তেজি ঘোড়ার রথে সোনার সূর্য আমাদের প্রাণের উৎসেচক হলেও কোথায় যেন পরপুরুষের গন্ধ লেগে থাকে। আসলে, সূর্যকে তো কখনও দেবতা ভাবিনি। বরং মহাভারতের কুন্তীর দুর্দশার জন্য, কর্ণের বিপর্যয়ের জন্য তাঁকে দায়ী করেছি। আজও যখন খরতাপ দুর্বিষহ হয়ে পড়ে প্রখর গ্রীষ্মে, তখনও যেন কুন্তীর কল্পিত কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, কত কাহিনিতে, পুরাণে ধরা রয়েছে সূর্যবন্দনার সুপ্রাচীন সংস্কৃতি। তাই সূর্যের পুজো দেশের কৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
রাস্তায় দণ্ডী কেটে সাষ্টাঙ্গ সূর্যপ্রণামের দৃশ্য দেখেছি কোন শৈশব থেকে, মনে নেই। তখন দেখতাম, তোর্সার বাঁধের পাশে দণ্ডী কেটে, আবার দাঁড়িয়ে সূর্যকে প্রণাম জানিয়ে, আবার সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতের পর মেপে মেপে জলের কাছে পৌঁছে যাওয়া। কখনও-বা তীব্র ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গভীর জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। লাল শালুতে পুজোর উপচার ডালায় ঢেকে নিয়ে নদীর দিকে যাত্রা। ঢাক বাজছে। আমরা ছোটরা পুজোর আগের দিন থেকে বিকেলের বাতাস গায়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি সারি সারি ছট পুজোর আয়োজন। ঘাটে ঘাটে আলো, কলাগাছ, শোলার কাঠিতে রঙিন কাগজের বাহারে ঘাট সাজিয়ে তোলা। এক এক করে সবাই নদীর তীরে এসে দাঁড়াচ্ছেন।
আমার পুরনো স্কুলের শাকিলা রাম, দীপক, কৌশল্যাদি, বিজয়ের মতো বহু শিক্ষাকর্মী আর শিক্ষক ছটের ব্রতপালনের তিন দিন পর আমাদের হাতে এনে দিতেন প্রচুর ঠেকুয়া, কলা, ছোলা, নারকেলের মিষ্টি। আমরাও থাকতাম উদ্গ্রীব! সে প্রসাদের অপেক্ষা আজও থাকে। এবারও এ পুজোর আয়োজনে মুগ্ধ হব। শারদোৎসবের টানা ছুটির পর ছট পুজোর আগেই স্কুল বরাবর খুলে যায়, অপেক্ষা থাকে বার্ষিক পরীক্ষা কিংবা টেস্ট পরীক্ষার। তার মধ্যেই উৎসবের রেশ ফিরিয়ে আনে ছটপুজো।
ছট পুজোর দিন কাকভোরেরও আগে, অন্ধকার থাকতে-থাকতেই কানে আসত ঢাকের শব্দ। বুঝতাম, তোর্সার ধারে জমা হচ্ছে ভক্তের দল। ভোরে এক ছুটে দেখে আসতাম সেই রঙিন ছবি! পূর্ণসূর্য ওঠার অপেক্ষায় কনকনে ঠান্ডা জলে বুক পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কত মানুষ! তার পর রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়তেই পুজোর উপচার গুছিয়ে ভেজা শরীরে একে একে তাঁদের বাড়ির পথে সারিবদ্ধ ভাবে হেঁটে যাওয়া। অবাক হতাম! কৌতূহল জাগত! ওঁদের পুজোয় কোনও পুরোহিত লাগে না কেন? প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছি বড়দের। সহপাঠী কবিতা আগরওয়ালকে দেখতাম, ছট পুজোর পরে মেহেন্দিতে হাত রাঙিয়ে স্কুলে আসতে। চোখে মোছা-মোছা কাজল। বাড়িতেও ছটপুজোর প্রাপ্তি! ঠেকুয়া! এখন স্কুলে সহকর্মীরা প্রসাদের টুকরি স্কুলে নিয়ে এসে প্রসাদ বিতরণ করেন।
আমরা সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলি আকছার। ঘটনা হল, বহু আগে থেকেই সর্বধর্ম সমন্বয়ের তীর্থস্থানেই বাস করছি আমরা। কোনও রীতিনীতিতে নিজে লিপ্ত হয়ে যাই, আবার কোনও রীতিনীতি সযত্নে হাত ধরে উদ্যাপনে লিপ্ত করে আমাদের! এ তো কম কথা নয়! কখনও দেখিনি, তুমি কত দূরের, তোমার ধর্ম কি আলাদা, তোমার সম্প্রদায় কি পৃথক— এমন ভাবনা! এ সবটুকুই গড়ে তোলা! বানানো! বিভেদ-ভাবনা শৈশবেও ছিল না, এখনও নেই।
জলপাইগুড়ির তিস্তা-করলার ধারে রঙিন আলোয় ভরে ওঠা ঘাটে বর্তমানের এই আমি দাঁড়িয়ে থাকি। কোচবিহারে তোর্সার ধারের যে বাঁধাধরা পুজোর ছবি, সে এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে নদীর গতিমুখ বদলে গিয়েছে বলে। অনেক দূরে চলে গিয়েছে নদী। এখন বিরাট আয়োজন সাগরদিঘির চারপাশের ঘাটে। রঙিন কাগজ, আলোর মালার নয়নাভিরাম সজ্জা! আগের দিনই নির্দিষ্ট করে নেওয়া নিজের নিজের জায়গাটুকু। তার পর সূর্যের উদ্দেশে মন্ত্রোচ্চারণ, প্রণাম। গোটা নারকেল, আখ, নতুন পোশাক ডালায় সজ্জিত।
বাঙালির উৎসব আর অবাঙালির উৎসব বলে কোনও ভাবনা থাকতে পারে না! আমার বহু বন্ধু ছটপুজোয় মানত করেন, পুজো দেন, দণ্ডী কাটেন। যেমন শারদোৎসবে মেতে ওঠেন সকলে মিলে। অবাঙালি পুজোর রীতি, যা মূলত বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালে জনপ্রিয়, তা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে। ঠিক যেমন আমরা পিরের দরগায় মোমবাতি জ্বালি, গির্জায় প্রার্থনা করি, গুম্ফায় ধ্যানস্থ হই। মিলনের এই সংস্কৃতিই, এই সব উৎসবই আমাদের পরস্পরকে বেঁধে-বেঁধে রেখেছে। এটাই পাশে থাকার ইঙ্গিত। এখানেই সমস্ত বিভেদ, হিংসার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে মানুষ। বিস্ময় জাগে তখনই, যখন দেখা যায়, এই মানুষই আবার অকারণ সন্দেহে অসহায় নির্দোষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে! কখনও ছেলেধরা বা পাগল ভেবে, কখনও অনধিকারী সন্দেহে, কখনও সংকীর্ণ ভাবনার উন্মাদনায়! এই মানুষ যখন সম্মিলিত হয় বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে, এক মাটিতে দাঁড়ায় মাতৃ-আরাধনায়, তখন সত্যই চিনতে কষ্ট হয়!
সম্মিলিত সূর্যের স্তব তাই শান্তি দেয়। যতবড় নাস্তিবাদই প্রতিবন্ধক হয়ে বিরাট দেয়াল তোলার চেষ্টা করুক না কেন, উৎসবের সুরে মিলনেরই জয়গান।
(লেখক কোচবিহারের সুনীতি অ্যাকাডেমির শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy