প্রতীকী ছবি।
আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণ মাস। তার দোরগোড়ায় মেঘের ছিটেফোঁটাও দেখা নেই। প্রকৃতিও যেন মুখঝামটা মারছে। কাটফাটা রোদ্দুর। মাঠঘাট ফেটে চৌচির। চাষির আগুনপোড়া মুখ। কপালে গভীর দুশ্চিন্তার ভাঁজ। ভোরের আলো ফুটতেই নদিয়ার গোয়াসের বুধু মণ্ডল চলছেন পাটের জমিতে। খেতের কাছে এসে বিমর্ষ পাটের খেতের দিকে বুধু এক বার তাকান আর আকাশপানে এক বার। রুখুসুখু পাটের খেত। ডগাগুলো শুকিয়ে খটখটে। সবুজ পাতা সব হলদেটে। বুধুর বুকের ভেতরটা খা-খা করে ওঠে। ঋণ নিয়ে ধার শোধ আবার ধার করে ঋণ শোধ—- চক্রাকারে এ ভাবে বছরভর চলে। এ চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পান না বুধু। সেই কবে এ বঙ্গে ভাগচাষি খুবই সামান্য জমি পেয়ে ক্ষুদ্র চাষির তকমা পেয়েছিলেন। ক্ষুদ্র চাষি পুনরায় খেতমজুরে পরিণত হন। চাষির ছেলে আর এখন মাঠমুখো হন না। কর্মসংস্থানের খোঁজে পাড়ি দেন ভিন্ রাজ্যে।
বুধু জাত খেতমজুর। মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা। বাপ-ঠাকুর্দার কাছে শিক্ষা— জমির সঙ্গে কখনও বেইমানি করতে নেই। জমি কথা বলে। খুশিতে হাসে। জমিও কষ্ট পায়, কান্না করে। বাপ ছিলেন ভাগচাষি। যে বছর মাঠে-ঘাটে সব লাল নিশান পতপত করে উড়ছিল সে বছর বুধুর বাপ বিঘে দুই জমি পেয়েছিলেন। সেই বছর বুধুরা হয়েছিলেন বর্গাচাষি থেকে ক্ষুদ্রচাষি। মেয়ের বিয়ের পর বুধুর সম্বল এখন এক বিঘে জমি। বুধু এখন প্রান্তিক খেতমজুর।
সেই কিশোর বয়স থেকেই বাপের সঙ্গে বুধু বছরে এক-দু’বার কলকাতায় ব্রিগেড যেতেন মিটিং-মিছিলে। পার্টির ভাড়া করা লরিতে। গরু-ছাগলের মতো গাদাগাদি করে। গলার শিরা ফুলিয়ে এক জন মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত শূন্যে নিক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠতেন— ‘ই....ন...ক্লা...ব’। পর ক্ষণেই বাকি সকলে গগনভেদী চিল চিৎকার করতেন— ‘জিন...দা... আ আ.....বাদ’। পথে কোথাও একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার স্লোগান দিতে দিতে ব্রিগেডমুখী।
ব্রিগেড গ্রাউন্ড থেকে অনেক দূরে নেমে তার পর পায়ের তালে তালে মিছিল নগরীর লাল আকাশের ভিড়ে মিশে যাওয়া। প্রখর রোদকে পাত্তা না দিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে দূর-দূরান্ত গ্রামের মিছিল পৌঁছাত ব্রিগেডে। রাশি রাশি কালো মাথার উপর বিশাল লাল সামিয়ানা। বহু দূরে, প্রায় দেখা যায় না মঞ্চ থেকে মাইকে ভেসে আসে— কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।
কিশোর বুধু অবাক হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করত, মিটিং-মিছিলে কী ভাঙার প্রতিযোগিতা চলে! তা হলে গড়ার প্রতিযোগিতা কোথায় হয়?
সিঙ্গুর সরণি বেয়ে সবুজের সুনামিতে লাল হয়ে যায় ফিকে। সময়ের বেড়া জালে এ বঙ্গের বাতাসে এখন আবার সবুজের সঙ্গে গেরুয়ার টক্কর।
কিন্তু বুধুর কাছে কিশোর বেলার সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা। আসলে বুধুরা রাজনীতির শ্রমিক। লাল, সবুজ, গেরুয়া নেতারা কৌশলে তাঁদের শ্রমিক মৌমাছি বানিয়ে রেখেছেন। ভোটের ময়দান থেকে ব্রিগেডের ময়দান— সর্বত্র বুধুরা রাজনীতির শ্রমিক মৌমাছি। শ্রমিক মৌমাছির মতো দিনরাত এক করে ধুলো ঘামে জবজবে শরীরে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়কে উপেক্ষা করে ব্রিগেড অথবা ধর্মতলা চত্বর ভরানোর গুরুদায়িত্ব পালন করেন বুধুরা। চোখে তাঁদের কখনও লাল স্বপ্ন, কখনও সবুজ স্বপ্ন আবার, কখনও গেরুয়া স্বপ্ন। স্বপ্নবিভোর হয়ে দলে দলে রাজনীতির শ্রমিক মৌমাছিরা চলেন ধর্মতলা অথবা ব্রিগেডে।
ধর্মতলায় মিটিংয়ে বুধুরা এ বার বাসে এসেছেন। সব খরচ পার্টির। সারা দিনের রোজ কামাই করে পথের ধারে ডিম-ভাতই আজকের মজুরি। উপরি পাওনা নতুন নতুন স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখানো একটা বিশেষ শিল্প। সেই শিল্পে যে রাজনৈতিক দল যত পারদর্শী, সেই দলে তত বেশি শ্রমিক মৌমাছি ভনভন করে।
প্রতি মিটিংয়ে নতুন নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা, নতুন আকাঙ্ক্ষা। মিটিং শেষে ভিড় ঠেলে বাড়ি ফেরার পথে স্বপ্নের ঘোরে মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। এ বার নিশ্চয় তাঁরা ফসলের নায্য দাম পাবেন। দুঃখ-কষ্টের দিন শেষ হবে। দেনার দায়ে আত্মহত্যা করতে হবে না।
মঞ্চের রং পাল্টায়, পতাকার রং বদলায়... মিছিলের স্লোগান পাল্টায়... শুধু বুধুর দুরবস্থা পাল্টায় না। গ্রামের মেঠো পথ লাল মোরামে ঢাকা পড়ে, লাল মোরাম উপরে আবার কালো পাথর ডানা মেলে। কিন্তু পাটের নায্য দাম মেলে না। রঙিন স্বপ্নগুলো কেমন যেন আবার ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ভোট আসে ভোট যায়, মিটিং- মিছিলে পা মেলাতে মেলাতে বুধুদের পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়। পতাকা বহন করতে করতে হাতের চেটোতে কড়া পড়ে যায়, মিছিলে গলা মেলাতে মেলাতে গলার স্বর ভেঙে যায়। কিন্তু রাজনীতির শ্রমিক মৌমাছিদের অবস্থা সেই তিমিরেই রয়ে যায়।
সোনালি আঁশ ধূসর হয়ে যায়। কাঠফাটা রোদ্দুরে পাটের খেতের সামনে দাঁড়িয়ে বুধুর বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বুধু বলে ওঠেন— ‘‘হে ভগবান! চাষির কেউ নেই!’’ পাশে বুধুর ছেলে ভোলা, বয়স বছর দশ। ছেলের মাথায় হাত রেখে হঠাৎ ক্ষোভের সুরে বুধু বলে ওঠেন— ‘‘বেটা তুই কখনও ব্রিগেড, ধর্মতলা যাবি নে... ওখানে জাদুকরেরা ম্যাজিক দেখান। ওখানে শুধু স্বপ্নের ম্যাজিক দেখানো হয়, গরিবের জন্য কিছুই গড়া হয় না!’’
ভোলা বাপের হাতটি চেপে ধরে। পাশের খেত থেকে আল বরাবর কাস্তে হাতে এগিয়ে আসছেন রহিম চাচা। রহিম চাচার দরাজ গলায় ভেসে আসছে— আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে। হঠাৎ আকাশ থেকে দু'এক পশলা বৃষ্টির ফোটা ছুঁয়ে যায় বুধুর আগুনপোড়া মুখে।
পশ্চিম আকাশে কালো মেঘের মিছিল। বাপ বেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে গেয়ে ওঠেন— ‘‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে।’’
শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy