Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

স্ব-ইচ্ছার দাবি

মনজোতের বক্তব্য, আপন ইচ্ছা পূরণের সুস্পষ্ট আইনি অধিকার তাঁহার রহিয়াছে, আইনের স্থান সব আবেগ এবং (পারিবারিক) সম্পর্কের উপরে, ইতিপূর্বে একটি তুলনীয় পরিস্থিতিতে রাজস্থানের একটি মেয়েকে সেই রাজ্যের হাইকোর্ট কিডনি দানের ইচ্ছাপূরণের অনুমতি প্রদান করিয়াছিল।

মনজোতের (বাঁ দিকে) সঙ্গে সামরিন। ছবি: ফেসবুক

মনজোতের (বাঁ দিকে) সঙ্গে সামরিন। ছবি: ফেসবুক

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বাইশ বছর বয়সি সামরিন আখতারের দুইটি কিডনি কাজ করিতেছে না। জম্মু ও কাশ্মীরের মেয়েটির সমবয়সি বন্ধু মনজোত সিংহ কোহলি নিজের একটি কিডনি তাঁহাকে দান করিতে চাহিয়াছেন। কিন্তু শ্রীনগরের শের-ই কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর কর্তৃপক্ষ তাঁহার আবেদন নাকচ করিয়া দিয়াছেন। তাঁহাদের বক্তব্য, মনজোতের বাবা তাঁহার মেয়ের প্রস্তাবে প্রবল আপত্তি জানাইয়া অভিযোগ করিয়াছেন যে, মেয়েকে কিডনি দানের জন্য ‘চাপ’ দেওয়া হইতেছে, অর্থাৎ তাঁহার অঙ্গদানের ইচ্ছা প্রকৃতপক্ষে স্ব-ইচ্ছা নহে। প্রধানত এই আপত্তির ভিত্তিতেই হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট অনুমোদন কমিটি মনজোতের আবেদন মঞ্জুর করিতে অপারগ। মনজোতের বক্তব্য, আপন ইচ্ছা পূরণের সুস্পষ্ট আইনি অধিকার তাঁহার রহিয়াছে, আইনের স্থান সব আবেগ এবং (পারিবারিক) সম্পর্কের উপরে, ইতিপূর্বে একটি তুলনীয় পরিস্থিতিতে রাজস্থানের একটি মেয়েকে সেই রাজ্যের হাইকোর্ট কিডনি দানের ইচ্ছাপূরণের অনুমতি প্রদান করিয়াছিল। তাঁহার দৃঢ় ধারণা, আইনের জোরে তিনিও অনুমতি আদায় করিবেন।

আইন-আদালত তাহার আপন নিয়মে চলিবে। কিন্তু এই ঘটনা যে প্রশ্নগুলি তুলিয়া দিয়াছে তাহা আইনের গণ্ডিতে আবদ্ধ নহে। এক দিকে মানবিকতার প্রশ্ন, অন্য দিকে স্বাধীন স্ব-ইচ্ছার। আত্মীয়, বন্ধু বা সহনাগরিকের প্রতি সহমর্মিতার কারণেই হউক অথবা অপরের জীবনের প্রতি নৈতিক দায়বদ্ধতার কারণেই হউক, অন্যের জন্য আপন অঙ্গ দান করিবার আগ্রহ গভীর ভাবে মানবিক আগ্রহ। নিছক স্বার্থবুদ্ধির অঙ্ক কষিয়া এই মানবিকতার তল মিলিবে না। তাহার পাশাপাশি, কোন ইচ্ছা ঠিক কতখানি স্বাধীন স্ব-ইচ্ছা, সেই প্রশ্নও উড়াইয়া দিবার নহে। ব্যক্তির ইচ্ছার উপর অপরের প্রভাব, বিশেষত কাছের মানুষের মানসিক প্রভাব কত প্রবল হইতে পারে, তাহার অগণিত নজির প্রতিনিয়ত তৈয়ারি হইতেছে। অনেক সময়েই ব্যক্তি নিজেও, অন্তত সাময়িক ভাবে, বুঝিতে পারেন না, অন্যের প্রভাব এবং আপন ইচ্ছার মধ্যে সীমারেখাটি ঠিক কোথায়। স্ব-ইচ্ছার গতি, দেবা ন জানন্তি।

কিন্তু সেই কারণেই শেষ বিচারে ব্যক্তির ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্তকে মান্য করিতেই হয়। সেই সিদ্ধান্ত তাঁহার পক্ষে ক্ষতিকর কি না, তিনি কাহারও প্রভাবে অথবা অন্য কারণে সেই ক্ষতি বুঝিতে অপারগ কি না, সেই সব প্রশ্ন নিশ্চয়ই তাঁহাকে করা চলে, হয়তো করা আবশ্যকও, কিন্তু উত্তর তাঁহাকেই দিতে হইবে এবং অন্যদের সেই উত্তর মানিতেই হইবে। এই নীতি না মানিলে ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল শর্ত লঙ্ঘিত হয়। এবং ব্যক্তির নিজস্ব জীবনে তাঁহার ইচ্ছার সার্বভৌমত্ব স্বীকার না করিলে তাঁহার উপর নানাবিধ অন্যায়ের আশঙ্কাও বহুগুণ বাড়িয়া যায়। বিশেষত ভারতের মতো দেশে, যেখানে ব্যক্তির উপর পরিবার তথা সমাজের দাপট আজও অতি প্রবল, অনেক সময়েই যাহা ধর্মীয় অনুষঙ্গের কারণে প্রবলতর হইয়া উঠে। প্রসঙ্গত, কেরলের হাদিয়া নামক মেয়েটির কথা মনে পড়িতে পারে। তাঁহার বিবাহ নাকচ করাইবার জন্য যে বিপুল তৎপরতা দেখা গিয়াছিল তাহা ব্যক্তিস্বাধীনতার, সুতরাং গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মনজোত সিংহ কোহলির ইচ্ছাকে মর্যাদা দেওয়ার দাবি প্রকৃতপ্রস্তাবে গণতন্ত্রেরই দাবি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE