শুয়ে থাকলে রাত দুপুরে গন্ধ শুঁকে চলে যায় ভালুক। প্রসঙ্গত, বনবাসী বেইগা-রা জনজাতীয়দের মধ্যেও অতি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের।
বাপ-ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে কেন তাঁদের চলে যেতে হবে, সেই প্রশ্ন তুলে লাঠি নিয়ে তেড়ে এসেছেন বৃদ্ধ জগদীশ, ‘‘আমরা একে অপরের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বেঁচে আছি। বেইগা কখনও বাঘ মেরেছে, কিংবা বাঘে কোনও বেইগা মেরেছে কি?’’ জঙ্গলের সঙ্গে বেইগাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বন বিভাগের জানা। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ বন দফতরের এক কর্তার মন্তব্য, শুধু সঞ্জয় ডুবরি জাতীয় উদ্যানের কোর এলাকার মধ্যেই রয়েছে ৪২টি গ্রাম, ১০ হাজার মানুষ সেখানকার বাসিন্দা। জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা আগে এত ছিল না। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাঘের খাবার হরিণ, নীলগাই, বন্য শুয়োর, বাঁদর, হনুমানেরা। কাজেই মানুষের সঙ্গে বন্য জন্তুর সংঘাত এখানে অনিবার্য। তাই এই মানুষদের সরাতেই হবে।
সরাতে হবে বললেই তো হবে না। বনবাসীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বন দফতর বেশ কয়েকটি অরণ্যপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার শরণাপন্ন হয়েছে। তাদের কাছে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন গ্রামের মানুষরা। প্রবীণ মানুষ মহি বললেন, ‘‘সরকার তো আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আগে যাঁরা উঠে গিয়েছে, তাঁরা এখন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’ কেন? ‘‘আমাদের গরিব মানুষগুলির হাতে কাঁচা টাকা দিয়ে দিলে যা হয় তা-ই হয়েছে। পরিবারপ্রতি কেউ ৩০ লক্ষ, কেউ ২০ লক্ষ টাকা পেয়ে আগেই কিনে নিয়েছে বাইক। ওই টাকায় জমি পাবে কোথায়? চাষের জমি গিয়েছে। থাকার ঘর গিয়েছে। গিয়েছে পেটের ভাতও।’’ তরুণরা হইহই করে উঠল, ‘‘আপনারা সরকারের কাছ থেকে টাকা খেয়ে আমাদের প্রলোভন দেখাচ্ছেন। দয়া করে চলে যান।’’ ভেঙে গেল সভা। রামকুমারের ছেলে দীপক সকলকে আগলে আগলে গ্রাম থেকে বার করলেন। ঠান্ডা মাথার দীপক বললেন, ‘‘আমরা টাকা চাই না। পুনর্বাসন চাই। এমন পুনর্বাসন যাতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারি।’’ বন দফতর বা স্থানীয় প্রশাসন যে ওই গ্রামে এখনও পর্যন্ত তাঁদের কাছে যায়নি, তা জানা গেল ওঁদের কাছেই। সরাসরি আলোচনা নাকি এই প্রথম— যেখানে নেই প্রশাসনের কেউই।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যপ্রতি ১০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। কিন্তু কেন সত্যবানের ছেলেরা তাঁদের সেই প্রাপ্য টাকাটা পেলেন না? এত দিনেও তা বোঝানোর চেষ্টা করেনি প্রশাসনের কেউ। ফলে রামজীবন বেইগারা প্রশাসনকে আর বিশ্বাস করেন না। কিন্তু কেন বন দফতরের কর্তারা বনবাসীদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলেননি? কেনই বা তাঁদের সঙ্গে কোনও সমন্বয় নেই প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের?
বন দফতরের এক কর্তা বললেন যে সুপ্রিম কোর্টের রায়েও কিন্তু সামঞ্জস্যের অভাব রয়েছে। যেমন, গত এক দশকে সব কিছুর দাম বেড়েছে, এ দিকে যে মানুষগুলি সর্বস্ব ছেড়ে চলে আসছেন তাঁদের ক্ষতিপূরণের অঙ্ক একই থেকেছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে কোনও হলফনামা দেয়নি, তেমনই বিচারপতিরাও বিষয়টিতে নজর দেননি। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও সকলে পুনর্বাসন পেলেন কি না, সেটা মোটেই দেখেনি প্রশাসন। তাই উচ্ছেদ হওয়া ওই সব মানুষ তো নিজেদের প্রতারিত বলে মনে করবেনই।
জানা গেল, ৪২টি পরিবার হাইকোর্টে প্রতারণার মামলা করেছে।
ইতিমধ্যে তাঁদের এই বিড়ম্বনার কথা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অন্য জঙ্গলের বাসিন্দাদের কাছেও। প্রশাসনের উপরে, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের উপরেও ভরসা রাখতে পারছেন না তাঁরা। বৃদ্ধ জগদীশ বেইগার কথা মনে পড়ল। ‘‘উপর থেকে বোমা ফেলে আমাদের সবাইকে বরং মেরে ফেলুক সরকার। এ ছাড়া সামাধানের কোনও উপায় দেখছি না।’’
সঞ্জয় ডুবরি জাতীয় উদ্যানের রেঞ্জার বীরভদ্র সিংহ পারিহার মানলেন সমস্যার কথা। ‘‘প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের মধ্যে বিরাট সমন্বয়ের অভাব— আমরা গ্রামের মানুষকে উঠে যেতে বলছি, অন্য দফতর সেখানে রাস্তা করে দিচ্ছে, বিদ্যুৎ দফতর নতুন করে বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে, জলের সংযোগ করে দিচ্ছে কোনও দফতর, কেউ স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে শৌচাগার করে দিচ্ছে।’’ অসহায় লাগে রেঞ্জারকে।
বন দফতর এবং বনবাসী দুই পক্ষই চাইছে এই সমস্যাগুলি সুপ্রিম কোর্টের কাছে নিয়ে যেতে। সেই কাজটা করবে কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy