মুক্তধারা: নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তের বলতে আসার বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ। বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন
এখন এ বড়ো দুঃসময়। অলীক কুনাট্য চারদিকে। রাজনৈতিক ছলা-কলার শেষ নেই। এরই মধ্যে দেশের ছাত্রী-ছাত্ররা সরব। তারা কিন্তু না-বুঝে দলবদ্ধ হয়নি। প্রশ্ন করার অধিকার তাদের আছে, সে অধিকারই তারা বজায় রাখতে সচেতন। তারা যে সবাই দক্ষিণ বা বাম রাজনৈতিক দলের সদস্য তা-ও নয়। দেশের আগামীরা সচেতন ভাবে বিভেদমূলক দমননীতির, লেবেল-সাঁটা প্রশাসনিকতার, ভয়-ধরানো নজরদারির, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নহীনতা কায়েম করার, সামাজিক ও প্রাকৃতিক সামঞ্জস্য নষ্ট করার চেষ্টা করছে যে বেওসাদারি ক্ষমতাতন্ত্র তার বিরোধিতা করছে। এই বিরোধিতা দেখে ভরসা হয়। মনে হয় রবীন্দ্রনাথ থাকলেও তাঁর সমর্থন সম্ভবত ছাত্র পক্ষেই যেত। এটা ঠিকই বয়সের ধর্মে সর্বত্র সুস্থির বিবেচনা তারা দেখাতে পারেনি, তবে রবীন্দ্রনাথ তো বিবেচনার নামে কায়েমি-স্বার্থের পক্ষপাতীদের চাইতে সৎ অবিবেচকদের উপরেই ভরসা রাখতেন বেশি (দ্র. বিবেচনা অবিবেচনা, কালান্তর)।
রবীন্দ্রনাথ দিশাহীন বোধহীন জন-উদ্দীপনার সমর্থক ছিলেন না। রাজনীতির নামে, দেশের ডাকে মত্ত উত্তেজনার আঁচ পোহানোতে তাঁর ছিল ঘোর আপত্তি। প্রতিষ্ঠানে বয়কটের রাজনীতিকেও তিনি প্রশ্রয় দেননি। কিন্তু তাই বলে সঙ্কট মুহূর্তে তিনি শান্ত থাকবেন, স্থিতিশীল থাকবেন, এও তো আদর্শ হতে পারে না। জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে ছাত্রদের ওপর ইংরেজ অধ্যাপকদের দমন-পীড়ন সর্বত্রই তিনি সরব। কলেজ থেকে সুভাষচন্দ্রকে বহিষ্কারের সময় রবীন্দ্রনাথ সুভাষেরই পক্ষ নেন। ব্রতীদল তৈরি করে ছাত্রদের যেমন গঠনমূলক স্বদেশির কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন তিনি, তেমনই তাঁর প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদের ক্ষমতার চরিত্র এবং নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে দিতে চেয়েছিলেন নানা সময়ে।
ছাত্রদের ইংরেজি শেখানোর জন্য ‘কিং অ্যান্ড দ্য রেবেল’-এর মতো নাটক তো আর এমনি লেখেননি। সেই নাটকে এক স্বৈরাচারী রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ চোখ-কান খোলা রাখার পক্ষপাতী, প্রশ্ন তোলা জায়মান ক্রিয়া। থেমে গেলে চলবে না। রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ নাটকে পঞ্চকেরা প্রতিষ্ঠানের অচল নিয়মকে প্রশ্ন করলে গুরু সেই প্রশ্নশীলকে সাদরে বরণ করে নেন।
তাঁর অন্যান্য রচনার তুলনায় নাটকেই প্রাতিষ্ঠানিক বজ্জাতির স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে সবচেয়ে বেশি, প্রতিবাদের পথও সেখানে দেখানো হয়েছে। এর একটা কারণ হয়তো এই, রবীন্দ্রনাথ জানতেন পাঠ্য-সাহিত্যের চাইতে দৃশ্য-শিল্প অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছয়। স্বদেশি গানে এক সময় তাঁর দেশ মিছিলে উঠেছিল জেগে। এই দুঃসময়ে মনে হয় বাঙালি-নির্মিত পেলব রাবীন্দ্রিক সংস্কৃতির ঘোমটা টেনে খুলে ফেলে তাঁর নাটকে প্রকাশিত ভয়ঙ্কর প্রতিষ্ঠান-বিরোধী কঠোর কথাগুলিকে যত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তত ভাল।
প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্র-প্রশাসন-সংগঠন কী ভাবে বিরোধী স্বরকে চেপে দেয় রবীন্দ্রনাথ তা খুবই ভাল জানতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঔপনিবেশিক সরকারের দাঁত-নখ তিনি দেখেছিলেন। বিশ্বচারী ছিলেন বলে পাশ্চাত্যের নেশনতন্ত্রের কৌশলী দস্যুবৃত্তি তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়। আমরা যাকে সিমুলেশন (simulation) বলি, রাজনৈতিক ক্ষমতার কুশীলবেরা সেই ছলা-কলায় যে কী পারদর্শী, তা বোঝার কাণ্ডজ্ঞানও তাঁর ছিল।
দাঁত-নখওয়ালা প্রশাসন প্রথমেই কী করে? যারা প্রাকৃতিক ও সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্টকারী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব, সেই মানুষগুলিকে নির্বিচারে জেলে ভরে দেয়। এমনকি শাসনতন্ত্রের মধ্যবর্তী কেউ প্রতিবাদী হলেও একই দাওয়াই। ‘মুক্তধারা’ নাটকে ক্ষমতাদর্পী প্রশাসন ক্ষত্রিয় আর বৈশ্যের সমবায়। অর্থাৎ রাজার শাসনতন্ত্র মুনাফাখোর বেওসাদারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কথাটা সে নাটকেই ছিল, ‘ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রে আর বৈশ্যের যন্ত্রে যে মিলিয়েছে, জয় সেই যন্ত্ররাজ বিভূতির জয়’। এর বিরোধিতা করেন বলে স্বয়ং যুবরাজ শিবিরবন্দি, পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে তোলা জননেতা ধনঞ্জয়ও শিকলরুদ্ধ। এ দিকে স্বৈরতান্ত্রিক প্রশাসন নজর দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। পড়ুয়ারাই তো যত নষ্টের মূল। আগে থেকে তাই মগজ-ধোলাই। সে কাজে লাগানো হয়েছে ধামাধরা শিক্ষকদের। যুক্তিহীন ভাবে ক্ষমতাসীন শাসকের বুলি কপচানোই তাদের কাজ। ছেলেরা বলে, ‘ওরা খুব খারাপ, ভয়ানক খারাপ, সবাই জানে’, বলে ‘ওদের ধর্ম খুব খারাপ’। স্টিরিয়োটাইপ এ ভাবেই তৈরি হয়। তার পরেই রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়া। কারণ পড়ুয়ারা শিখেছে যুদ্ধে তারা বা তাদের দেশ কখনও হারে না।
বন্দিশিবির নির্মাণ, শিক্ষাতন্ত্রের যুক্তিহীন সামরিকীকরণের পাশাপাশি আর কী করে প্রশাসন? সে সব কাজকারবার খুবই সূক্ষ্ম। সে সবের খবর মিলবে ‘মুক্তধারা’র পরে লেখা ‘রক্তকরবী’ নাটকে। চাই নজরদারি। ব্যক্তিগত পরিসর বলে কিচ্ছু থাকবে না। সর্বশক্তিমান শাসক সর্বদৃষ্টিমান হয়ে উঠবেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বহুদর্শী’। তাঁকে লুকিয়ে গোপন কম্মোটি পর্যন্ত করার উপায় নেই। বিশু সে নাটকে বলেছে, ‘এখানে তো চার দিকেই সর্দারের ছায়া, এড়িয়ে চলার জো কী?’ সে কালে ছায়াময় নজরদারদের লাগত, এ কালে নজরদারি আরও সূক্ষ্ম— আন্তর্জালে সবাই বন্দি। নজর যারা করে তাদের মাথায় বসে থাকে নজর যারা করায় তারা। কী ভাবে কাকে শায়েস্তা করবে, সে উপায় ঠিক করার আগে মানুষকে নানা গোত্রে ভাগ করে ‘লেবেল’ লাগায়। দেগে দিতে পারলে বিরোধী মানুষ দমনের উপায়গুলি নির্দেশ করা সহজ। ফ্যাসিস্টরা তো তা-ই করত— প্রথমে দেগে দিত। এ নাটকেও সংখ্যা দিয়ে মানুষকে দেগে দেওয়া হয়। তার পর পাঠানো হয় ‘ফৌজ’। ফৌজের পর আসে ধর্মগুরু। ধর্মগুরু গোঁসাই বলে, ‘ফৌজের চাপে অহংকারটার দমন হয়, তার পরে আমাদের পালা।’ সামরিক ও ধর্মীয় দমননীতি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সে আঁতাত সাধারণ মানুষও জানে। ‘যে রশিতে এই চাবুক তৈরি, সেই রশির সুতো দিয়েই ওদের গোঁসাইয়ের জপমালা তৈরি।’ ‘ওদের মদের ভাঁড়ার, অস্ত্রশালা আর মন্দির একেবারে গায়ে গায়ে।’
মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যজিতের ফেলুদার মতো রবীন্দ্রনাথকে বলে ফেলি, ‘ধন্যি চোখ মশাই আপনার।’ ১৯২৩-১৯২৪’এই আপনি ২০১৯-২০ দেখে ফেলেছিলেন। এই তো সে দিন আমাদের সামাজিক-মাধ্যমগুলির ওপর নজরদারির কথা উঠছে, ভয় দেখানোর জন্য নাগরিকপঞ্জি-আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষ, ইতিহাসবিদ কেউ বাদ যাচ্ছেন না। এ দেশের সংখ্যালঘুদের নানা ভাবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, প্রতিবাদীরাও লেবেল সাঁটা— কথা বললেই ‘আরবান নকশাল’। আর এই আন্দোলনে তরুণীদের উপস্থিতি আর সরবতা চোখে পড়ার মতো। তাদের টার্গেট করা হচ্ছে তবে তারাও দামাল, ভয় পাচ্ছে না।
‘রক্তকরবী’ নাটকে নন্দিনী বলে এক মেয়ে এসে জুটেছিল। কী তার সাহস! তার পুরুষসঙ্গীটিকে খুন করা গিয়েছে। মেয়েটাকে কী করা যায়? দুই ক্ষমতাতন্ত্রী স্বৈরাচারপন্থীর কথোপকথন রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই পেশ করা যাক। ‘এবার কিন্তু ঐ মেয়েটাকে অবিলম্বে’— কথা শেষের আগেই মেজো সর্দার বলে ‘না না, এ-সব কথা আমার সঙ্গে নয়। যে মোড়লের উপর ভার দেওয়া হয়েছে সে যোগ্য লোক, সে কোনও নোংরামিকেই ভয় করে না।’ অর্থাৎ নোংরামি শব্দটি রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন। কেবল প্রহার বা হত্যা নয় বোধ হয়। তার আগে? মেয়ে তো, তাই ধর্ষণ ধরা যাক। ফ্যাসিস্ট সামরিক পুরুষেরা যা করে! কেউ ভাবতেই পারেন ‘শান্ত-শীলিত’ রবীন্দ্রনাথের ওপর এ সব আরোপ করছি। রবীন্দ্রনাথ এতটা ভাবতেই পারেন না। শুধু তথ্য হিসেবে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ ‘ধর্ষণ’কে বিষয় হিসেবে ব্যবহার করে কবিতা লিখেছিলেন। ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে’ অনেক পরে লেখা কবিতা। সেখানে অন্ধ কলুবুড়ির সোমত্ত নাতনিকে রেপ করে খুন করা হয়েছিল (‘যৌবন তার দ’লে গেছে জীবন গেছে চুকে’)। সে সামন্ততন্ত্রের লালসার গল্প, স্বৈরাচারী শাসক ও তাদের অনুগত মত্ত দলতন্ত্রীরা বিরোধী নারীর শক্তিকে দমন করার জন্যই তা করার কথা ভাবে।
এর থেকে মুক্তির উপায় কী? রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী বলেছিল, এই অবস্থায় সে যদি স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য নামগান শুনে শান্ত থাকে তা হলে নিজেকেই ধিক্কার দিতে হবে। এ রবীন্দ্রনাথেরই মনের কথা। কথা তুলতেই হবে, প্রতিবাদও করতে হবে। তাই মনে হচ্ছে সজাগ ছাত্র-ছাত্রীরাই তাদের ক্ষেত্র-বিশেষে বয়সোচিত অবিবেচনা নিয়েও এখন যথার্থ অর্থে প্রশ্নশীল ও সৎ, সেই অর্থেই রাবীন্দ্রিক।
বিশ্বভারতী, বাংলা বিভাগ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy