Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মুখোশের আড়ালে শিশু নির্যাতন চলছেই

বহরমপুরের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সাহস দেখাল। চাইল্ড লাইনে ফোন করে জানিয়ে দিল তার উপর হওয়া নির্যাতনের কথা। অভিযুক্তেরাও ধরা পড়ল। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামএ বারে প্রশ্ন, সাজাই কি শেষ কথা? এই ঘটনা আদি অনন্তকাল ধরে চলে আসছে।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৯ ০২:২৪
Share: Save:

শারীরিক নিগ্রহের নির্দিষ্ট কোনও ধরন হয় না। সবসময় তা বয়ানযোগ্যও নয়। তাই গোপনে অপরাধী শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে। কখনও আস্তিনের বিষধর সাপ নির্বিষ চেহারায় পরিবারের বুকেই আশ্রয় নেয়। শ্বাস নেয় সম্পর্কের আড়ালে। দংশন না করা পর্যন্ত বিশ্বাসের ঘরেই বেসাতি তার। মুখোশের আড়ালে তাই নির্যাতন চলছেই। শুধু বদলে যাচ্ছে দেশ আর সময়। ৫৬ বছরের জুলখা আহমেদ যখন ব্রিটেনে বসে নিজের শারীরিক হেনস্থার কথা বলছেন তখন হাজার হাজার মাইল দূরে এক ষষ্ঠ শ্রেণির ছোট্ট মেয়ে খুঁজে ফিরছে বেঁচে থাকার নিরাপদ আশ্রয়।

রোতেরহ্যামের এক চ্যারিটির ফাউন্ডার মিসেস জুলখা আহমেদ। ব্ল্যাক এশিয়ান অ্যান্ড মাইনরিটি এথেনিক গ্রুপের মহিলা-শিশুদের হয়ে কাজ করেন। নির্যাতনের শিকার শৈশবে। কিন্তু মুখ খুলতে পেরিয়ে গেল পঞ্চাশটা বছর। ঠিক এই সময়ে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সাহস দেখাল। চাইল্ড লাইনে (১০৯৮ নম্বর) ফোন করে জানিয়ে দিল তার উপর হওয়া নির্যাতনের কথা। মা ও মায়ের বন্ধুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অনর্গল উগড়ে দিল এক বছরের ক্ষোভ। অভিযুক্তেরা ধরা পড়ল। ছোট্ট মেয়েটা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে সঁপে দিল জীবন। ঠাঁই হল সরকারি হোমে। কিন্তু সহন নয়, প্রতিবাদকেই বেছে নিল সে।

এ বারে প্রশ্ন, সাজাই কি শেষ কথা? এই ঘটনা আদি অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। সভ্যতার সড়কের আধুনিকতার বাঁকে দাঁড়িয়ে কি মানুষ সয়ে নেবে এমন অপরাধের বোঝা? সাময়িক ক্ষোভে ফেটে পড়বে? এবং তার পরে বিষয়টি গোপন করবে? নাকি কালের নিয়মে ঘটনা শোনার পরে ভুলে যাবে? এই বিস্মৃতির তুমুল স্রোতের দুই কিনারায় দাঁড়িয়ে ‘হুঁশ’ ফেরার অপেক্ষায় না থেকে অপরাধের উৎস সন্ধান ও নতুন দিশা খোঁজার সময় এসেছে। অপরাধী কখনও কারও কাকা-মামা-ভাই নয়। সে অপরাধী। তাই অপরাধকে ঘৃণা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। সম্পর্ক তার আলাদা মর্যাদায় আসীন। হয় তা থাকে, নয় থাকে না। তাই গেল গেল রব পরিবার ও সম্পর্কে বেমানান। চিহ্নিত অপরাধীর শাস্তির প্রয়োজন। তার জন্য যতটা রূঢ় হওয়া দরকার, ঠিক ততটা রূঢ় হওয়াই জরুরি।

লাল ফিতে বাঁধা চুলে খুদে মেয়েগুলো চোখ মেললেই দেখে ফুটে থাকা সূর্যমুখী। চারদিকে ঠিকরে পড়ছে হলুদ। প্রজাপতির ডানায় রংবেরঙের মেলা। চুপ পায়ে ঘাসের উপর ফড়িংয়ের বসে থাকা দেখা। পথের রঙিন পোস্টারের নীচে অবাক দাঁড়িয়ে পড়া। বাড়ি থেকে বিদ্যালয়— অপার স্বপ্নের জাল। মনে বিপুল উৎসাহ। পিঠে এক ব্যাগ রোদ নিয়ে প্রতিদিন ছুট। শিশুমন তখনও জানে না আসলে ও একটা মেয়ে। ফুল, প্রজাপতি, ফড়িংয়ের বাইরে ওর জন্য এই পৃথিবীতে আছে পাঁচ মাথার রাক্ষস। তাই ওর দেহের জন্য জরুরি অনেক সতর্কতা। মনের মধ্যে জরুরি অন্য সন্দেহ। হাতে থাকা উচিত বিষ মাখানো কয়েকটা তির। আর না থাকলে এই অবুঝগুলো শাস্তি পায় পাষণ্ডের হাতে! তাকে আচড়ে, ছিঁড়ে কুটিপাটি করে ক্ষান্ত হয় না রাক্ষস! এই দানবীয় অত্যাচার চালিয়ে যাওয়ার জন্য সে সব সুড়ঙ্গ বন্ধ করতে থাকে। ছোট্ট মনে ঢুকিয়ে দেয় নানা চক্রান্তের জাল। জেরবার করে দেয় তার বিশ্বাস ও স্বপ্নের দিশা। লেখাপড়া, পুতুল আর খেলনাবাটি নিয়ে ব্যস্ত থাকা ছোট্ট মেয়েটি হঠাৎ করে কী যেন শিখে যায়! সে আর পুতুলদের স্নান করায় না। খেলনা ছুড়ে ফেলে। শুধু বালিশে মুখ লুকোয়। ওর মনের খবর কেউ নিতে পারে না।

প্রতি তিন জনে এক জন কন্যাশিশু হিংস্রতা ও অসভ্যতার শিকার। হিসেবের খাতায় নানা স্বর। এ নিয়ে গোপনীয়তার কোন জায়গা নেই। এখন বাচ্চারা সচেতন হচ্ছে। শরীরের উপর নেমে আসা নানা ধরনের নির্যাতনের প্রতিকারে তারা তৎপর। শুধু পারিবারিক সম্মানের ভয় দেখিয়ে তাদের চুপ করানো কঠিন। জুলখা আহমেদকে যেমন বলা হয়েছিল— ‘এ সব বলে দিলে কেউ তোমাকে আর ভালবাসবে না।’ তাই চুপ

থাকার সিদ্ধান্ত। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী তার পরিবারের বিরুদ্ধে আনে অন্য অভিযোগ। অসহযোগিতা ও উপেক্ষার। অভিযোগ, বিষয়টি জানার পরেও পরিবার উদাসীন ছিল। কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টে তার মা তাকে বকাবকি করে বলে অভিযোগ।

আসলে সুরক্ষা খুব জরুরি। নিরাপত্তার ভাবনায় আপন-পরের কোনও মানদণ্ড নেই। মেয়ে আত্মীয়-স্বজন-পরিচিতদের কাছে সুরক্ষিত, এমন ভাবনা পোষণের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সতর্ক থাকা। ‘সাবধানের মার নেই’— এই নীতি প্রযোজ্য। যখন ধর্ষকের দিগন্ত দত্তক বাবা থেকে কাকাশ্বশুর পর্যন্ত তখন সেখানে শামিয়ানার কোনও আড়াল নেই। সবটাই খোলা আকাশের নীচে নির্লজ্জের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।

ব্যক্তিস্বাধীনতা মানুষের একান্ত নিজস্ব অধিকার। বাইরে থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় পরিবারে অস্বাভাবিক কিছু চলছে। কিন্তু প্রতিবাদের কোনও জায়গা থাকে না। বলার আগে ভাবতে হয়, অনধিকার চর্চার জন্য বুঝি অপমানিত হতে হবে। ছোট্ট মেয়ে প্রতিবেশী কারও কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা ভাবেনি। সরাসরি নিজের অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ করেছে। সিলেবাসে এমন কিছু নম্বরের অন্তর্ভুক্তি খুব জরুরি। সিএসএ বা চাইল্ড সেক্স অ্যাবিউস একটি শিশুর স্নায়ু ও জৈবিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। সম্পর্কের টানাপড়েন এনে দেয়। জীবন জুড়ে নানা মানসিক-সামাজিক ও শারীরিক সমস্যার সঙ্গে তাদের মোকাবিলা করতে হয়। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, ৯৩ শতাংশ অপরাধী শিশুর পরিচিত। মাত্র সাত সতাংশ অপরিচিত। বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলা তো দূরের কথা, সেই শিশুই আজ বিপন্ন। সভ্যতার কাছে এর থেকে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে!

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

অন্য বিষয়গুলি:

Child Abuse Sexual Harassment Child Sex Abuse
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE