প্রতীকী চিত্র।
কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বামফ্রন্টের প্রয়োজনীয়তা বুঝাইতে রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী, প্রয়াত রাম চট্টোপাধ্যায় প্রায়শই একটি গল্পের অবতারণা করিতেন। সেই কাহিনির মূল প্রতিপাদ্য— বড় বিপদের মোকাবিলায় ছোটখাটো ভেদ-বিচার ভুলিয়া থাকিতে হয়। যেমন, কোনও সংসারে ভ্রাতাদের মধ্যে মনোমালিন্য হইতে পারে। যৌথ পাকশালা পৃথক হওয়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু বাড়ির উঠানে যদি বিষধর সর্প আসিয়া ফণা তোলে, তখন বিবাদ তুচ্ছ করিয়া সবাই একত্রে লাঠি হাতে ছুটিয়া আসে। কারণ সর্প-সংহার সেই মুহূর্তে মূল লক্ষ্য। অন্যথায় সকলের ক্ষতি। গল্পটি এক্ষণে প্রাসঙ্গিক। রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐক্যের ডাক সম্প্রতি পত্রপাঠ নাকচ করিয়াছে সিপিএম এবং কংগ্রেস। বিধানসভায় সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সর্বদলীয় প্রস্তাব উত্থাপনের একটি উদ্যোগ চলিতেছিল। মুখ্য ভূমিকা শাসক তৃণমূলের। মূল বিষয়ে আপত্তি না থাকিলেও তৃণমূলের তৈয়ারি করা প্রস্তাবে নারাজ হইয়া বেসুর গাহিয়াছেন বাম ও কংগ্রেস নেতারা। বঙ্গদেশে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে রাজনীতিতে ও সমাজ-জীবনে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির বিবিধ প্রকাশ সম্পর্কহীন নয়। প্রস্তাব তাহারই বিরুদ্ধে। ফলে আক্ষরিক অর্থে ইহা ‘সর্বদলীয়’ বলা অসঙ্গত। কিন্তু বাম ও কংগ্রেসের দাবি, ওই প্রস্তাবে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ বৃদ্ধির জন্য তৃণমূলের সরকারের দায়ও উল্লেখ করিতে হইবে। নচেৎ তাহাতে সম্মতি দেওয়া যাইবে না। তাই একই লক্ষ্য সাধনের জন্য দুইটি পৃথক প্রস্তাব জমা পড়িল। একটি শাসক তৃণমূলের, অন্যটি দুই বিরোধী পক্ষ বাম ও কংগ্রেসের। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে প্রস্তাবের উপরেই আলোচনা চলুক, তাহাকে বিজেপি-বিরোধীদের সর্বদলীয় প্রস্তাবও বলা যাইবে না। অর্থাৎ বাড়ির উঠানে সর্প দেখিলেও তাহাকে নিধনের সম্মিলিত প্রয়াসে ঘাটতি থাকিয়া গেল।
রাজনীতির গতিপথ সর্বদা সর্পিল। সোজা ভাবনায় রাজনীতিকেরা বড় একটা চলেন না। সাদা এবং কালোর মধ্যবর্তী ধূসর রং তাঁহাদের দৃষ্টিকে বহু ক্ষেত্রেই আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। লাভালাভের নিজস্ব অঙ্কে তাঁহারা মগ্ন থাকেন। এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক প্রবণতা বাড়িয়া ওঠার পিছনেও এমন যুক্তি খাড়া করা যায়। পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণ এখন যে অবয়ব লইয়া প্রতিভাত হইতেছে, তাহা অভূতপূর্ব। প্রধানত উত্তর ভারতে যে ধরনের ধর্মীয় কর্মসূচি রাজনীতির মূল স্রোতের সহিত কার্যত অভিন্ন বলিয়া স্বীকৃত, এই রাজ্যে গত কয়েক বছর তিল তিল করিয়া তাহার পুষ্টি ঘটিয়াছে। এখন কলেবর অনেকটাই স্ফীত। বিজেপি ভগীরথের ন্যায় সেই স্রোতকে এখানে পথ দেখাইয়া আনিয়াছে। সেই স্রোতে গা ভাসাইতে তৃণমূল কংগ্রেসও কম যায় নাই। প্রতিযোগিতামূলক ধর্মীয় রাজনীতির ফলে রাজ্যে ইদানীং রামনবমী পালনের ঘটা বাড়িয়াছে। ইদ, মহরমের মতো পরবগুলি লইয়া টানাপড়েন চলিতেছে।
তবু শুভবুদ্ধি যখনই জাগ্রত হউক, তাহাকে স্বাগত জানানো ছাড়া উপায় নাই। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের ফল দেখিয়া যদি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে সরব হইতে চাহেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিজের যোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করিতে উদ্যোগী হন, তাহাকে সাধুবাদ জানানো আবশ্যক। মূল প্রশ্নে যখন বিরোধ নাই, তখন দায় খুঁজিবার ময়না-তদন্তে দৃষ্টি ঘুরাইবার পরিবর্তে একটি সম্মিলিত প্রস্তাবের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং রাজনৈতিক ভাবে তাহাকে কাজে লাগানো অধিকতর অর্থবহ পদক্ষেপ হইতে পারিত। বার্তাটিও জোরালো হইত। সমালোচনার বাকি অংশটুকু না-হয় লিপিবদ্ধ থাকিত বিধানসভার বক্তৃতার নথিতে। কিন্তু ক্রমক্ষীয়মাণ সিপিএম ও কংগ্রেস তাহা বুঝিল না। এই অনৈক্যের দাম হয়তো দিতে হইবে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy