বেশ একটা বড় পরিবারে সকালে ঘুম ভাঙার পর যদি দেখা যায় কেউ এক জন রোজকার মতোই ঘুমিয়ে, কিন্তু আসলে তিনি মারা গিয়েছেন, তা হলে প্রথম যিনি বা যাঁরা দেখেন, তাঁরা সেটাকে মৃত্যু বলে বুঝতেই পারেন না সরল কারণে। বাড়িতে তো রোজ মৃত্যু ঘটে না। মৃত্যুটা তো আর রোজকার চেনা নয়। বাড়িতে যদি তেমন কোনও রোগী থাকেন যাঁর মৃত্যু ঘটতে পারে আচমকা এবং সেই মৃত্যুর কারণ বাড়ির সবাই জানেনও বটে, তা হলে হয়তো এমন মৃত্যু স্বাভাবিক ভাবেই সবাই মেনে নেন। কিন্তু যে মৃত্যুর আভাসও কেউ জানেন না, তার কারণ বোঝার জন্য ডাক্তার-বদ্যির দরকার হয়। খুব নিকট ডাক্তার ছাড়া কেউ ডেথ সার্টিফিকেট দেন না। আর, এটা যে কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যু নয়, সেটা প্রমাণের জন্যও ডেথ সার্টিফিকেটের বাঁধা গত আছে— উনি অসুখে ভুগছিলেন, ডাক্তারবাবু ওঁর চিকিৎসা করছিলেন, স্বাভাবিক চিকিৎসাধীন মৃত্যু।
বাড়ির লোকজনও জানতে চান, কেন এমন হল। সেই কৌতূহল যুক্তিসঙ্গত। তাই মাল্টি-অর্গ্যান ফেলিয়োর, হার্ট ব্লক, এমন শব্দের বেশ সামাজিকতা জুটে গিয়েছে। আরও কিছু এমন শব্দ আছে। শব্দগুলির সামাজিকতা অর্জনের একটাই কারণ— মানুষ যুক্তি চায়, একটা যুক্তি আর একটা যুক্তিকে নাকচ করলেও মানুষ যুক্তির কাটাকুটি চায়।
পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ভোট নিয়ে এখন এই বিশ্লেষণ প্রতি দিনই মিডিয়াতে বেরোচ্ছে। তাতে আমাদের যার যা কৌতূহল, তার নিরসন হচ্ছে। কিন্তু এই কৌতূহলগুলিও ব্যক্তিগত। যদি ফল এমন না হত, তা হলেও আমাদের ব্যক্তিগত ধারণাগুলি বদলাত না।
কারণ সবচেয়ে সোজা ঘটনাটা আমরা দেখতে চাইছি না। সেটা আরও জটিলতা বাড়াবে। কোনও বাড়িতে যদি ডাকাতি হয়, একমাত্র তা হলেই এমন ফল সম্ভব। তৃণমূল ভাল না মন্দ, বামফ্রন্ট বিজেপি হয়ে গিয়েছে না হয়নি, কংগ্রেস বলেও কিছু নেই, বামফ্রন্ট বলেও কিছু নেই, শুধু বিজেপি বলে একটা দল, যাদের ক’টা সাইনবোর্ড আছে, তাও গুনে ফেলা যায় ও নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, ৪২টি লোকসভা আসনের এক-একটির অন্তর্গত সাত-আটটি বিধানসভা আসনের প্রত্যেকটিতে গড়ে তিনশোটি করে বুথ থাকলে এই ৩০০x৮x৪২= ১,০০,৮০০টি বুথে নিজেদের এজেন্ট দেওয়ার মতো লোক বিজেপির নেই। কেউ যদি বলেন, আছে, তা হলে এটা নিশ্চিত বলা যায়— এমন কর্মিশক্তি গোপন করা যায় না, গোপনে রাখাও যায় না। এটাই নির্বাচিত গণতন্ত্রের ভিত্তি। যদি থাকত, তা হলে আমরা বাইরের লোকেরা টের পেতাম। বুথ-সংগঠনের মানে একটি বুথের অন্তর্গত গড়ে ২০০টি পরিবারের প্রত্যেককে চেনে। কে কোথায় চাকরি করেন, কে ভোট দিতে আসবেন, কে আসবেন না, ক’জন মারা গিয়েছেন— তা নখদর্পণে থাকে একটি কর্মিগোষ্ঠীর। বুথের ভিতরে তো থাকেন এক প্রার্থীর এক এজেন্ট। তিনি তাঁর তালিকায় টিক দিয়ে বাইরের বুথকর্মীদের জানিয়ে দেন, কোন পাড়ার ভোটার এখনও আসেননি। এখন মোবাইল ফোনের সুবাদে হয়তো এই নিতান্ত প্রয়োজনীয় কাজগুলো সহজ হয়েছে। কিন্তু কাজগুলো কাজই আছে, কিছুমাত্র বদলায়নি। এটা ভোটগ্রহণের একমাত্র পদ্ধতি।
এই পদ্ধতি ভাঙতে হলে আর কোনও ‘পদ্ধতি’ নিতে হয়। সেই পদ্ধতির মূলই হচ্ছে, স্বাভাবিক সমস্ত কাজকর্মের ওপর ‘সশস্ত্র’ আক্রমণ, যার পদ্ধতি একমাত্র যারা করছে তারাই জানে। তাদের কাজ শেষ করে তারা চলে যায়। ‘ব্লিত্জ়ক্রিগ’ বলে একটি শব্দ আছে— একেবারে অনিশ্চিতপূর্ব চতুর্দিকব্যাপী আক্রমণে প্রতিপক্ষকে দিকদিশাহীন নাজেহাল করে দেওয়া। ভোটের ষষ্ঠ ও সপ্তম দফায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে এই পদ্ধতিতেই ভোট করানোর চেষ্টা করেছেন, যার চরমবিন্দু হয়ে উঠেছে বিজেপির কলেজ স্ট্রিট রোড শো-তে বিদ্যাসাগরের মূর্তিকে মাটিতে আছড়ানো— এমন যদি কেউ বলে? যদি কেউ বলে, এ এমন পদ্ধতি বা ব্লিত্জ়ক্রিগ, যাতে একটি চরমবিন্দু তৈরি করতে হয়? দেখেশুনে মনে হয়, সে দিনটিকেই বিজেপি চরমবিন্দু সাব্যস্ত করেছিল। নইলে সে দিন বা পর দিন অনেক বড় অশান্তি হত।
আর সাধারণ নির্বাচনের প্রচলিত ব্যবস্থা ও ব্যবহারবিধি উপেক্ষা করে নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রী ও অমিত শাহকে এই নতুন পদ্ধতিতে সাহায্য করেছে। প্রথমত, সেনাবাহিনীর সক্রিয়তাকে নির্বাচনের প্রচারে ব্যবহারে বাধা না দিয়ে, দ্বিতীয়ত, সাম্প্রদায়িক বিভাগকে অস্পষ্ট ভাবে নির্বাচনে ব্যবহারে বাধা না দিয়ে, তৃতীয়ত, নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে কলকাতার বড় রাস্তায় সিবিআই-কে রাজ্য সরকারের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে নিষেধ না করে, চতুর্থত, নির্বাচনের শেষ দফাতেও রাজ্য প্রশাসনে ব্যাপক অদলবদল ঘটিয়ে ‘স্বাভাবিক’ প্রশাসনকে অকেজো করে দিয়ে।
আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এই অসামান্য পদ্ধতির নায়ককে নিজে হাতে চামচে করে মিষ্টি খাইয়ে পদ্ধতিটিকেও সামাজিক সৌজন্যের অন্তর্গত করে দিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy