ছবি এপি।
বারুইপুরের একটি ইটভাটা হইতে ছত্তীসগঢ়ের সতেরো জন শ্রমিককে বন্দিদশা হইতে উদ্ধার করিয়াছে পুলিশ। এমন সংবাদে স্বস্তি মিলিত, যদি জানা যাইত যে আর কোনও বন্দি শ্রমিক নাই। বাস্তব ইহাই যে, বাংলার ইটভাটাগুলিতে অগণিত শ্রমিক কার্যত দাসশ্রমিক হইয়া আছেন। কেহ ছত্তীসগঢ়, বিহার, ঝাড়খণ্ড হইতে আসিয়াছেন, কেহ আবার সুন্দরবন-সহ এই রাজ্যেরই বিভিন্ন স্থান হইতে আসিয়াছেন। এই দরিদ্র মানুষেরা বাঁধা পড়িয়াছেন অগ্রিমের ফাঁদে। কর্মহীন দিনগুলিতে রোজগার চালাইতে তাঁহাদের ভরসা ঠিকাদারের নিকট ‘দাদন’ বা অগ্রিম গ্রহণ। এই ঋণ শোধ করিতে ঠিকাদার-নির্দিষ্ট ভাটায় ছয় মাস প্রায় বন্দিদশায় পরিশ্রম করিতে হয়। নিজের মজুরি নির্দিষ্ট করিবার ক্ষমতা তাঁহাদের নাই, ঠিকাদার যাহা দিবে তাহাই গ্রহণ করিতে হয়। ঋণ পরিশোধ করিয়া পারিশ্রমিকের যেটুকু অংশ তাঁহাদের হাতে পড়িয়া থাকে, তাহা দুই-তিন মাসেই ফুরাইয়া যায়। অতএব আবার ঋণ ও পরিশোধের আবর্তে জীবন চলিতে থাকে। দাসশ্রমের ছবিটি কোথাও চূড়ান্ত অমানবিক— সে সকল ইটভাটায় বিনা পয়সায়, প্রায় অনাহারে শ্রমিকদের বন্দি রাখিয়া দৈহিক নির্যাতন চলিতে থাকে। অনেক রাজ্যেই এমন ঘটিতেছে। পলাতক শ্রমিককে ধরিয়া হাত-পা কাটিয়া দিবার, কিংবা হত্যা করিবার মধ্যযুগীয় বর্বরতাও দুর্লভ নহে। অধিকাংশ স্থলে অতি সামান্য টাকায়, অতি জঘন্য বাসস্থলে শ্রমিকদের রাখিয়া কঠোর পরিশ্রম করাইয়া লয় মালিকপক্ষ। বহু প্রজন্ম ধরিয়া ‘চুক্তিশ্রম’-এর যে ব্যবস্থা চলিতেছে, বাস্তবে তাহা দাসশ্রম। স্বাধীন দেশের কলঙ্ক।
ইটভাটাগুলির ভয়ানক পরিস্থিতি পুলিশ-প্রশাসন কিংবা শ্রমিক সংগঠন, কাহারও নিকট অজ্ঞাত নহে। এক একটি ইটভাটায় এক দিনে কত না আইন ভঙ্গ হয়। ন্যূনতম মজুরি, শিশুশ্রম নিবারণ, শিক্ষার অধিকার, নারীনির্যাতন প্রতিরোধ, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার, সকল আইন নিয়তই লঙ্ঘিত হইতেছে। ইটভাটার প্রবেশমুখে থমকাইয়া গিয়াছে শ্রমিক সুরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার সকল প্রকল্প। কেবল পশ্চিমবঙ্গের ইটভাটাগুলিতেই অন্তত চল্লিশ হাজার শিশু তাহাদের বাপ-মায়ের সঙ্গে কাজ করিতেছে। তাহারা অধিকাংশ অপুষ্ট, অক্ষরপরিচয়হীন। তাহাদের সংবিধান-প্রদত্ত অধিকারের প্রতি প্রশাসন উদাসীন। শ্রম, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের পদস্থ কর্তারা কি ইটভাটার অভ্যন্তরের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত নহেন? দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক পুলিশকর্তা বলিয়াছেন, দাসশ্রমিক নিয়োগের অভিযোগ তাঁহারা পূর্বে পান নাই। তাঁহার ভাবটি এই যে, অভিযোগ জমা পড়িলে তবেই পুলিশ অপরাধের কথা জানিতে পারে। পরিবেশ দূষণ হইতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সকলই পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় করিয়া থাকে ভাটামালিকেরা। নিজেদের ন্যায্য পাওনা দাবি করিয়া ভাটাশ্রমিকদের আন্দোলনও কম হয় নাই। সরকারি কর্তারা প্রভাবশালীদের প্রতি ভয়ে-ভক্তিতে চোখ বুজিয়া আছেন বলিয়াই দরিদ্রের দাসত্ব দেখিতে হইতেছে দেশবাসীকে।
একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা দেখাইয়াছে, বিশ্বে চার কোটি মানুষ কার্যত দাসশ্রমিকের জীবন কাটাইতেছেন। তাঁহাদের অন্তত আশি লক্ষ ভারতে। ইটভাটা, আখখেত, কাপড়কল, পাথর খাদান, এমন নানা স্থলে তাঁহারা ছড়াইয়া আছেন। ভারতে বাস্তবিক আইনের শাসন থাকিলে, সরকারি প্রকল্পগুলি কার্যকর হইলে ইহারা কখনও বৎসরের পর বৎসর এ ভাবে ঠিকাদারের নিকট বাঁধা পড়িয়া থাকিতে পারিতেন না। একবিংশের ভারতে মানবতার এই অপমান চলিতে পারে না। অবিলম্বে সকল ইটভাটার শ্রমিকদের নথিভুক্ত করিতে হইবে। শ্রমিকের প্রাপ্য সকল সুবিধা ও সুরক্ষা তাঁহাদের পাইবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy