বিজয়ী: লন্ডনের রাজপথে লরিতে, ৮ মে, ১৯৪৫। ছবি: গেটি ইমেজেস
ধরা যাক, এমন একটা জায়গায় গিয়ে পড়েছি আমরা, যেখানে দাঁড়িয়ে কোনও দিকে কোনও আস্ত বাড়ি দেখা যায় না, স্তূপাকার আবর্জনা ছাড়া কোনও রাস্তা দেখা যায় না, স্কুল কলেজ সবই ভাঙাচোরা জ্বলাপোড়া, সেখানে কোনও পড়াশোনা হয় না, খবরের কাগজ বেরোয় না, কোথায় কী হচ্ছে খবর পাওয়া যায় না, ব্যাঙ্ক খোলে না। টাকা জিনিসটারই যেখানে কোনও হদিশ নেই, কারও ঘরে খাবার নেই, ঘরের মতো ঘরই নেই, দোকান নেই, দোকান থাকলেও জিনিস নেই, খাবারদাবার নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছুরই খোঁজ নেই, পুলিশ বা আইনবিচার নেই, যে যা খুশি করতে পারে— লুঠতরাজ দাঙ্গাহাঙ্গামা নির্যাতনধর্ষণ! পুরুষদের একমাত্র কাজ যেখানে দিনরাত কাজ খোঁজা কিংবা অপরাধ ঘটানো, বাচ্চাদের একমাত্র কাজ চুরি করা বা ভিক্ষা করা, আর মেয়েদের একমাত্র কাজ দেহব্যবসায় নামা— সবই কেবল রোজ দু’মুঠো খেতে পাওয়ার আশায়!
কল্পনা নয়। বাস্তব। অনেক আগেকার বাস্তবও নয়। মাত্র পঁচাত্তর বছর আগে। অজানা অচেনা জায়গা নয়, সাক্ষাৎ ইউরোপে, সভ্যতার মহাপীঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে, ১৯৪৫ সালে হিটলারের গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসার পর-পর ইউরোপের দশা ছিল এমনই। কিথ লো-র স্যাভেজ কন্টিনেন্ট বইয়ে এই বর্ণনা পাই আমরা। লো বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আমরা এত আবেগ-অভিভূত থাকি যে কেবল শুনি, কী অপূর্ব জয় সে দিন, কী অসম্ভব মুক্তি। কিন্তু শুনতে পাই না যুদ্ধকালীন ভয়ঙ্করতার বিবরণ। ইচ্ছায় না হোক অনিচ্ছায়, কেউ আর মনে করাতে চায় না, কী কাণ্ডই ঘটছিল সে-দিনকার ইউরোপীয় মেনল্যান্ডে, প্রথমে নাৎসি-নির্যাতিত ও পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের নগর-শহর-শহরতলি-গ্রামে। কেমন ছারখার হয়ে গিয়েছিল ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, চেক, হাঙ্গারি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, দেশের পর দেশ।
আজ করোনা-আক্রান্ত পৃথিবীতে বসে আমরা অনেকেই বলছি— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় মাপের বিশ্ব-সঙ্কট আর আসেনি। ঠিক কথা, এক দিক দিয়ে। যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ আগেও হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে ভাবে বিশ্বকে গ্রাস করেছিল, তেমন কখনওই ঘটেনি এই গ্রহের ইতিহাসে। কিন্তু অন্য দিক দিয়ে এ কথা বলার বিপদও আছে একটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে মাপের সঙ্কট, সেটাকে ভুলে যাওয়া বা হালকা করে দেখার বিপদ। যাঁরা সেই সময়টাকে দেখেছেন তাঁরা অধিকাংশই আজ আর নেই বলেই বোধহয় সময়টাও বিস্মরণের স্রোতে হারিয়ে যেতে বসে।
আরও পড়ুন: ট্রেনে পিষে এই মর্মান্তিক মৃত্যু কেন্দ্রের চরম অবজ্ঞারই ফল
ওই বিপজ্জনক বিস্মরণ থেকে বেরিয়ে আসার সময় এখন, কোন ধ্বংসে আর আমরা ফিরে যেতে পারি না সেটা বোঝার সময়। পঁচাত্তর বছর আগে, ১৯৪৫-এর মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই তো যুদ্ধের সমাপন ঘনিয়েছিল, ব্রিটিশ ও মার্কিন বাহিনীর হাতে মুক্তি পেতে শুরু করেছিল ইউরোপ। এর পর আরও কয়েক মাস অনেক ক্ষয়ক্ষতি ঘটবে, তবু ৮ মে ভিক্টরি-ডে (ভি-ডে) ঐতিহাসিক— এর আগে ব্রিটিশ বা মার্কিন নেতারা ভাবতেও পারেননি যে এই যুদ্ধ সত্যিই তাঁরা জিততে চলেছেন।
সাক্ষাৎ ধ্বংস থেকে বেঁচে গিয়েছিল বলেই ১৯৪৫ বছরটিকে ‘ইয়ার জ়িরো’ বলা হয় অনেক সময়। যুদ্ধের আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ কোটি। যুদ্ধে প্রায় ৮ কোটির মৃত্যু হয়েছিল (যার মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি সোভিয়েট সেনা)। ‘জেনোসাইড’ কথাটা ব্যাপক ভাবে শোনা গেল এই সময়ই। শোনা গেল ‘ডিপি’ বলে নতুন একটি শব্দও— ‘ডিসপ্লেসড পার্সন’। কত লাখ বা কোটি মানুষ যে এই ডিপি-র গোত্রে পড়ল, হিসেব নেই। যেটুকু হিসেব মেলে, তাতে যুদ্ধের পর নতুন চেক রাষ্ট্র থেকে এক কথায় ৩০ লাখ জার্মানকে বার করে দেওয়া হয়েছিল, পোল্যান্ড থেকে ১৫ লাখকে। হারিয়ে যাওয়া, কিংবা অনাথ হয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যাও মিলিয়নের (১০ লাখ) হিসেবেই গোনা হয়েছিল। কত সংখ্যক মহিলা ধর্ষিত হয়েছিলেন, কোনও সংখ্যা মেলে না, তবে এক জার্মানিতেই ১৯৪৫-৪৮ সালের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মহিলার গর্ভপাত করানো হয়েছিল বলে জানা যায়।
সংখ্যাই বলে দেয়, এই যুদ্ধ কতখানি আলাদা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয় ‘টোটাল ওয়র’, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ? ‘মাস ওয়র’, যেখানে আক্ষরিক ভাবে সাধারণ নাগরিকরাও যুদ্ধের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। এত বিপুল পরিমাণ ‘সিভিল ক্যাজুয়ালটি’, অর্থাৎ অসামরিক মানুষের মৃত্যু— বিশ্বে আর কখনও আর কোনও যুদ্ধে ঘটেনি। ইউরোপে, এমনকি এশিয়াতেও, প্রত্যেকটি মানুষ কোনও না কোনও ভাবে, প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে, লড়াই করছে তখন। অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষই ভূমিকা নিয়েছে ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন দেখতে হবে, সেটা স্থির করার কাজে।
কাজটা ছিল অস্বাভাবিক রকমের শক্ত। কিথ লো বলেছেন, বিজয়ী মিত্রশক্তি যখন ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ঢুকছিল, ‘শক’ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল তারা। ভেবেছিল লন্ডন বা ম্যাঞ্চেস্টারের যে চেহারা হয়েছিল জার্মান বোমায়, ইউরোপও হয়তো তেমন হবে। কিন্তু না— যা দেখেছিল তারা, তার তুল্য নরক তারা আগেও দেখেনি, পরেও দেখবে না। উদ্বাস্তুদের থাকার জায়গা নেই। ক্ষুধা-পীড়ায় মৃতবৎ-এর জন্য খাবার-ওষুধ নেই। ১৯৪৫ সালের মে থেকেই মিত্রশক্তি চেষ্টা শুরু করল, ইউরোপের মেরামতি শুরু করার। কিন্তু ধ্বংসের ‘স্কেল’টা যে রকম, তাতে ইচ্ছে থাকলেও তাড়াতাড়ি কিছু করার জো ছিল না। প্রায় সমস্ত বন্দর ভেঙে চুরমার, রাস্তায় রাস্তায় খন্দ, সেতুর পর সেতু ভাঙা, রেললাইন উপড়োনো, রেলগাড়ি ভেঙে লোহার স্তূপ। মানুষের জন্য খাবার বা অন্য ত্রাণসামগ্রী পৌঁছনোরও তো একটা পথ চাই, কোথায় তা? মানুষই পারে গড়তে, মানুষই তো পারে সভ্যতাকে ‘ধ্বংসের মুখোমুখি’ আনতে। ১৯১৮ সালে যে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল, আর ১৯৪৫ সালে যার সমাপন ঘটেছিল, তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান পার্থক্য এইখানেই— মানুষের ধ্বংসক্ষমতার পরিমাণ মাঝের দুই-আড়াই দশকে এত ভয়ঙ্কর রকম বেড়ে গিয়েছিল, এতটাই যে— পৃথিবী বুঝে ফেলেছিল, আর একটিও এমন ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে ঘনিয়ে আসবে শেষের সে দিন। তার পরে গ্রহ জুড়ে ছাই পড়ে থাকবে শুধু।
আরও পড়ুন: হিত-অহিত
শুধু সংখ্যা আর বিপর্যয়ের ধরনে নয়, এই যুদ্ধের আরও একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। এই এক যু্দ্ধ, যার দুই দিকে ছিল এমন দুই সম্পূর্ণ বিপরীত বিশ্ববীক্ষা, যাদের একত্র অস্তিত্ব এক দিনও আর সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ এক পক্ষ পরাজিত হওয়াও যথেষ্ট নয়, কোনও এক দিক একেবারে গুঁড়িয়ে গেলে তবেই অন্য পক্ষ টিকবে, এমনই ভাবা হয়েছিল। ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম এজ অব এক্সট্রিমস বইয়ে বলছেন, অন্যান্য যুদ্ধের মতো এখানেও প্রত্যক্ষ ছিল ক্ষমতার লড়াই. কিন্তু ভেতরের অপ্রত্যক্ষ লড়াইটা ছিল আরও অনেক বড়, গভীর। এক দিকে মানুষের অধিকারের প্রশ্ন, অন্য দিকে মানুষকে অধিকারহীন করার বন্দোবস্ত। সাধারণ জয়পরাজয় দিয়ে এ মীমাংসা হওয়ার নয়, কে কাকে ‘শেষ’ করতে পারবে, এটাই কথা। তাই, ১৯১৯-এ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ভার্সাই চুক্তির সময়ে যেমন পরাজিত জার্মানিকে ডেকে আনা হয়েছিল, ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে পটসডাম কনফারেন্স-এ কিন্তু জার্মানি বা জাপান কাউকেই ডাকা হল না। পরাজিত পক্ষের রাজনৈতিক অস্তিত্বই স্বীকৃত হল না— হবসবমের ভাষায়, ‘‘নো ফর্মাল পিস ওয়াজ় মেড, সিন্স নো অথরিটিজ় ইনডিপেন্ডেন্ট অব দি অকুপাইং ফোর্সেস ওয়্যার রেকগনাইজ়ড’’। কেবল ধ্বংস আর সঙ্কটের আবছায়ায় আধ-বাঁচা হয়ে ঘুরতে থাকল একটা সংশয়। ‘শেষ’ মানে কি সত্যিই ‘নিঃশেষ’?
আর ওই আবছায়াতেই যেন লগ্ন হয়ে রইল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অনন্যতা। কত যুদ্ধেরই কত রকম কারণ থাকে, কিন্তু সে দিনের বিশাল বিপুল ভয়াল ধ্বংস নেমে এসেছিল কেবল এক জন মানুষের জন্য। অনেক ব্যাখ্যা, অনেক আলোচনার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই সহজ সত্যিটা হারিয়ে যেতে বসে। ব্যক্তি যে ইতিহাসে কত গুরুতর, শুধু এক জন মানুষের বিকৃত মানসিকতা, আগ্রাসন ও বিদ্বেষ দিয়ে যে গোটা মানবসভ্যতাকেই শেষ করে দিতে বসা যায়, অ্যাডলফ হিটলার তার চিরকালীন প্রমাণ হয়ে রইলেন।
ভুললে চলে না আরও একটি সত্য। উল্টো দিকেও রয়ে গেল ব্যক্তির অপ্রতিরোধ্য ভূমিকা। কোনও এক জন নয়— অনেক ব্যক্তির সমাহারে তৈরি সমষ্টি দেখিয়ে দিল, কী ভাবে সভ্যতাকে অবধারিত ধ্বংস থেকে রক্ষা করা যায়। অবিশ্বাস্য কঠিন আর প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সে দিন তাঁরা জীবন বাজি রেখে লড়ে গেলেন, অসাধ্য সাধন করলেন। কেবল নেতারা নন, ‘মাস ওয়র’-এর ‘মাস’কেও সে দিন উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল। মানুষই মানুষকে বাঁচিয়ে দিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জয়ী সেনাপতি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের কথাটিতে তাই অতিরঞ্জন ছিল না কোনও। ১৯৪৫ সালের মে মাসের ওই জয়মুহূর্ত সত্যিই ‘দ্য ফাইনেস্ট আওয়ার’। কেবল তাঁর দেশের জন্য নয়, সমস্ত বিশ্বের জন্য।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy